জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করে যে বার্তা দিল আ.লীগ

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম
ফাইল ছবি

‘আউলা-বাউলা কথা কইলে ছাড় নাই। যত বড় ন্যাতা হও। কথা কইবা হিসাব করবা না, ক্যামনে হয়। তা–ও যেনতেন বিষয় না।’

রাজধানী ঢাকার এক প্রান্ত তেজতুরী বাজারে সকালের আড্ডার বিষয় ৩২ কিলোমিটার দূরের গাজীপুর। সেখানকার সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বহিষ্কার। একটি ফলের দোকানে জড়ো হয়ে শ্রমজীবী কিছু মানুষ আড্ডা দিচ্ছিলেন। তাঁদেরই একজন সোলায়মান আলী বললেন কথাটি। তিনি পেশায় নিরাপত্তা প্রহরী। বাড়ি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে। নিজেকে আওয়ামী লীগের সমর্থক দাবি করেন এই ষাটোর্ধ্ব।

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র ও গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রাতে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

জাহাঙ্গীর আলমের বহিষ্কারের পর তাঁর এলাকা গাজীপুর সিটির বিভিন্ন এলাকায় কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে উল্লাস করে। এ খবর রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব, মাঠপর্যায়ে দলটির নেতা-কর্মী, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, জাহাঙ্গীরের বহিষ্কার একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে ৭০ বছরের বেশি বয়সী দলটির অন্দরে। এই বহিষ্কারের মাধ্যমে আসলে কিছু বার্তা দেওয়া হয়েছে, যা এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন ছিল। কারণ, দলটি একটানা ক্ষমতায় আছে প্রায় এক যুগ ধরে। দলের শৃঙ্খলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু যে বঙ্গবন্ধু নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্যই এই বহিষ্কার, তা নয়। এর পেছনে আরও কিছু কারণও আছে বলে কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বলেছেন।

গত সেপ্টেম্বর মাসে গোপনে ধারণ করা মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের কথোপকথনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জেলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করা হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা অভিযোগ করেন।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ আজ শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে গুরুতর দুটি অভিযোগ ছিল। একটি হলো, আমরা যাঁর আদর্শের কর্মী, সেই জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে জাহাঙ্গীর বিভ্রান্তিকর কথা বলেছেন। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মূল চেতনার অংশ। এসব নিয়ে যারা বিতর্কিত মন্তব্য করতে পারে, তারা কখনোই দলের আদর্শের ধারক হতে পারে না। তাদের আওয়ামী লীগ করার কোনো নৈতিক অধিকার নেই।’

এর মাধ্যমে কিছু বার্তা দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি হানিফের। তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা ও আওয়ামী লীগ—এ দুয়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ কারও সঙ্গে কোনো আপস করবে না। পাশাপাশি দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কোনোমতে ছাড় দেওয়া হবে না। যার যত কাছের মানুষ, যার যত প্রিয় মানুষ হোক না কেন, সেটা দেখার বিষয় না।’

মাহবুবুল আলম মনে করেন, মাঠে এই বার্তা যাবে।

এখন চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহে বিপর্যস্ত শাসক দল। বার্তা সেখানেও আছে। গতকালের সভার সিদ্ধান্ত তুলে ধরে হানিফ বলেন, দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই ছিল। গতকাল সিদ্ধান্ত হয়েছে, যারা তাদের মদদ দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জাহাঙ্গীর আলমের বহিষ্কারের সিদ্ধান্তে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহ ঠেকাতে কতটুকু কার্যকর হবে, এখনই বলা কঠিন মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার। তাঁর কথা, ‘এ কথা বলার জন্য বেশি আগাম হয়ে যাবে। তবে এটা নিঃসন্দেহে একটি বার্তা পাঠাবে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমেই বিদ্রোহীদের দমন করা যাবে, তা মনে হয় না। এর জন্য একাধিক পদক্ষেপ লাগবে।’
তবে জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কার করা ছাড়া আওয়ামী লীগের কোনো উপায় ছিল না বলেই মনে করেন অধ্যাপক মজুমদার। তিনি বলেন, ‘জাহাঙ্গীর এমন মানুষকে নিয়ে কথা বলেছেন, সেই বঙ্গবন্ধু হলেন আওয়ামী লীগের প্রাণভ্রমরা। এরপরে তো আর কিছু বাকি থাকে না। আওয়ামী লীগকে মুখরক্ষার জন্যই জাহাঙ্গীরকে সাজা না দেওয়ার কোনো বিকল্প ছিল না।’ মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে যদি ন্যূনতম বিবেচনায় রাখা হয়, তাহলে জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারের বিকল্প আর কী হতে পারে? এগুলোই যদি অস্বীকার বা সমালোচনা করে কেউ, তবে আর কীই–বা বাকি থাকে?

অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার এ সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে দেখেন।

অধ্যাপক শান্তনু বলেন, আওয়ামী লীগে এখন অনেক নেতার দেখা মিলতে পারে, যাঁদের মধ্যে বাঙালিত্ব, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু নিয়ে নিবেদন কতটুকু আছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। জাহাঙ্গীর আটকে গেছেন, তাঁর রেকর্ডটা ফাঁস হয়ে গেছে। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে কি না জানি না, কিন্তু যা বলছেন তা মারাত্মক।

জাহাঙ্গীরকে কঠোর সাজা দিয়ে দলের অস্তিত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় না দেওয়ার কঠিন বার্তা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ দিয়েছে বলে তাঁর ধারণা। এই বার্তা মাঠে বিশৃঙ্খল দলীয় অবস্থার হাল ফেরাতে কিছুটা সহায়ক হবে বলে মনে করেন শান্তনু মজুমদার।
জাহাঙ্গীর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক শীর্ষ নেতার আশীর্বাদপুষ্ট। তাঁরা যথেষ্ট ক্ষমতাবান। দলের প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জমানার পর এসব নেতা বেশি ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। জাহাঙ্গীর ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটির নির্বাচনে দলীয় নেতা আজমতউল্লাহ খানের বিরোধিতা করেন। জাহাঙ্গীর এবং তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধাচরণ সেই পরাজয়ের কারণ হিসেবে তখন জেলা আওয়ামী লীগ এক মূল্যায়ন করেছিল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও সে কথা জানেন। কিন্তু এর জন্য জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়ইনি, বরং তাঁকে সিটি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এসবই সেই বড় নেতার প্রভাবেই হয়। এবারও জাহাঙ্গীর ভিডিও–কাণ্ডের পর সেই নেতার দ্বারস্থ হন। তাঁর যে কিছু হবে না, এমন কথা জাহাঙ্গীরের অনুসারীরা বুক ফুলিয়েই বলতে থাকেন। তবে এই ঔদ্ধত্য এবার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সহ্য করেননি।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠা কেন্দ্রের সেই নেতাকেও এবারের বহিষ্কারের মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়েছে, থামো। বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না।’

জাহাঙ্গীরকে বহিষ্কারের মাধ্যমে দল আরও গতিশীল হবে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল। তিনি বলেন, দলের নীতি–আদর্শের বিরুদ্ধে যাঁরা যাবেন, তাঁরা দলের কোনো স্থানে থাকতে পারবেন না, কোনো স্তরে তাঁদের স্থান হবে না। সুবিধাবাদী ও টাউটেরা দল থেকে দূরে থাকবে। দলের আদর্শকে যাঁরা ধারণ করবেন, তাঁরাই দলে থাকবেন, অন্যরা নয়।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি এখন শিক্ষা উপমন্ত্রী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদর্শিক এবং নৈতিক জায়গায় দুর্বলতা থাকলে দল আর ছাড় দেবে না। এর মাধ্যমে শৃঙ্খলার প্রশ্নে দলের আপসহীন অবস্থান প্রকাশ পেল।’

বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয়, গাজীপুরে স্থানীয় একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতাকে নিয়ে জাহাঙ্গীরের অযাচিত মন্তব্য তাঁকে সংগঠনের ভেতরেই বিতর্কিত করে ফেলে। আওয়ামী লীগের আদর্শের একেবারে বিপরীত অবস্থানে থাকা ধর্মভিত্তিক উগ্র কিছু দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। যদিও জাহাঙ্গীর আলম এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন বারবার। তবে এবার তাঁর বহিষ্কারে এসব বিষয় কাজ করেছে বলে জানান এক কেন্দ্রীয় নেতা।

মাঠের নেতারা যা বলছেন

গেল সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে করা জাহাঙ্গীরের মন্তব্যসংবলিত ভিডিও ভাইরাল হলে জাহাঙ্গীরের শহর গাজীপুরের ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ পায়। তাঁর সমর্থকদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীদের সংঘর্ষ হয় কয়েক দফা।

গাজীপুর নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমতউল্লাহ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কর্মীদের শান্ত রেখেছি। তাদের ধৈর্য ধরতে বলেছি। নেত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করতে বলেছি। এখন যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে। এ সিদ্ধান্তের প্রভাব গাজীপুরের সীমানা ছাড়িয়ে দেশের সর্বত্র পড়বে। দলের মূল আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন না থাকলে দল তো থাকে না।’

এ ধরনের সিদ্ধান্ত অনেক দিন থেকে আশা করছিলেন বলে জানান বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান রিপু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি দল করব আর নীতি আদর্শ মানব না, এটা হতে পারে? দল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা অসাধারণ। দলের ভেতরে এই শৃঙ্খলা রক্ষা করতে না পারলে আমাদের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। যে যত বড় নেতা হোক, এ ব্যাপারে ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই।’

রাগেবুল আহসান মনে করেন, দলের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে মাঠে এর প্রভাব পড়বে।
ভোলা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুল কাদের মজনু মোল্লার কথা, দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর জাহাঙ্গীর আলমের আর মেয়র পদে থাকার কোনো অধিকার নেই। দলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মজনু মোল্লার বলেন, ‘দলে ঘাপটি মেরে থাকা অনেকে এর মাধ্যমে বার্তা পাবে। জাতির জনককে নিয়ে কোনো কথা বলা শুধু দলগত না, রাষ্ট্রীয়ভাবেই অপরাধ। তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়াটা যুক্তিসংগত বলেই মনে করি। দলের ভেতরে ঢুকে দলে যারা বিভ্রান্তি ছড়াবে, তাদের জন্য এটা কড়া বার্তা।’