জেলায় জেলায় উড়ছে টাকা

.
.

সাধারণ ভোটারের অংশগ্রহণ নেই। তবু টাকা ওড়ার খবর উড়ছে। জেলা পরিষদ নির্বাচনে যাঁরা ভোট দেবেন, তাঁরা স্থানীয় সরকারের কোনো না কোনো স্তরের জনপ্রতিনিধি। টাকা লেনদেনের স্পর্শকাতর এই অভিযোগ তাঁদেরই বিরুদ্ধে। আবার যাঁরা অভিযোগ তুলেছেন বা টাকা ওড়াচ্ছেন, তাঁরাও জেলা পরিষদের নতুন জনপ্রতিনিধি হবেন।
কাল বুধবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম জেলা পরিষদ নির্বাচন। চেয়ারম্যান পদে দলের সমর্থন পেতে ৬১ জেলায় ৭০১ জন আওয়ামী লীগ নেতা আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ২২ জেলায় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীর বাইরে আর কোনো প্রার্থী নেই। ফলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁদের চেয়ারম্যান হওয়াটা নিশ্চিত। ওই সব জেলায় এখন সদস্য প্রার্থীদের অনেকেই টাকা ছড়াচ্ছেন।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬১ জেলার মধ্যে অন্তত ৩০ জেলায় আওয়ামী লীগের নেতারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন। এমন প্রার্থীর সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। ওই সব জেলায় মূলত টাকা ছড়ানো ও উপহার দেওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত একাধিক প্রার্থী থাকা এলাকায় বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা অন্য দলের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কদর বেশ বেড়েছে। কারণ, তাঁরাও এই নির্বাচনে ভোটার। এই ভোটারদের কাছে টানতে টাকা, উপহার, প্রলোভন, অনুরোধ ও ভয় থেকে শুরু করে নানা রকম চেষ্টা চলছে এলাকাভেদে।
প্রথম আলোর আঞ্চলিক কার্যালয়, নিজস্ব প্রতিবেদকপ্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচন ঘিরে ভয়, চাপ ও অনুরোধের পাশাপাশি টাকাও উড়ছে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ১২টির বেশি জেলায় গত রবি ও গতকাল সোমবার খোঁজখবর নিয়ে এ-সংক্রান্ত তথ্য ও অভিযোগ পাওয়া যায়। জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে অভিযোগ জমা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের বেশির ভাগ অভিযোগ করছেন সরকারদলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন-সংক্রান্ত অভিযোগগুলো জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা হওয়ার কথা। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জমা হলে তা পড়ে থাকার কথা নয়।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচন ঘিরে টাকা লেনদেনের যেসব খবর আসছে, তা দুঃখজনক ও নিন্দনীয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ভোটার সংখ্যা কম হলে ভোট কেনাবেচা হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই নির্বাচনে পেশিশক্তির বিষয় যেহেতু নেই, সেহেতু ভোট কেনাবেচা হবে এবং টাকাপয়সার একটা ভূমিকা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।

ভোট কেনাবেচা নিয়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া: ময়মনসিংহের নান্দাইলে প্রতিদ্বন্দ্বী এক প্রার্থীর পক্ষে ভোট কেনাবেচার অভিযোগ উঠেছে। খবর পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর লোকজন প্রতিরোধ করতে গেলে সেখানে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গত রোববার দিবাগত মধ্যরাতের পর নান্দাইল শহরের চণ্ডীপাশা মহল্লায় অবস্থিত একটি বাসা ও এর আশপাশে এ ঘটনা ঘটে।

মহল্লার একাধিক বাসিন্দা গতকাল সকালে বলেন, শহরের পল্লী বিদ্যুৎ​ কার্যালয় ভবনের তিনতলার ভাড়াটে হচ্ছেন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বড়িহিত ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. খসরু মিয়া। ওই বাসায় আয়োজন করা হয় কথিত গোপন বৈঠকটি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসানসহ কয়েকজন ইউপি সদস্য। বৈঠক চলার সময় সেখানে হাজির হন জেলা পরিষদের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের (ঈশ্বরগঞ্জ) সদস্য প্রার্থী মো. দুলাল ভূঁইয়া। তিনি সেখানে গিয়ে মাহমুদ হাসানের বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে ভোট কেনার অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ করতে থাকেন। তাঁর সমর্থকেরাও বাসার নিচতলায় হইচই করতে থাকেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ থেকে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়।

খবর পেয়ে নান্দাইল মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আতাউর রহমান ওই বাসায় যান। পুলিশ উপজেলা চেয়ারম্যানকে নিরাপত্তা দিয়ে ঈশ্বরগঞ্জে পৌঁছে দেন। মাহমুদ হাসান মুঠোফোনে বলেন, তিনি একজন নারী প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচার চালাতে নান্দাইল গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছু লোক তাঁকে বাধা দিয়েছেন। কোনো গোপন বৈঠক বা ভোট কেনাবেচার কথা তাঁর জানা নেই।

প্রার্থী মো. দুলাল ভূঁইয়ার দাবি, গোপন বৈঠকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে ভোট কিনছিলেন মাহমুদ হাসান। তিনি বলেন, মাইজবাগ ইউপি সদস্য মো. রফিকুল ইসলাম টাকা নিয়ে চাপের মুখে তা ফেরত দিয়েছেন। অবশ্য রফিকুল ইসলাম টাকা নেওয়ার কথা মুঠোফোনে স্বীকার করলেও উপজেলা চেয়ারম্যান তাঁকে টাকা দেননি বলে জানান।

টাকা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস: খুলনা জেলা পরিষদ নির্বাচনে একদিকে টাকা উড়ছে, অন্যদিকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ১৪ ডিসেম্বর ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে জেলা পরিষদের সদস্য প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা খান বলেন, ‘খুলনা জেলা পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমানে প্রধান আলোচ্য বিষয় টাকা, টাকা, টাকা। কোন প্রার্থী কত দেবে আর কোন প্ল্যানে কত ধরা যাবে, এ নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। অন্য দুই সদস্য প্রার্থী টাকা ছড়াচ্ছে আর চালনার কতিপয় ব্যক্তি টাকা ধরার জন্য সবচেয়ে বেশি ছোটাছুটি করছে।’

এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে গোলাম মোস্তফা খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল হোসেন সদস্য প্রার্থী কবির হোসেন খাঁকে নিয়ে বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদে যাচ্ছেন। চেয়ারম্যানের মাধ্যমে মেম্বারদের ডেকে সভা করে ভোট দেওয়ার জন্য চাপাচাপি করছেন। ভোট দিলে ভোটারদের ১ টন চাল ও ৩০ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে।’

এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল হোসেন বলেন, ‘কবির হোসেনের পক্ষে কাজ করলেও চাল বা টাকা দেওয়ার অভিযোগ অপপ্রচার ছাড়া আর কিছুই নয়।’ আবুল হোসেন পাল্টা অভিযোগ করেন, সদস্য প্রার্থী জালালউদ্দীন গাজী খুলনায় বসে ৬০ হাজার টাকা করে প্রতিটি ভোট কিনছেন।

জানতে চাইলে জালালউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান নিজ থেকে ভোটারদের কবির খানের পক্ষে টাকা দিচ্ছেন। সেখানে আমাদের নির্বাচন করার সুযোগ থাকে কীভাবে?’ তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, কোন ভরসায় তিনি ভোটারদের টাকা দেবেন?

চাঁদপুরে টাকা ও শপথ: চাঁদপুরে চেয়ারম্যান ও সদস্য প্রার্থীরা নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। কোনো কোনো প্রার্থী বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা ছাড়ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সদস্য প্রার্থী মো. খুরশিদ আলম অভিযোগ করেন, হাইমচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুর হোসেন পাটোয়ারি সদস্য প্রার্থী মাকসুদ আলমের পক্ষে ভোটারদের ২০ হাজার টাকা দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ করাচ্ছেন। অভিযোগের বিষয়ে নুর হোসেন পাটোয়ারির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি এবং ফোন কেটে দেন।

মন্ত্রী-সাংসদেরা প্রার্থীদের পক্ষ নেওয়ায় ওই জেলায় নির্বাচনী প্রচার জমজমাট হয়ে উঠেছে। সেখানে প্রকাশ্যে টাকা লেনদেনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তোলা হচ্ছে।

টাকা ছড়ানোর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ: সুনামগঞ্জে চেয়ারম্যান পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা দুই প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ করেছেন। সেখানে একদিকে আছেন জেলার সরকারদলীয় সাংসদেরা, যাঁদের প্রার্থী এম এনামুল কবীর। অন্যদিকে আছেন আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি মতিউর রহমানসহ জেলার প্রভাবশালী নেতারা, যাঁদের সমর্থন পাচ্ছেন দলের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা।

এনামুল কবীর অভিযোগ করে বলেন, ‘শুরু থেকেই আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকেরা টাকার খেলা শুরু করেছেন। তাঁরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করছেন, এর মাধ্যমে তাঁদের অসম্মানিত করা হচ্ছে।’

তবে নুরুল হুদা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘আমরা নই, টাকা বিতরণ করছেন এনামুল কবির ও তাঁর সমর্থকেরা।’ নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, একজন সাংসদ ভোটারদের বাড়িতে ডেকে এনে তাঁদের হাতে খাম ধরিয়ে দিচ্ছেন, কাউকে আবার হুমকি দিচ্ছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা এসব বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি।’

সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ফাওজুল করিম খান বলেন, ‘আমরা টাকা বিতরণের বিষয়ে কারও বিরুদ্ধে লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে মৌখিকভাবে কেউ কেউ বিষয়টি আমাদের বলেছেন।’

চেয়ারম্যানদের রেট বেশি, সদস্যদের কম: মানিকগঞ্জে ভোটাররা দুই পক্ষের টাকা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। চেয়ারম্যান পদে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যেমন টাকা দিচ্ছেন, তেমনি সদস্য প্রার্থীরাও টাকা দিচ্ছেন।

গত দুই দিনে অন্তত ১০ জন ভোটারের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া গেছে, ১০ হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত লেনদেন করছেন চেয়ারম্যান প্রার্থীরা। এ ছাড়া সদস্য প্রার্থীরা ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিচ্ছেন প্রত্যেক ভোটারকে। ইউপি সদস্যদের চেয়ে চেয়ারম্যানদের ভোটের মূল্য বেশি হওয়ায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলে বলছেন, প্রত্যেক ভোটের মূল্য সমান হলে চেয়ারম্যানকে কেন বেশি দেওয়া হচ্ছে?

বেতিলা-মিতরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক সদস্য বলেন, ‘দুই প্রার্থীর পক্ষ থেকে টাকা নিয়েছি। নিতে বাধ্য হয়েছি। নইলে মনে করবে ভোট দেব না।’

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দলের সমর্থিত প্রার্থী গোলাম মহীউদ্দিন ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী রমজান আলী সেখানে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। সাবেক সাংসদ ও চেয়ারম্যান প্রার্থী মফিজুল ইসলাম খান বলেন, ‘গোলাম মহিউদ্দিন ও রমজান আলী দুজনই টাকা দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন, এটা কমবেশি সবাই জানে।’

তবে এই অভিযোগ দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী অস্বীকার করে দুজনই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেন। গোলাম মহীউদ্দিন বলেন, টাকা দিয়ে ভোট পাওয়া যায় না। তারপরও রমজান আলী ভোটারদের সঙ্গে লেনদেন করছেন বলে গুঞ্জন আছে।

অভিযোগ অস্বীকার করে রমজান আলী বলেন, ‘গোলাম মহীউদ্দিন ও একজন সাংসদ ভোটারদের ডেকে নিয়ে টাকা দিচ্ছেন। এ বিষয় নিয়ে আমি রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি।’

বরগুনায় সদস্য প্রার্থীরা টাকা ওড়াচ্ছেন: বরগুনায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন আবুল হোসেন খান নামে এক সদস্য প্রার্থী। তিনি অভিযোগ করেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পান্না হাওলাদার ও তাঁর ছোট ভাই চেয়ারম্যান কবির হাওলাদার ভোটারদের টাকা দিচ্ছেন।

তবে পান্না হাওলাদার বলেন, ‘আমি ভোট কিনছি না। বরং আবুল হোসেন খান শহরের একটি হোটেলে তিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ভূরিভোজ করিয়ে ভোট কেনার চেষ্টা করেছেন।’

সদস্য প্রার্থী ফজলুল হক জমাদ্দার অভিযোগ করেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সুজন ফরাজীর বাবা সোনাকাটা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইউনুস ফরাজী বিপুল অর্থবিত্তের মালিক। তিনি ছেলের জন্য ভোট কিনছেন। তবে ইউনুস ফরাজী বলেছেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়।

আমতলী উপজেলার এক ইউপি সদস্য পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, একজন সদস্য প্রার্থী তাঁকে একটি মোটরসাইকেল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পচাকোড়ালিয়া ইউনিয়নের আরেক ইউপি সদস্য বলেন, ‘ভোট দিলে এক সদস্য প্রার্থী আমাকে শপথ করে এক লাখ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।’

রিলিফের চাল উপহার: বগুড়া জেলা পরিষদ নির্বাচনে টেস্ট রিলিফের চাল উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ উঠেছে বগুড়া-৪ আসনের সাংসদ এবং জেলা জাসদের সভাপতি এ কে এম রেজাউল করিম তানসেনের বিরুদ্ধে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও নন্দীগ্রাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহিদুর রহমানের অভিযোগ, রেজাউল করিম আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ভোটারদের তাঁর বাসায় ডেকে নিয়ে গিয়ে টিআর কর্মসূচির ৫ থেকে ১০ টন পর্যন্ত চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। বিনিময়ে তিনি ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী ছোট ভাই ও নন্দীগ্রাম উপজেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান রুস্তমের পক্ষে ভোট চাইছেন।

সাংসদের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর বিষয়ে বগুড়া জেলা প্রশাসক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন জাহিদুর রহমান।

তবে জাসদ নেতা মাহবুবুর রহমান পাল্টা অভিযোগ করে বলেছেন, জাহিদুর রহমান নিজেই টাকা ছিটিয়ে ভোট কেনার চেষ্টা করছেন। জাহিদুর রহমানের পক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা তাঁর কার্যালয়ে ভোটারদের ডেকে নিয়ে জনপ্রতি ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা ভরা খাম প্রত্যেকের হাতে তুলে দিচ্ছেন।

জাহিদুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘ভোটারদের টাকা দেওয়ার মতো অর্থ আমার নেই। আর আমার জন্য জেলার কোনো নেতা ভোটারদের টাকা দেবে, তা অবিশ্বাস্য।’

সাংসদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা পরিষদ নির্বাচনে আমার ভাই সদস্য প্রার্থী হওয়ায় তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী এলাকায় যাইনি। কোনো ভোটারকে বাসায় ডেকে আনার অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

বগুড়ার জেলা প্রশাসক মো. আশরাফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে টাকা ছড়ানোসহ নানাভাবে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে দুই থেকে তিনজন প্রার্থী তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের পাঠানো হয়েছে।

টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ: ঝিনাইদহে দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর বিরুদ্ধে টাকা দিয়ে ভোট কেনা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী কনক কান্তি দাসের বিরুদ্ধে জাপা-সমর্থিত প্রার্থী এম হারুন অর রশিদ আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছেন। তবে কনক কান্তির অভিযোগ, হারুন টাকা দিয়ে ভোট কিনছেন। আরেক শরিক দল জাসদ (ইনু) সমর্থিত প্রার্থী এমদাদুল হকের দাবি, তাঁরা উভয়ই ভোটের পরিবেশ নষ্ট করছেন।

আওয়ামী লীগ-সমর্থক প্রার্থী কনক কান্তি দাস অভিযোগ করেন, জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার সিমলা-রোকনপুর ইউনিয়নের দুজন ভোটারকে টাকা দেওয়া হয়েছে, যা তাঁরা লিখিতভাবে স্বীকার করেছেন। টাকার পাশাপাশি ভোটের পরে সৃজনী বাংলাদেশ নামে এনজিওতে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

অপরদিকে হারুন অর রশিদ অভিযোগ করেছেন, কনক কান্তি দাস তাঁর লোকজন দিয়ে প্রায়ই আনারস প্রতীকের কর্মীদের হয়রানি করছেন। বেশ কয়েক স্থানে তাঁর কর্মীদের মারপিট করা হয়েছে। হারুন বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে টাকা দিয়ে ভোট কেনার যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

কনক কান্তি দাস বলেন, তাঁর কর্মীরা কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন।

টাকা আর ভয় দিয়ে জয়ের চেষ্টা: নরসিংদী জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ও দলটির বিদ্রোহী প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে ভোটারদের মধ্যে টাকা বিতরণ, ভীতি প্রদর্শন ও প্রলোভন দেখানোর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছেন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী আসাদুজ্জামান গতকাল জেলা আইনজীবী সমিতি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ করেন। আবার দলটির বিদ্রোহী আব্দুল মতিন ভূঞাও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেন।

শেরপুরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার পাল বিদ্রোহী প্রার্থী হুমায়ুন কবীরের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ কালোটাকা ছড়ানো, সাম্প্রদায়িক উসকানি ও ভোটারদের অস্ত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ করেছেন। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া লিখিত অভিযোগ ও সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

হুমায়ুন এই অভিযোগ অস্বীকার করে হুইপ আতিউর রহমানের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে চন্দনের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণ এবং বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও সদস্যদের টিআর, জিআর ও কাবিখাসহ নগদ অর্থ অনুদানের আশ্বাস দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। অবশ্য হুইপ আতিউর এগুলোকে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন।

লক্ষ্মীপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে সদস্য প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মঞ্জুর হোসেন সুমন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শফিকুর রহমানের পক্ষে ভোটারদের টাকা দেওয়া হচ্ছে। তবে উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান খান বলেন, টাকা বিলির অভিযোগ সঠিক নয়।

কুমিল্লায় সদস্য প্রার্থীরা সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিচ্ছেন। তবে চেয়ারম্যান পদে ভোট কেনাবেচার খবর পাওয়া যায়নি। বরুড়া উপজেলার একজন ইউপি সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এ পর্যন্ত তিন প্রার্থীর কাছ থেকে যথাক্রমে ৫ হাজার, ১ হাজার ও ৫০০ টাকা করে মোট সাড়ে ৬ হাজার টাকা পেয়েছি।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনের সংস্কৃতিটাই এমন হয়েছে যে প্রার্থী হওয়া, ভোট পাওয়া বা নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে টাকাপয়সা একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্বাচনকে মুনাফা বা সুবিধা অর্জনের উপায় হিসেবে দেখা হয়। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা নির্বাচনের প্রায় সবক্ষেত্রে বিদ্যমান, যদিও এসবের মধ্যে নারায়ণগঞ্জ একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল। তাঁর মতে, এ ধরনের ঘটনা নির্বাচনের আচরণবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এটা প্রতিরোধে সরকার, প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকা থাকা দরকার।

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা)