‘আশঙ্কা’ থেকে খালেদা জিয়ার বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত, ধারণা বিএনপির

খালেদা জিয়া
ফাইল ছবি

দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের আবেদন নাকচ করার বিষয়ে সরকারের ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নয় বিএনপি। দলটির নেতারা মনে করেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরই অংশ। কার্যত সুস্থ হয়ে খালেদা জিয়া আবার রাজনীতিতে তৎপর হন কি না, এমন আশঙ্কা থেকেই সরকার তাঁর বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।


বিএনপির মহাসচিব মিজা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপিকে টার্গেট করে বিএনপির চেয়ারপাসন খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার যে চক্রান্ত এক-এগারো থেকে শুরু হয়েছিল, এটি তারই ধারাবাহিকতা।

যদিও খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার আবেদনের বিষয়ে শুরুতে সরকারের মনোভাব ছিল ইতিবাচক; যা দেখে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্য ও দলের নেতারা। খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে ৬ মে সরকারের কাছে আবেদন করেন তাঁর ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার। পরদিন আবেদনটি যাচাই–বাছাই শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি মানবিকভাবেই দেখা হচ্ছে।

কিন্তু চার দিনের মাথায় পরিবারের আবেদনটি নাকচ করে দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, আইন মন্ত্রণালয় থেকে যে মতামত এসেছে, তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ৪০১ (১) ধারায় সাজা স্থগিত করে যে সুবিধাটি (খালেদা জিয়াকে) দেওয়া হয়েছে, সেখানে আবার তাঁকে সাজা মওকুফ করে বিদেশে পাঠানোর কোনো অবকাশ নেই।

সরকারের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তারা যুক্তি দেখাচ্ছে যে এ ধরনের (দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে বিদেশে পাঠানোর) নজির নেই, এটা সত্য নয়। ১৯৭৯ সালে কারাবন্দী আ স ম আবদুর রব চিকিৎসার জন্য পশ্চিম জার্মানি যান। তৎকালীন সরকার এই ব্যবস্থা করে।’

অবশ্য খালেদা জিয়ার ‍বিদেশযাত্রা আটকে দেওয়ার বিষয়টিকে সরকারের রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির ‘হিসাব-নিকাশ’ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা। তাঁদের ধারণা, শুরুতে সরকারি মহল হয়তো ধরে নিয়েছিল যে খালেদা জিয়ার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন। এ অবস্থায় কোনো অঘটন ঘটে গেলে এর দায় সরকারের ওপর বর্তাবে। সে জন্য খালেদা জিয়া করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে পরিবারের আবেদনের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী ইতিবাচক মনোভাব দেখান।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, গত বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতির প্রেক্ষাপটে সরকার খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করে কারামুক্তি দিয়েছিল। তখনকার প্রেক্ষাপটে এটি ছিল সরকারের রাজনৈতিক দায়মুক্তি বা ঝুঁকি এড়ানোর কৌশল। এখন আবার সরকার খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় বিদেশে পাঠানোর কথা নয়। সে ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে সরকার তাঁকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেবে না। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিশ্চয়ই সরকার তার রাজনৈতিক লাভ–ক্ষতির হিসাব করবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিবারের আবেদন হাতে পেয়ে হয়তো সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মহল খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছিল। তারা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা এবং তাঁর স্বাস্থ্যগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার তথ্য-উপাত্ত হাতে নিয়েছে। এরপর সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে তা পৌঁছানোর পর বিদেশে যাওয়ার অনুমতির ব্যাপারে সরকারের মনোভাব পাল্টায়।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির গবেষণা ও গণসংযোগ বিভাগের পরিচালক ও দলের সাবেক সাংসদ জহিরউদ্দিন স্বপন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার খালেদা জিয়ার জীবন-মৃত্যু নিয়ে খেলা করছে। বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে সরকারের আচমকা ইউটার্ন দেখে দেশবাসী ক্ষুব্ধ ও সন্দিগ্ধ।

শারীরিক অবস্থা, বয়স এবং রাজৈনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলো। এর বাইরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকিও খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও জামিন চেয়েছেন।

বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেখানে ফৌজদারি মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সাজা মওকুফ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে না দেওয়ার যুক্তিসংগত কোনো কারণ দেখি না।’

সাইফুল হক বলেন, খালেদা জিয়ার বিচারটাকে মানুষ অর্থনৈতিক দুর্নীতির বিচার মনে করে না, এটা রাজনৈতিক স্বার্থের বিচার। আইনের যে ধারায় তাঁর দণ্ড স্থগিত করা হয়েছে, সে ধারাতেই উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার দরকার ছিল।