এম এন লারমার সংগ্রাম ছিল সব নিপীড়িত মানুষের পক্ষে

এম এন লারমার ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় তাঁর প্রতিকৃতির সামনে মোমবাতি জ্বালানো হয়। ছবি: প্রথম আলো
এম এন লারমার ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় তাঁর প্রতিকৃতির সামনে মোমবাতি জ্বালানো হয়। ছবি: প্রথম আলো

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের পক্ষে লড়াই করেছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমা। তবে তিনি শুধু পাহাড়ের মানুষের নেতা ছিলেন না; তাঁর সংগ্রাম ছিল দেশের সব নিপীড়িত মানুষের পক্ষে, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে। মানুষে মানুষে বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। সেই বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এম এন লারমার আদর্শ এখনো প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) প্রতিষ্ঠাতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদের সদস্য এম এন লারমার ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় আজ এসব কথা বলেন বক্তারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় এ সভার আয়োজন করা হয় আজ রোববার বিকেলে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন জাতীয় কমিটি এর আয়োজন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় আজ এম এন লারমার মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয় নানা আয়োজনে।

পিসিজেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম রাজনৈতিক দল। ১৯৭৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন এম এন লারমা। তিনি ১৯৭০–এর নির্বাচনে এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩–এ দুবার সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে সশস্ত্র লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর নিজ দলের একদল বিপথগামী সদস্যের হাতে তিনি নিহত হন। পাহাড়ের মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের লড়াইয়ে থাকা জেএসএস ১৯৯৭ সালে অস্ত্র ছেড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে। পাহাড়ের জনগণের রাজনৈতিক বিকাশে এম এন লারমার অবদানকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আজ এম এন লারমার সেই রাজনৈতিক দর্শনের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধে জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে লড়েছিলাম। কিন্তু তা জাতিগত সুবিধা আদায়ের জন্য ছিল না। ৪৮ বছর ধরে এ দেশে বাঙালি ছাড়া অপরাপর জাতিগুলোকে নানাভাবে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। এম এন লারমা লড়েছিলেন সার্বিক শোষণের বিরুদ্ধে। তাই তিনি আজও প্রাসঙ্গিক। তিনি এ দেশের জাতীয় নেতা।’

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমরা ইতিহাসের অনেক নায়ক থেকে বিস্মৃত হই। কারণ, আমরা আমাদের সুবিধামতো ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করি। একজন পাহাড়ি নেতা এম এন লারমাকে একজন বাঙালি নারী বা পুরুষ যে বিস্মৃত হবেন, তা স্বাভাবিক। কিন্তু এমন এন লারমা যে আমাদের জাতীয় ইতিহাস নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এ কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে। তাঁকে ভুলে যাওয়া মানে আমাদের ইতিহাসকেই অবজ্ঞা করা।’

এম এন লারমার মৃত্যুর পর তাঁর ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা জেএসএসের নেতৃত্ব দেন। তিনি জেএসএসের পক্ষে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এখন তিনি পার্বত্য চুক্তির ফলে প্রতিষ্ঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান। তবে প্রায় ২২ বছর আগে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে জেএসএসের ক্ষোভ আছে।
আজকের সভায় সাংসদ মেনন বলেন, অশান্ত পাহাড়ে শান্তির জন্য এই চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। দুঃখজনকভাবে এ চুক্তির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, যে স্বপ্ন এম এন লারমা দেখেছিলেন, তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

সভায় আরও বক্তব্য দেন বাসদ নেতা রাজেকুজ্জামান, বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া, সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, জেএসএসের স্টাফ সদস্য চঞ্চনা চাকমা প্রমুখ। সভাপতি করেন মুশতাক হোসেন।

এম এন লারমার ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো
এম এন লারমার ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত স্মরণসভায় বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো

স্বাগত বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, শোক প্রস্তাব পড়েন অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন।
সভার আগে মঞ্চের পাশে স্থাপন করা এম এন লারমার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন বিভিন্ন দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা। এ সময় শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন হিরন মিত্র চাকমা।

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের ব্যান্ড এফ মাইনর ও মাদল সংগীত পরিবেশন করে।

রাঙামাটিতে স্মরণসভা
আজ সকাল ১০টায় জনসংহতি সমিতির রাঙামাটি জেলা শাখার উদ্যোগে আয়োজিত এম এন লারমার স্মরণসভা হয় রাঙামাটি শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে। এতে সভাপতিত্ব করেন জনসংহতি সমিতির জেলা কমিটির সদস্য নিকোলাই পাংখোয়া। স্মরণসভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও সাবেক এমপি ঊষাতন তালুকদার, আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য গৌতম কুমার চাকমা, শিক্ষাবিদ মংসানু চৌধুরী, পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী ফোরামের সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন, এম এন লারমা মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিজয় কেতন চাকমা ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি সুমন মারমা প্রমুখ। এর আগে শিল্পকলা একাডেমি এলাকা থেকে প্রভাতফেরি (শোভাযাত্রা) শুরু করা হয়। পরে উত্তর কালিন্দীপুর, নিউমার্কেট, আদালত প্রাঙ্গণ, হ্যাপীমোড় ও বনরূপা এলাকা প্রদক্ষিণ শেষে আবার শিল্পকলা একাডেমি এলাকায় গিয়ে শেষ হয়। এরপর এম এন লারমা অস্থায়ী শহীদবেদিতে ফুল দিয়ে সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা জানান।
এ ছাড়া রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় এম এন লারমার ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে শোক দিবস পালন করা হয়।