ছাত্র ইউনিয়নের ‘বিদ্রোহী অংশের’ সভাপতির সদস্য পদ স্থগিত

স্বাক্ষর ও সিলমোহর জালিয়াতির অভিযোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কৃত নেতা মিখা পিরেগুকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন।

মিখা পিরেগুর জালিয়াতির তথ্য গোপনে সহযোগিতা করার অভিযোগ তুলে সংগঠনের ‘বিদ্রোহী অংশের’ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নজির আমিন চৌধুরীর সদস্য পদও স্থগিত করা হয়েছে। বিদ্রোহীদের অভিযোগ প্রতিহিংসার কারণে এমনটা করা হয়েছে।

মিখা পিরেগু কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের সহকারী সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বর্তমানে তিনি সংগঠনের ‘বিদ্রোহী অংশে’ রয়েছেন। একই কমিটির সহসভাপতির দায়িত্বে থাকা নজির আমিন চৌধুরী সম্প্রতি ছাত্র ইউনিয়নের ‘বিদ্রোহী অংশ’ ঘোষিত কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হয়েছেন। গতকাল বুধবার কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মিখাকে বহিষ্কার ও নজিরের সদস্য পদ স্থগিত করার কথা জানানো হয়।

কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের দপ্তর সম্পাদক মাহির শাহরিয়ারের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিখা পিরেগুকে ১৪ জুন কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠিয়ে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এর উত্তর দিতে বলা হয় এবং উত্তর না দিলে ওই সভায় তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি৷

স্বাক্ষর জালিয়াতি ও জালিয়াতির তথ্য গোপন করার দায়ে তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে মিখা পিরেগুকে স্বাক্ষর জালিয়াতির তথ্য গোপনে সহযোগিতা করায় কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি নজির আমিন চৌধুরীর সদস্য পদ স্থগিত করা হলো।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মিখা পিরেগুকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলে তিনি মৌখিকভাবে জানান যে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি রিভিউ আবেদন করেছেন। কেন্দ্রীয় কমিটি তাঁকে রিভিউ আবেদনের দলিল ও তাঁর নির্দোষ হওয়ার প্রমাণ দাখিল করতে বলে। কিন্তু তিনি গত চার মাসেও তা দাখিল করেননি। এই ঘটনায় তাঁকে আবার কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

অন্যদিকে ২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সংগঠনের ৪০তম জাতীয় সম্মেলনের সময় নজির আমিন চৌধুরী (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নেরও সাবেক সভাপতি) মিখা পিরেগুর অনিয়ম ও ছাত্রত্বের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে সমাধান করা হয়েছে বলে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতিকে অবহিত করেন। নজির মূলত মিখা পিরেগুকে জালিয়াতির তথ্য গোপনে সহযোগিতা করেছেন বলেই কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।

গত বছরের ২২ নভেম্বর ৪০তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে ফয়েজ উল্লাহকে সভাপতি ও দীপক শীলকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্র ইউনিয়নের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। সম্মেলনের প্রক্রিয়া নিয়ে মতবিরোধ ও নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের জেরে তখন থেকেই সংগঠনের একটি অংশ পৃথকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে থাকে। এই অংশটি তখন ‘বিদ্রোহী অংশ’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘বিদ্রোহী’ অংশের সাত নেতাকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন ফয়েজ উল্লাহ-দীপক শীলেরা। তাঁদের বিরুদ্ধে ‘সংগঠনে বিশৃঙ্খলা ও উপদলীয় তৎপরতার’ অভিযোগ তোলা হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সম্পা দাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সাখাওয়াত ফাহাদ ও সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈম। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন কমিটিও গঠন করা হয় সেদিন। এ নিয়ে গত কয়েক মাসে সংগঠনটির অন্তর্কোন্দল প্রকাশ্যে চলে আসে। দুই অংশ পৃথকভাবেই কর্মসূচি পালন করছিল।

গত ১২ এপ্রিল জরুরি সম্মেলন ডাকেন ‘বিদ্রোহীরা’। ফয়েজ-দীপকদের আমন্ত্রণ করা হলেও তাঁরা সেখানে যাননি। ‘বিদ্রোহীরা’ তখন ফয়েজ-দীপককে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল রেখে পুনর্গঠিত একটি কমিটি ঘোষণা করেছিলেন। তবে ফয়েজ-দীপকেরা ওই কমিটিকে ‘অবৈধ ও ভিত্তিহীন’ বলে আখ্যা দেন। এরপর ১৮ জুন জাতীয় পরিষদের সভা করে ১৯ জুন ফয়েজ-দীপকদের অব্যাহতি দিয়ে কমিটি পুনর্গঠিত কমিটি ঘোষণা করেন ‘বিদ্রোহীরা’। ফয়েজ একে ‘একধরনের ষড়যন্ত্র’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

এরপর গতকাল ‘বিদ্রোহী অংশের’ মিখা পিরেগুকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার ও নজির আমিন চৌধুরীর সদস্য পদ স্থগিতের ঘোষণা দিলেন ফয়েজ-দীপকেরা।

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ছাত্র ইউনিয়নের ‘বিদ্রোহী অংশ’ ঘোষিত কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈম আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিখা পিরেগু বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রিভিউ আবেদন করেছেন, যা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মূলত প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ফয়েজ উল্লাহ ও দীপক শীলেরা এসব কাজ করছেন। এটা সংগঠনের নাম ব্যবহার করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপচেষ্টামাত্র। ছাত্র ইউনিয়নের জাতীয় পরিষদ যেহেতু ফয়েজ-দীপককে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছে, ফলে তাঁদের এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে আমরা আমলেই নিচ্ছি না।’

মিখা পিরেগু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর বহিষ্কারের দাপ্তরিক আদেশ গণমাধ্যমে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ এই আদেশে সই করেন গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশেষ পরীক্ষার জন্য করা আবেদনে বিভাগীয় সভাপতির স্বাক্ষর ও সিলমোহর জালিয়াতিসংক্রান্ত গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে তাঁকে এই শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

মিখা পিরেগু তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘আমি ফটোকপি জমা দিয়েছিলাম, তাই বিভাগ অভিযোগ জানায়। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি এর বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করেছি।’

ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি ফয়েজ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মিখা পিরেগুর কাছে আমরা তাঁর রিভিউ আবেদনবিষয়ক দলিলাদি চেয়েছিলাম, তাঁকে এ জন্য সময়ও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে তা জমা দিতে পারেননি। তিনি জালিয়াতির তথ্য গোপন করেছেন। তাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের আলোকে ছাত্র ইউনিয়ন তাঁকে বহিষ্কার করেছে।’