কৃষক পরিবারের সন্তান এখন খাদ্যমন্ত্রী

সাধন চন্দ্র মজুমদার
সাধন চন্দ্র মজুমদার

নওগাঁ-১ (নিয়ামতপুর, পোরশা ও সাপাহার) আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ সাধন চন্দ্র মজুমদার নতুন সরকারের খাদ্যমন্ত্রী হয়েছেন। নওগাঁর এই আসন থেকে এই প্রথম কোনো সাংসদ মন্ত্রিসভার সদস্য হলেন।

এলাকার প্রথম মন্ত্রী সাধন মজুমদার। তাঁর সম্পর্কে এ তথ্য কিন্তু পর্যাপ্ত না। একটি কৃষক পরিবারের সদস্য তিনি। করেছেন ধান-চালের ব্যবসা। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পরে আবার উপজেলা চেয়ারম্যান হন। এরপর সাংসদ, আর এবার মন্ত্রী। এভাবেই একজন সাধন মজুমদার খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার হয়ে উঠলেন। আর তাঁর এই সাফল্যে গর্বিত এলাকাবাসীও। পরিবারের লোকজন স্মরণ করছেন তাঁর অতীতকে। সাধন মজুমদারের এ অবস্থানে উঠে আসার গল্প অকপটে বলেছেন তাঁর ছোট ভাই নিয়ামতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনা মজুমদার। বলেন, ‘স্কুলশিক্ষক বাবা মারা যাওয়ার পর কৃষিজমি চাষাবাদ ও ধান-চালের আড়তের ব্যবসার ওপর দিয়ে আমাদের ৯ ভাইবোনের বড় সংসার চলেছে। এমপি হওয়ার আগ পর্যন্ত সাধন দাদা নিজেও কৃষিকাজ ও আড়তের ব্যবসা করতেন। দাদার জমিজমা ও আড়তের ব্যবসা এখন আমি ও আমার অন্য ভাইয়েরা দেখাশোনা করি।’

খাদ্যে উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে পরিচিত নওগাঁ। একেবারে তৃণমূল থেকে উঠে আসা এই নেতাকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া এবারের মন্ত্রিসভার অন্যতম চমক।

১৯৫০ সালে নিয়ামতপুর উপজেলার শিবপুর বলদাহঘাট গ্রামে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা মৃত কামিনী কুমার মজমুদার শিবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি কৃষিকাজ ও ধানের আড়তের (ধান কেনাবেচা) ব্যবসা করতেন। মা সাবিত্রী বালা মজুমদার ছিলেন গৃহিণী। সাধন চন্দ্র মজুমদারেরা ৯ ভাইবোন। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তিনি তাঁর বাবাকে হারান। এরপর থেকে তাঁর বড় ভাই (দাদা) নিরোধ চন্দ্র মজুমদার পরিবারের হাল ধরেন। বড় ভাই নিরোধ চন্দ্র মজুমদার কৃষিকাজ ও ধানের আড়তের ব্যবসা করে ছোট ভাইবোনদের বড় করেন। লেখাপড়া শেষ করে সাধন চন্দ্র মজুমদার সক্রিয় রাজনীতির পাশাপাশি ধান-চালের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন।

সাধন চন্দ্র মজুমদার নওগাঁ সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। কলেজজীবন থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬৭ সালে তিনি ছাত্রলীগের সদস্য হন। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একজন প্রাথমিক সদস্য থেকে শুরু করে তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। এখন তিনি নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে রয়েছেন।
সাধন চন্দ্র মজুমদারের প্রথম জনপ্রতিনিধি হওয়া ১৯৮৪ সালে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৯০ সালে তিনি নিয়ামতপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তাঁকে নওগাঁ-১ আসন থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। দুই নির্বাচনে তিনি বিএনপির প্রার্থী ছালেক চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে তিনি প্রথমবারের মতো সাংসদ হন। এর পর থেকে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন পর্যন্ত তিনি নওগাঁ-১ আসন থেকে টানা তৃতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
মনা মজুমদার আরও বলেন, ‘দাদা একজন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ। সকাল থেকে রাত অবধি দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গেই তাঁরা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটে। মন্ত্রী হলে তাঁর কাজের পরিধি আরও বেড়ে যাবে। নিজ নির্বাচনী এলাকা ও দেশের মানুষের আরও বেশি সেবা করার সুযোগ পাবেন তিনি। দাদার সততা ও দলের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসাই তাঁকে আজকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।’

সাধন চন্দ্র মজুমদারের জন্মভূমি শিবপুরের পার্শ্ববর্তী কাপাষ্টিয়া গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক বিভূতি সাটিয়ার বলেন, ‘সাধন চন্দ্র মজুমদারের জীবন অনেক সংগ্রামের। ছেলে-মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই তাঁর বাবা মারা যান। এরপর তাঁর মা ও বড় ভাই অনেক কষ্ট করে সংসার সামলিয়েছেন। বড় ভাই ধানের আড়তের ব্যবসার পাশাপাশি অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে সংসার চালাত। সাধন চন্দ্র মজুমদার নিজেও পড়াশোনা করার পাশাপাশি ভাইয়ের সঙ্গে জমিতে কৃষিকাজ করেছেন।’

নওগাঁ থেকে দেশের চালের জোগানের একটি বড় অংশ আসে। এই পেশায় জড়িত একজনকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ায় পূর্বে দায়িত্ব পালনকারী খাদ্যমন্ত্রীদের চেয়ে তিনি ভালো করবেন বলে মনে করেন ধান-চালের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা।
নওগাঁ জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘সাধন চন্দ্র মজুমদার কৃষক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। পাশাপাশি তিনি ধান-চালের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সেই হিসেবে উপযুক্ত ব্যক্তিই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে ইতিপূর্বে দায়িত্বরত খাদ্যমন্ত্রীদের চেয়ে তিনি ভালো করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।’
গতকাল রোববার সাধন চন্দ্র মজুমদারকে সচিবালয় থেকে ফোন করে মন্ত্রী হিসেবে শপথের আমন্ত্রণ জানানোর খবর জানাজানি হলে নওগাঁ শহর ও তাঁর নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতা-কর্মীরা উল্লাসে ফেটে পড়েন। তাঁর নির্বাচনী এলাকা নিয়ামতপুর, পোরশা ও সাপাহার উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে সমবেত হয়ে নেতা-কর্মীরা আনন্দ-উল্লাস ও মিষ্টি বিতরণ করেন। এ ছাড়া মিষ্টি বিতরণ করেছেন এলাকায় তাঁর আরও অনেক সমর্থক ও শুভাকাঙ্ক্ষী।