নানামুখী চাপ, স্বস্তিতে নেই ধর্মভিত্তিক দলগুলো

হেফাজতে ইসলাম কোণঠাসা হওয়ায় এর প্রভাব পড়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর ওপর। সবচেয়ে বেশি চাপে পড়ে বিএনপি–জোটের শরিকেরা।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ

করোনা পরিস্থিতির কারণে দেড় বছর ধরে এমনিতেই মাঠের রাজনীতি নেই। তারপরও নানামুখী চাপে স্বস্তিতে নেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো। বিশেষ করে গত মার্চে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতার ঘটনায় ব্যাপক ধরপাকড়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে হেফাজতে ইসলাম। যার প্রভাব পড়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আর জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশ্যে নেই।

সংশ্লিষ্ট দলগুলোর দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরবিরোধী বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনায় প্রায় এক হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাঁদের বেশির ভাগই ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতা-কর্মী ও সমর্থক। এর ফলে বেশি চাপে পড়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের শরিক ইসলামপন্থী দলগুলো।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ধর্মভিত্তিক দল ও কওমি মাদ্রাসার আলেমদের একটি অংশের এখন প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলা। এঁদের কেউ মামলা থেকে বাঁচতে, আবার কেউ নিজের প্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থল থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কায় বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিচ্ছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাম্প্রতিক ধরপাকড়ে বেশি চাপে পড়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ তিনটি দল। অন্য দুটি দল হলো প্রয়াত শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস। সম্প্রতি দল তিনটির মহাসচিবসহ শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেপ্তার হন। এর বাইরে প্রয়াত মুফতি ফজলুল হক আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোটের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা এবং দলটির ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কিছু নেতা-কর্মীকেও গ্রেপ্তার করা হয়; যাঁরা হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

দৃষ্টান্ত জমিয়ত

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর একাধিক নেতা জানান, এই সময়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলো কতটা সংকটে আছে, তার দৃষ্টান্ত জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের বিএনপির জোট ছাড়ার ঘটনা। গত ১৪ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সচিবালয়ে দেখা করে আসার কয়েক ঘণ্টা পর দলটি জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে জোট ছাড়ার ঘোষণা দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে সহিংসতার মামলায় জমিয়তের ৬০ জন নেতা-কর্মী আসামি হন। এ পরিস্থিতিই দলটিকে জোট ছাড়তে বাধ্য করেছে।

এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় নায়েব আমির আবদুর রব ইউসুফী প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটা কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে আমাদের।’

জমিয়তের বিএনপি–জোট ছাড়ার পরপর এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো তাদের (জমিয়ত) জোট ছাড়তে বলিনি। তাদের ভালো লাগেনি তারা ছেড়েছে, এটা তাদের ব্যাপার। এর সঙ্গে সরকারের কোনো যোগসূত্র নেই। তারা এসেছিল তাদের কিছু ব্যাপার নিয়ে।’

জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বাহাউদ্দিন জাকারিয়া গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের যে ৬০ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়, তাঁদের মধ্যে ৩১ জন গ্রেপ্তার হন। ইতিমধ্যে ১৭ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

সরকারের সঙ্গেই বেশি

দেশে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইসলামপন্থী দলের সংখ্যা ১০। নিবন্ধিত ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে এখন বিএনপি জোটে আছে কেবল মুহাম্মদ ইসহাক ও আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস। এর বাইরে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট (আবদুর রকিব) ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (মনসুরুল হাসান) আরেকটি অংশ ২০-দলীয় জোটে থাকলেও তাদের নিবন্ধন নেই।

অন্যদিকে নিবন্ধিত ইসলামপন্থী অন্য দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক। এ ছাড়া ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ (বাহাদুর শাহ), বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট (মান্নান) ও জাকের পার্টিও সরকারের সঙ্গে আছে। এর বাইরে বিএনপির জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়া মুফতি আমিনীর দল ইসলামী ঐক্যজোট ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস সরকারঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। যদিও সম্প্রতি মাওলানা মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের পর সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

প্রয়াত শায়খুল হাদিসের ছেলে মামুনুল হক বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের আগের কমিটির যুগ্ম মহাসচিব। গ্রেপ্তারের পর মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা হয়েছে। তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন মোহাম্মদপুর জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসাও সম্প্রতি হাতছাড়া হয়ে গেছে। এখন মামুনুল হককে রাজনীতিতে আর না জড়ানোর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে দলীয় সূত্র জানা গেছে।

এ ছাড়া প্রয়াত হাফেজ্জী হুজুরের দল বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনও সরকারের সঙ্গে সখ্য রেখে চলছে বলে দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়। এর বাইরে নিবন্ধিত ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন কোনো জোটে নেই।

সামগ্রিকভাবে সবাই চাপে আছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইসলামি দলগুলো নজরদারিতে আছে। এটা আমাদের জন্য বড় সংকট।
গাজী আতাউর রহমান, সহকারী মহাসচিব, ইসলামী আন্দোলন

জামায়াতের ‘পীড়া’ এবি পার্টি

প্রায় এক দশক ধরে প্রকাশ্য রাজনীতিতে নেই জামায়াতে ইসলামী। জানা গেছে, দেড় বছর ধরে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে অনলাইনে। নেতারা প্রায় প্রতিদিনই অনলাইনে ভার্চ্যুয়াল সভা করছেন। এই মুহূর্তে দলের রুকন সম্মেলন চলছে।

তবে জামায়াতের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, নানা উপায়ে দলের নিয়মিত কাজগুলো চললেও সরকারি বাধা-বিপত্তির মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের। সর্বশেষ গত এক সপ্তাহে নতুন করে গ্রেপ্তার হন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারসহ ১৫ জন নেতা।

এর মধ্যে জামায়াতের জন্য নতুন পীড়ার কারণ হয়ে উঠেছে এবি পার্টি (আমার বাংলাদেশ পার্টি)। কারণ, দলের মাঠপর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান নেতা, কর্মী ও সমর্থকদের একটি অংশ এবি পার্টিতে যুক্ত হচ্ছেন। জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৪১ জেলায় কমিটি গঠন করেছে এবি পার্টি। কমিটির প্রায় ৬০ শতাংশ সদস্যই জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির থেকে এসেছেন।

এ বিষয়ে এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান (মঞ্জু) প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দলে বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীরা আসছেন, আবার রাজনীতি করেন না এমন লোকেরাও আসছেন। তবে আমি যেহেতু একটা দলে ছিলাম, সে কারণে আমার বন্ধুবান্ধব ওই দিকে একটু বেশি। তাই আমাদের আহ্বানের সাড়া তো সেদিকে একটু বেশি পড়বেই।’

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দলের ভূমিকাসহ কিছু বিষয়ে ভিন্ন অবস্থান নিয়ে জামায়াতের একদল নেতা-কর্মী গত বছরের ২ মে এবি পার্টি গঠন করে। দলটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য চেষ্টা করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এবি পার্টিকে চাপে রাখতে জামায়াতও সময়-সময় নানা কৌশল নিচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে এবি পার্টির তিন সংগঠক আবদুল কাদের, জাহাঙ্গীর চৌধুরী ও রেজাউল করিমকে আবার দলে নিয়েছে জামায়াত। অবশ্য এবি পার্টি নিয়ে জামায়াত এখনো প্রকাশ্যে কিছু বলেনি। এর মধ্যে গত শুক্রবার এবি পার্টির ৯ জন নেতা যোগ দিয়েছেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টিতে।

মাঠে ইসলামী আন্দোলন

ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে সারা বছরেই নানা বিষয়ে সক্রিয় চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন। তারা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে অংশ নিচ্ছে। যদিও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলটি কোনো উপনির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদের প্রথম ধাপের ২০৪টির মধ্যে ১৪০টিতে তারা প্রার্থী দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটিতে তারা জিতেছে। দলটির অভিযোগ, ক্ষমতাসীনদের বাধায় তারা ৬৪টি ইউনিয়নে প্রার্থী দিতে পারেনি।

ইসলামী আন্দোলনের সহকারী মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে সবাই চাপে আছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইসলামি দলগুলো নজরদারিতে আছে। এটা আমাদের জন্য বড় সংকট।’

ইসলামী আন্দোলনের নেতারা জানান, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় এখন মাঠে সরকারি দলের প্রতিপক্ষ হয়ে পড়েছেন তাঁরা। ফলে বিএনপির চাপ এখন পুরোটা পড়ছে ইসলামী আন্দোলনের ওপর। দলটি এখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফনসহ ত্রাণ সহযোগিতা নিয়ে কাজ করছে। এ ছাড়া দলের আমির সৈয়দ রেজাউল করীম ও নায়েবে আমির সৈয়দ ফয়জুল করীম বর্ষপঞ্জি ধরে সারা দেশে সাংগঠনিক সফর ও মাহফিল করে থাকেন।

অবস্থান হারিয়েছে ইসলামী ঐক্যজোট

একসময় কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে প্রভাবশালী ছিল মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট। এখন কওমি অঙ্গনে দলটি আগের অবস্থানে নেই। এমনকি শাহ আহমদ শফীর মুত্যুর পর হেফাজতে ইসলামের কমিটি নিয়ে বিরোধ সৃষ্টির কারণে মূল ধারার আলেমদের সঙ্গেও দলটির দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

মুফতি আমিনীর মৃত্যুর পর ইসলামী ঐক্যজোট ২০১৬ সালে বিএনপির জোট থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর দলের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন আবদুল লতিফ নেজামী। তিনি গত মে মাসে মারা যান। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, নীতিনির্ধারণী পর্ষদের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়াই মুফতি আমিনীর ছেলে আবুল হাসনাত আমিনীকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। যদিও গত এক বছরে দলের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার কোনো সভা হয়নি।

ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ দাবি করেন, শুরার সর্বসম্মত অনুমোদনে হাসনাতকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে যতটুকু কার্যক্রম থাকা দরকার, ততটুকু কার্যক্রম তাঁদের আছে।

দলটির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, মুফতি আমিনীর মৃত্যুর পর অন্তর্দ্বন্দ্ব, পারিবারিক বিরোধসহ নানামুখী বিতর্কে ইসলামী ঐক্যজোটে সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। দলের বিভিন্ন পদে থাকা তিন ভগ্নিপতি জোবায়ের আহমদ, জসিম উদ্দিন ও সাখাওয়াত হোসাইনের (রাজী) সঙ্গে হাসনাত আমিনীর নানা বিষয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। এরই মধ্যে সহিংসতার মামলায় আসামি হয়ে জোবায়ের আহমদ ও সাখাওয়াত হোসাইন কারাবন্দী এবং জসিম উদ্দিন আত্মগোপনে আছেন। সম্প্রতি তাঁদের লালবাগের জামিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক পদ থেকেও বাদ দেওয়া হয়েছে।

ইসলামবিষয়ক লেখক ও গবেষক শরীফ মুহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, বিরাজমান সংকট এবং বারবার ধাক্কায় ইসলামি দলগুলোর বর্তমান যে দৃশ্যপট, তাতে এর বাহ্যিক দিকটি হতাশার। তবে এ পরিস্থিতি কেবল ইসলামি দলগুলোরই নয়, সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের একই অবস্থা।