ঐক্যের নতুন ফর্মুলা দাঁড় করাচ্ছে বিএনপি

জামায়াতকে নিয়ে আপত্তি, ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে হতাশা, ভাঙাগড়ায় নাজুক ২০-দলীয় জোট—এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি।

বিএনপি

ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের দাবিতে একটি বৃহত্তর ঐক্যের নতুন ফর্মুলা দাঁড় করাচ্ছে বিএনপি। তাতে বহুল আলোচিত ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মতো পুরোনো জোটকাঠামো আর থাকছে না।

বিএনপির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সরকারবিরোধী সব পক্ষকে একসূত্রে গাঁথার যে ভাবনা নিয়ে তারা এগোচ্ছে, সেটি পুরোনো জোটকাঠামো বহাল রেখে সম্ভব হচ্ছে না। এমন প্রেক্ষাপটে সব পক্ষকে ন্যূনতম দাবিতে এক সুরে আনতে ২০-দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টকে ভিন্ন কোনো কৌশলে আন্দোলনে সম্পৃক্ত রাখার কথা ভাবা হচ্ছে।

তবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন এই দুটি জোট ভেঙে দেওয়া হবে কি না বা কোন প্রক্রিয়ায় দুই জোটের অস্তিত্বের অবসান হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। যদিও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ২০-দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক আগের মতো নেই বিএনপির।

দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঐক্যের এই নতুন ফর্মুলার নেপথ্য কারণ যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী। কারণ, বিএনপির নীতিনির্ধারকদের একটি
অংশের উপলব্ধি হচ্ছে যে জামায়াতকে নিয়ে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন মহলে যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে, তাতে দলটির সঙ্গে জোটবদ্ধ থেকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে যাওয়া যাবে না। তা ছাড়া বিএনপি যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে, সেখানেও জামায়াত বাধা হিসেবে এসেছে। কারণ, জামায়াত থাকায় অনেক দল বিএনপির সঙ্গে জোট গড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না বলে আলোচনা আছে। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্ট নিয়েও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বে হতাশা আছে।

অবশ্য বিএনপির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন থেকে সরকার ও সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বিভিন্ন মহলের চেষ্টা হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতের ঐক্য ভেঙে দেওয়া। কিন্তু দল দুটির ঐক্য এখনো টিকে থাকায় ওই সব মহলের এখনকার চেষ্টা হলো জামায়াত ছাড়া অন্য দলগুলোকে বিএনপির জোট থেকে বের করে আনা। এর মাধ্যমে রাজনীতিতে বিএনপিকে একা করার পাশাপাশি মানুষকে এটা বোঝানোর চেষ্টা যে যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত ছাড়া বিএনপির সঙ্গে আর কেউ নেই। সম্প্রতি যে দুটি ইসলামি দল ২০-দলীয় জোট ছাড়ে, সেটা ওই সব মহলের পরিকল্পনার অংশ বলে মনে করছে বিএনপি।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার চাপ দিয়ে, মামলা-মোকদ্দমার ভয় দেখিয়ে, লোভ দেখিয়ে—নানাভাবে দলগুলোকে (জোটভুক্ত) বের করে নিচ্ছে। অতীতেও আমরা দেখেছি, এসব করে কোনো লাভ হয় না। বিএনপিকেও অনেকবার ভাঙার চেষ্টা হয়েছে, লাভ হয়নি।’

জোট ছেড়েছে ৮টি দল, আছে খণ্ডিতরা

নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত আটটি দল বিভিন্ন সময়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেছে। মূলত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর এই প্রক্রিয়া শুরু হয় বলে মনে করছে বিএনপি। এ পর্যন্ত জোট ছেড়ে যাওয়া দলগুলো হলো খেলাফত মজলিস (ইসহাক), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম (জিয়াউদ্দিন আহমদ), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি (আন্দালিভ রহমান), বাংলাদেশ ন্যাপ (জেবেল রহমান), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি (গোলাম মর্ত্তুজা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি (শওকত হোসেন নিলু), ইসলামী ঐক্যজোট (মুফতি আমিনী) ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (শায়খুল হাদিস)। এরপরও আরও দু-তিনটি দল জোট ছাড়তে পারে বলে গুঞ্জন আছে।

অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দরকার একটা দৃশ্যমান আন্দোলন। আমরা যদি আন্দোলনের গতি বাড়াতে পারি, তখন যারা যাচ্ছে, যারা বন্দী আছে—কাউকেই আটকে রাখতে পারবে না।’

অনেক ভাঙাগড়ার পর ২০-দলীয় জোটের অবস্থা এখন বিপর্যস্ত। আটটি দল জোট ছেড়ে গেলেও দলগুলোর খণ্ডিত অংশ রয়ে গেছে। ফলে সংখ্যাগত দিক থেকে ২০-দলীয় জোট ঠিক থাকে। তবে সম্প্রতি খেলাফত মজলিস ও জমিয়ত জোট ছাড়ার পর শরিক দলের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮টিতে। কারণ, দল দুটির কোনো খণ্ডিত অংশ জোটে নেই।

বর্তমানে যে ১৮টি দল জোটে আছে, সেগুলোর মধ্যে কেবল বিএনপি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) নিবন্ধন আছে। এদের মধ্যে বিএনপি ছাড়া শুধু কল্যাণ পার্টিকে ঘরোয়া নানা কর্মসূচিতে সক্রিয় দেখা যায়।

২০ দলের নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনের তত্ত্ব পুরোনো। অতীতেও যুগপৎ আন্দোলন হয়েছে, এখনো এর চর্চা হতে পারে। কথা হচ্ছে, যুগপতের জন্য সবাইকে আস্থায় আনতে হবে, বিএনপি আন্দোলনে মনোযোগী কি না, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’

আবার জোটের নিবন্ধিত তিনটি দলের একটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) দুই ভাগে বিভক্ত। একটির নেতৃত্বে অলি আহমেদ, অপর অংশে রয়েছেন আবদুল করিম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেন সেলিম। নানা হিসাব-নিকাশে বিএনপি সেলিমকেই পাশে রাখছে। সম্প্রতি ২০ দলের এক সভায় এলডিপির নেতা হিসেবে বিএনপি শাহাদাত হোসেন সেলিমকে ডাকায় অলি আহমেদ রেগে বের হয়ে যান। এর পর থেকে অলি আহমেদ নিশ্চুপ। মাঝে জাতীয় মুক্তি মঞ্চ নামে জোট গঠনে কিছুদিন তৎপর ছিলেন তিনি। এখন সেটিরও তৎপরতা নেই। তাঁর নানামুখী তৎপরতায় বিএনপি সন্দিহান।

অবশ্য অলি আহমেদ এসব বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটি বড় দল হিসেবে বিএনপি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। বিএনপিকে জোট গতিশীল করে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামতে হবে। পাশাপাশি জাতীয় সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, জাতীয় সরকার ছাড়া বর্তমান সমস্যার সমাধান হবে না।

বিএনপিসহ এই তিন দলের বাইরে বর্তমানে ২০-দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), জাতীয় পার্টি (জাফর), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ইসলামী ঐক্যজোট (আবদুর রকিব), এনডিপি, পিপলস লীগ, সাম্যবাদী দল, জাতীয় দল, ডেমোক্রেটিক লীগ, ন্যাপ ভাসানী, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, লেবার পার্টির নিবন্ধন নেই। যাদের কেবল জোটের সংখ্যা ঠিক রাখতেই শরিক দলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ দলেরই লোকবল নেই, মাঠেও কর্মসূচি থাকে না।

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
ফাইল ছবি
আমরা আমাদের বক্তব্য নিয়ে মাঠে নামব, চাপ সৃষ্টি করব। এরপর বৃহত্তর ঐক্যের জন্য সবাইকে ডাকব। তখন কে আসবে না আসবে, সেটা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। কারণ, এটা শুধু বিএনপির সংকট নয়।
মির্জা ফখরুল ইসলাম, মহাসচিব, বিএনপি

ঐক্যফ্রন্ট এখন মৃতপ্রায়

২০ দলের মতো বিএনপির আরেক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও এখন মৃতপ্রায়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে বিএনপি, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ মিলে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। নির্বাচনের পর এ জোটের শরিকদের মধ্যে মনোমালিন্য, বিভক্তি দেখা দেয়। জোট থেকে বেরিয়ে যায় কাদের সিদ্দিকীর দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। ভাঙনে পড়ে আ স ম আবদুর রবের জেএসডি এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম। এর মধ্যে জেএসডি সংকট কাটিয়ে উঠলেও গণফোরামে টানাপোড়েন এখনো কাটেনি।

বিএনপির নতুন ফর্মুলা

জামায়াতকে নিয়ে আপত্তি, ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে হতাশা, ভাঙাগড়ায় নাজুক ২০-দলীয় জোট—এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পুরোনো জোট কাঠামোয় আর না থেকে বৃহত্তর ঐক্যের নতুন ক্ষেত্র তৈরিতে মনোযোগী হয়েছে বিএনপি। দলের নীতিনির্ধারকের নতুন পরিকল্পনা হলো, নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আপাতত নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামা এবং আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করা। যাতে অন্য দলগুলো মাঠে নামতে আস্থা পায়। এ লক্ষ্যে ১০ থেকে ১২ দফার একটি রূপরেখার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। যেখানে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা, বর্তমান কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটিয়ে সুশাসনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। এই রূপরেখাকে ভিত্তি ধরে অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোকে এক সূত্রে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আমাদের বক্তব্য নিয়ে মাঠে নামব, চাপ সৃষ্টি করব। এরপর বৃহত্তর ঐক্যের জন্য সবাইকে ডাকব। তখন কে আসবে না আসবে, সেটা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। কারণ, দেশের বর্তমান যে সংকট, এটা শুধু বিএনপি বা কোনো দলের নয়, সমগ্র জাতির সংকট।’

আন্দোলনের নতুন এই কৌশলের সঙ্গে বিএনপির দুই জোটের শরিক দলগুলোর অনেকে একমত। ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, একটি জোটবদ্ধ বৃহৎ আন্দোলন এখন সময়ের দাবি। তবে, তার মানে এই নয় যে সবাইকে এক মঞ্চে আসতে হবে। আলাদা থেকেও যুগপৎ আন্দোলন করা যেতে পারে।

বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, বর্তমান সরকারের ভোটাধিকার হরণ ও অপশাসনের ব্যাপারে সবাই একমত। এখন দলমত-নির্বিশেষে যার যার অবস্থান থেকে এ বিষয়ে সোচ্চার ও সক্রিয় হলেই একটি বৃহত্তর আন্দোলনের সূত্রপাত হতে পারে। এই পথ ধরেই ধীরে ধীরে যুগপৎ কর্মসূচির দিকে যাবে দলগুলো। এভাবে মাঠের ঐক্যের মধ্য দিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্য তৈরি হবে। এ রকম চিন্তা থেকেই পুরোনো জোটকাঠামো থেকে বের হয়ে আন্দোলনের বৃহত্তর ক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছে বিএনপি।

যদিও আন্দোলনের এ ফর্মুলা কতটা বাস্তবতা পাবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপির ঐক্যের চেষ্টার মধ্যেই জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও খেলাফত মজলিস ২০-দলীয় জোট ছেড়ে যায়। নিবন্ধিত এ দল দুটি ২২ বছর ধরে বিএনপির সঙ্গে ছিল। এমন বাস্তবতায় দলের ভেতরে-বাইরে অনেকের প্রশ্ন, বিএনপির বৃহত্তর ঐক্য কাদের নিয়ে, কীভাবে।

এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ আছে। কিন্তু কেউ অত্যাচারের মধ্যে পড়তে চায় না। বিরোধী দলের চ্যালেঞ্জ হলো, যে বরফ জমেছে, সেটা কীভাবে ভাঙা যাবে। এটাও সত্য, সাংগঠনিক প্রস্তুতি ছাড়া আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। এ দেশের যুগপৎ আন্দোলনের ইতিহাস আছে। যুগপৎ বলেন, জোটবদ্ধ বলেন—গণ-আন্দোলনের জন্য ভালো সাংগঠনিক প্রস্তুতি প্রয়োজন, যাতে লক্ষ্য স্থির করা যায়। সে প্রস্তুতি কী আছে?’