চাপে ফেলার কৌশল মনে করছেন হেফাজত নেতারা

হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ

আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর তিন মাস পর তাঁকে হত্যার অভিযোগে করা মামলাকে ‘রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র’ এবং ‘চাপে ফেলার কৌশল’ বলে দাবি করছেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। গতকাল বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের আদালতে করা এ মামলায় হেফাজতের ৩৬ জন নেতা–কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে আলোচনায় আসায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকও রয়েছেন।

এই মামলার দুদিন আগে ভাস্কর্য বিষয়ে পাঁচ দফা দাবি নিয়ে ঢাকায় শীর্ষস্থানীয় আলেমরা বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। সে বৈঠকে অংশগ্রহণকারী আলেমদের মধ্যে কেউ কেউ হেফাজতেরও কেন্দ্রীয় নেতা। আলেমদের দাবি বা প্রস্তাব নিয়ে আরও আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

এরই মধ্যে গতকাল চট্টগ্রামের আদালতে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির মাওলানা শাহ আহমদ শফীকে হত্যার অভিযোগে নালিশি মামলা করেছেন তাঁর শ্যালক মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিপলু কুমার দে মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান বাদীর আইনজীবী আবু হানিফ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পূর্বপরিকল্পিতভাবে আহমদ শফীকে মানসিক নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে মামলাটি হয়েছে।

মামলায় বলা হয়, ‘মানসিক নির্যাতন এবং চিকিৎসা না পেয়ে শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু হয়।’ গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শাহ আহমদ শফী ১০৩ বছর বয়সে মারা যান। পরবর্তী সময়ে ঢাকা ও চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতের সাবেক কয়েকজন নেতা অভিযোগ করেছিলেন যে আহমদ শফীকে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগকারী এসব নেতা শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীর অনুসারী এবং সরকারঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁরা কেউ হেফাজতের নতুন কমিটিতে পদ পাননি।

মামলার বাদী মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন হেফাজতের কোনো পদে নেই। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কারও প্ররোচনায় কিংবা ইন্ধনে তিনি এ মামলা করেননি। পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে দেরির কারণে তিন মাস পর মামলা করেছেন। আহমদ শফীর ছেলেরা হামলার আশঙ্কায় আতঙ্কে আছেন। তাই তিনি বাদী হয়েছেন। এর সঙ্গে হেফাজতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।

মামলায় হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক ও নাছির উদ্দিন মুনির, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইদ্রিস, সহকারী মহাসচিব হাবিব উল্লাহ, সহকারী অর্থ সম্পাদক আহসান উল্লাহ, প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়জী, হেফাজতের বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর ব্যক্তিগত সহকারী (খাদেম) এনামুল হাসান ফারুকীসহ ৩৬ জনকে আসামি করা হয়। তাঁরা সবাই হেফাজতের বর্তমান আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

মামলায় বলা হয়, অসুস্থ হলেও আহমদ শফীকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় তাঁর কক্ষে আটকে রাখা হয়। তাঁর কক্ষে আসামিদের ইন্ধনে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। মাদ্রাসামাঠে আহমদ শফীকে বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে রাখা হয়। আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে শফী হুজুরকে দেওয়া স্যালাইনও খুলে ফেলেন। অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাঁকে চিকিৎসা করার জন্য মাদ্রাসা থেকে বের করতে দেননি। মানসিক নির্যাতন ও চিকিৎসা না পেয়ে আহমদ শফীর মৃত্যু হয়।

এ মামলাকে ‘ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে মন্তব্য করেন মাওলানা মামুনুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মনে হচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল নতুন করে স্বার্থ উদ্ধারের খেলায় নেমেছে। হেফাজত থেকে পুরোপুরি উৎখাত হওয়ার পর চাপ প্রয়োগ করে তারা নতুনভাবে ঢোকার কৌশল হিসেবে নিয়েছে মামলাটিকে। এটা চাপে ফেলার কৌশল।’

শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষক পদ থেকে অব্যাহতিসহ ছয় দফা দাবিতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ শুরু করেন ছাত্ররা। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে মাদ্রাসাটির মহাপরিচালকের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন শাহ আহমদ শফী। একই সঙ্গে আনাস মাদানীকে মাদ্রাসার শিক্ষকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয় শুরা কমিটি। এরপর অসুস্থ আহমদ শফীকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আনা হয় এবং ১৮ সেপ্টেম্বর মারা যান তিনি।

এর তিন মাস পর হত্যার অভিযোগে করা মামলা সম্পর্কে হেফাজতের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতের নেতাদের বিতর্কিত ও সংগঠনকে দুর্বল করার জন্য এটি হয়েছে। এটির পেছনে গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এ ছাড়া হেফাজতের নতুন কমিটি থেকে আনাস মাদানীর অনুসারীদের বাদ দেওয়ায় কমিটিকে চাপে রাখাটাও এ মামলার একটি কারণ।

তবে আনাস মাদানীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী বলেন, এ মামলার পেছনে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নেই। এটি পারিবারিক বিষয়।

এদিকে ভাস্কর্য নিয়ে আলেমদের সঙ্গে সরকারের আলোচনায় এ মামলায় প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। তিনি গত সোমবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলেমদের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীকে হত্যার অভিযোগে করা মামলা এ আলোচনায় কোনো প্রভাব ফেলবে না। কারণ, দুটি আলাদা বিষয়। শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু নিয়ে যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে তা দূর হোক, সেটা আলেমরাও চান।

মাওলানা মাসউদ বলেন, ওই দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আলেমদের পক্ষ থেকে মৌলিক প্রস্তাবগুলো পেশ করা হয়েছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলেমদের বলেছেন, এগুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করবেন এবং তাঁর পরামর্শ নিয়ে জানাবেন।

ওই বৈঠকে আলেমরা ভাস্কর্যের বদলে বঙ্গবন্ধুর নামে মিনার স্থাপনের প্রস্তাব করছেন। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, আলেমরা পাঁচটি সুপারিশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘আমরা সুপারিশ করলাম। মানা না–মানা আপনাদের বিষয়। আমরা বলেছি, আমরা দেখলাম। আবার কথাবার্তা হবে, আলোচনা করব।’

বেশ কিছুদিন ধরে রাজধানীর দোলাইরপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ বন্ধের দাবিতে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন বক্তৃতা-বিবৃতি, বিক্ষোভ করে আসছিল। এর মধ্যে ৪ ডিসেম্বর রাতে কুষ্টিয়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এরপর ৫ ডিসেম্বর যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় কওমি আলেমদের এক সভা থেকে ভাস্কর্যের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন আলেমরা।