নির্বাচনে আ.লীগের ৬৯১ ‘বিদ্রোহী’

আওয়ামী লীগ মনোনীত ৭৬ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আছেন ১০১ জন।

  • বিএনপি দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও ৩১১ জন নেতা-কর্মী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনের মাঠে আছেন।

  • নির্বাচনী লড়াইয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আছেন ১০১ জন।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন
প্রতীকী ছবি

দ্বিতীয় ধাপে সারা দেশে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৯৪৬ জন ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন মাত্র ২৫৫ জন মনোনয়ন প্রত্যাহার করেছেন। বাকি ৬৯১ জন বিদ্রোহীই নির্বাচনে রয়ে গেলেন। অর্থাৎ বিদ্রোহী প্রার্থীদের ৭৩ শতাংশই নির্বাচনী লড়াইয়ে আছেন।

আর প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী না থাকায় ও বিদ্রোহী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ১৯ জেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত ৭৬ জন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।

বিএনপি দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও দলটির ৩১১ জন নেতা-কর্মী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনের মাঠে আছেন। আর নির্বাচনী লড়াইয়ে জাতীয় পার্টির প্রার্থী আছেন ১০১ জন। ইউপি নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে গতকাল প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা এই তথ্য পেয়েছেন।

দ্বিতীয় ধাপে ৮৪৮টি ইউপির প্রায় সব কটিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তাঁরা স্বতন্ত্র হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও মূলত আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিপরীতে বিদ্রোহী প্রার্থীর ভূমিকায় আছেন। এই বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সাংসদের স্বজন গতকাল পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাহার করেননি। আবার জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের কমিটিতে থাকা নেতাদের অনেকে বিদ্রোহী হিসেবে এখনো নির্বাচন করছেন।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ১৭ অক্টোবর ছিল মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল গতকাল ২৬ অক্টোবর, প্রতীক বরাদ্দ হবে আজ ২৭ অক্টোবর। প্রথম ধাপে স্থগিত থাকা ১৬০টি ইউপিতে ভোট হয় গত ২০ সেপ্টেম্বর। প্রথম ধাপের ওই নির্বাচনে ১১৯টিতে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা।

বিদ্রোহীরা এখনো বহাল তবিয়তে

গাজীপুরে ১১টি ইউপিতে নির্বাচন হচ্ছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন ১০টিতে। গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন তাঁরা কেউ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ করে যদি কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হয়, তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

একইভাবে মুন্সিগঞ্জের ১২ বিদ্রোহীর কেউ তাঁদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। দিনাজপুরের ছয় বিদ্রোহীর ছয়জনই নির্বাচনে লড়াইয়ে আছেন। পঞ্চগড়ের সাত ইউপিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন আটজন। গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে তাঁদের একজনও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। ভোলাতেও ছয় বিদ্রোহী প্রার্থীর সবাই আছেন নির্বাচনে।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার কলমা ইউনিয়নে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন স্থানীয় সাংসদ ওমর ফারুক চৌধুরীর চাচাতো ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খাদেমুন্নবী চৌধুরী। গতকাল তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি।

জানতে চাইলে খাদেমুন্নবী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, তৃণমূলের চাপেই তাঁকে প্রার্থী হতে হয়েছে। তাঁদের কারণেই তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে পারেননি। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার ব্যাপারে তিনি বলেন, তাঁর বিশ্বাস, নেত্রীর কাছে তাঁর নাম পৌঁছেনি। নাম পৌঁছালে অবশ্যই তিনি মনোনয়ন পেতেন।

দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে জাতীয় সংসদের হুইপ মো. আতিউর রহমানের বড় ভাই মো. ইসমাইল হোসেন বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন শেরপুর সদর উপজেলার কামারিয়া ইউপি থেকে। গতকাল তিনিও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। ইসমাইল হোসেন বলেন, তিনি একজন কৃষক। তিনি জনগণের সেবা করার জন্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন।

শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক চন্দন কুমার পাল বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যাঁরা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন, কেন্দ্রীয় নির্দেশনানুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের পথে ৭৬ জন

৮৪৮ ইউপির মধ্যে ৭৮টিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। অন্য কোনো প্রার্থী না থাকায় ও বিদ্রোহী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে চলেছেন। বিনা ভোটে সবচেয়ে বেশি ২১ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম থেকে।

এর মধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার ১৬ ইউপির মধ্যে ১৩টিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা নির্বাচিত হচ্ছেন। তাঁরা হলেন করেরহাটে এনায়েত হোসেন, হিঙ্গুলীতে সোনা মিয়া, মিঠানলায় এম এ কাশেম, জোরারগঞ্জে মো. রেজাউল করিম, ধুম ইউনিয়নে এ কে এম আবুল খায়ের ভূইয়া, ওছমানপুরে মফিজ উদ্দিন, দুর্গাপুরে আবু সুফিয়ান, কাটাছড়ায় রেজাউল করিম হুমায়ুন, মায়ানীতে কবির আহমেদ নিজামী, হাইতকান্দিতে জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী, মঘাদিয়ায় জাহাঙ্গীর হোসেন, হেরখালীতে কামরুল হায়দার চৌধুরী ও ওয়াহেদপুরে ফজলুল কবির।

শেষ দিন মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়া মিরসরাইয়ের মিঠানলা ইউপির বিদ্রোহী প্রার্থী আবু তাহের ভূইয়া বলেন, ‘দলের নেতাদের অনুরোধে আমি আমার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছি।’

ফটিকছড়ি উপজেলায় ১৪ ইউপির মধ্যে ৩টিতে বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন চেয়ারম্যান প্রার্থী। তাঁরা হলেন লেলাংয়ে সরোয়ার হোসেন চৌধুরী, বক্তপুরে মো. সোলায়মান ও আবদুল্লাহপুরে ওহিদুল আলম। সীতাকুণ্ড উপজেলায় ৯টি ইউপির মধ্যে সৈয়দপুরে এইচ এম তাজুল ইসলাম নিজামী, মুরাদপুরে এস এম রেজাউল করিম, কুমিরায় মোরশেদ হোসেন চৌধুরী, সোনাইছড়িতে মনির আহমেদ ও ভাটিয়ারীতে নাজিম উদ্দিন নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।

বরিশালের আগৈলঝাড়ার পাঁচ ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে ১২ প্রার্থীর মধ্যে গতকাল আওয়ামী লীগের পাঁচ প্রার্থী ছাড়া সবাই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। ফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হতে চলেছেন।

সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগৈলঝাড়ার রাজিহার, গৈলা, রত্নপুর, বাকাল ও বাগধা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী ছাড়া আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তাই আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের দলীয় প্রার্থী রাজিহার ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ইলিয়াস তালুকদার, বাকাল ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান বিপুল দাস, বাগধার বর্তমান চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম ওরফে বাবুল ভাট্টি, গৈলার বর্তমান চেয়ারম্যান শফিকুল হোসেন ও রত্নপুরের বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা সরদার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন।

কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায় তিন ইউনিয়নে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। এই তিনজন হলেন হালিমপুর ইউপির মো. রাসেল, বলিয়ারদির আবুল কাসেম ও মাইজচরের তাবারক মিয়া।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার দুটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের মনোনীত দুই প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। দুই প্রার্থী হলেন চন্দ্রপুর ইউনিয়নের আবদুস সালাম খান ও চিতলিয়া ইউনিয়নে হারুন অর রশিদ।

লাকসামে সদস্য পদেও বিনা ভোটে সবাই জয়ী

পাঁচ চেয়ারম্যানের পর এবার কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার আজগরা, উত্তরদা, লাকসাম পূর্ব, গোবিন্দপুর, কান্দিরপাড় ইউনিয়নের ৪৫টি ওয়ার্ডের ৬০ জন সাধারণ সদস্য এবং সংরক্ষিত নারী সদস্যও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের পর আর কোনো প্রার্থী না থাকায় তাঁরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের পাঁচ প্রার্থী বিনা ভোটে নির্বাচিত হন।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের নির্বাচনী এলাকা লাকসাম। লাকসাম উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা রাজিবুল করিম বলেন, ৪৫টি ওয়ার্ডে সাধারণ সদস্য পদে ৪৬ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন। সংরক্ষিত ১৫টি ওয়ার্ডে ১৫ জন নারী মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর মধ্যে উত্তরদা ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ সদস্য পদে দুজন প্রার্থী হন। তাঁরা হলেন জুনায়েদ আহমেদ ও আবুল কাসেম ফারুকী। গতকাল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে ফারুকী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এ অবস্থায় এই ওয়ার্ডে আর কোনো প্রার্থী না থাকায় জুনায়েদ আহমেদও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন।

কুমিল্লা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মঞ্জুরুল আলম বলেন, বুধবার (আজ) প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে। দ্বিতীয় ধাপে ১১ নভেম্বর তিতাস ও মেঘনা উপজেলায় ভোট গ্রহণ হবে। আর লাকসামে সব পদেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সবাই।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক, অফিসপ্রতিনিধিরা সহায়তা করেছেন]