ধনী প্রার্থী বেশি আওয়ামী লীগে, বিএনপিতে মামলার বোঝা

২৮ ডিসেম্বর প্রথম ধাপে ২৪ পৌরসভায় ভোট। দুই দলের প্রার্থীদের ৩৮ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত। ৭৬ শতাংশের পেশা ব্যবসা।

প্রথম ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের চেয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের আয় ও সম্পদ তুলনামূলক বেশি। আর মামলা বেশি বিএনপির প্রার্থীদের। তবে দুই দলের মনোনীতদের বড় অংশই পেশায় ব্যবসায়ী।

২৮ ডিসেম্বর প্রথম ধাপে ২৪টি পৌরসভায় ভোট গ্রহণ হবে। এসব পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে এই চিত্র পাওয়া গেছে। অবশ্য হলফনামায় প্রার্থীরা সম্পদ ও অন্যান্য তথ্যের যে বিবরণ দেন, তার সত্যতা নিয়ে কারও কারও সংশয় আছে। হলফনামার তথ্য যাচাইয়ের দাবি দীর্ঘদিনের। তবে নির্বাচন কমিশন (ইসি) তা যাচাই করে না।

প্রথম ধাপে যেসব পৌরসভায় ভোট হবে, সেগুলো হলো কুষ্টিয়ার খোকসা; কুড়িগ্রাম সদর; খুলনার চালনা; চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড; চুয়াডাঙ্গা সদর; রংপুরের পীরগঞ্জ; ঢাকার ধামরাই; বরিশালের বাকেরগঞ্জ, উজিরপুর; মানিকগঞ্জ সদর; মৌলভীবাজারের বড়লেখা; ময়মনসিংহের গফরগাঁও; দিনাজপুরের ফুলবাড়ী; নেত্রকোনার মদন; পঞ্চগড় সদর; পটুয়াখালীর কুয়াকাটা; পাবনার চাটমোহর; বরগুনার বেতাগী; রংপুরের বদরগঞ্জ; রাজশাহীর কাটাখালী ও পুটিয়া; সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর; সুনামগঞ্জের দিরাই ও হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ। এর মধ্যে মদন পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীর হলফনামা সংগ্রহ করা যায়নি।

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ৪৭ মেয়র পদপ্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাঁদের মধ্যে ১৬ জনের বার্ষিক আয় ৫ লাখ টাকার বেশি। প্রার্থীদের মধ্যে ১১ জন আওয়ামী লীগের, আর ৫ জন বিএনপির। অন্যদিকে স্থাবর সম্পত্তি বাদে ১০ লাখ টাকার বেশি সম্পদের মালিক প্রার্থী আছেন মোট ১৫ জন। তাঁদের মধ্যে ১১ জন আওয়ামী লীগের, আর ৪ জন বিএনপির।

বিএনপির প্রার্থীদের বড় অংশই বিভিন্ন মামলার আসামি। বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে ১৪ জনের বিরুদ্ধে এখনো মামলা চলছে। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে এখন মামলা আছে। আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল, তাঁরা সেগুলো থেকে খালাস পেয়েছেন বা মামলা স্থগিত হয়েছে।

প্রার্থীদের ৩৮ শতাংশ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস। বাকি ৬২ শতাংশ প্রার্থী সর্বোচ্চ উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন। তাঁদের মধ্যে ২০ শতাংশেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে।

পেশা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৪৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩৬ জনই ব্যবসায়ী। শতকরা হিসাবে প্রার্থীদের ৭৬ শতাংশই পেশায় ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে ২০ জন এবং বিএনপির ১৬ জনের পেশা ব্যবসা। এর বাইরে আইনজীবী, শিক্ষক, দলিল লেখক ও সাংবাদিক রয়েছেন। কয়েকজন পেশা উল্লেখ করেছেন কৃষিকাজ।

প্রথম ধাপে যেসব পৌরসভায় ভোট হবে, সেগুলো হলো কুষ্টিয়ার খোকসা; কুড়িগ্রাম সদর; খুলনার চালনা; চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড; চুয়াডাঙ্গা সদর; রংপুরের পীরগঞ্জ; ঢাকার ধামরাই; বরিশালের বাকেরগঞ্জ, উজিরপুর; মানিকগঞ্জ সদর; মৌলভীবাজারের বড়লেখা; ময়মনসিংহের গফরগাঁও; দিনাজপুরের ফুলবাড়ী; নেত্রকোনার মদন; পঞ্চগড় সদর; পটুয়াখালীর কুয়াকাটা; পাবনার চাটমোহর; বরগুনার বেতাগী; রংপুরের বদরগঞ্জ; রাজশাহীর কাটাখালী ও পুটিয়া; সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর; সুনামগঞ্জের দিরাই ও হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এর আগেও হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিএনপির প্রার্থীদের নামে মামলা বেশি, আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সম্পদ বেশি। এটা রাজনৈতিক অবস্থার প্রতিফলন হতে পারে। তাঁর মতে, দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হওয়ায় প্রার্থীদের মানের, বিশেষ করে শিক্ষাগত যোগ্যতার ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে।

প্রার্থীদের দেওয়া সম্পদের হিসাবের বিষয়ে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যেভাবে হলফনামায় তথ্য দেওয়া হয়, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এর কারণ নির্বাচন কমিশন হলফনামার তথ্য যাচাই–বাছাই করে না। ফলে প্রার্থীরা অনেক তথ্য গোপন করেন, অনেকে অসম্পূর্ণ তথ্য দেন। তিনি বলেন, আদালত হলফনামা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে ভোটাররা সব দেখে যোগ্য প্রার্থী বেছে নেওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু এখন হলফনামা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে না। নির্বাচন কমিশন যদি তথ্য যাচাই করে ব্যবস্থা নিত, তাহলে হলফনামার বিশ্বাসযোগ্যতা সৃষ্টি হতো।

সবচেয়ে ধনী ও ঋণী প্রার্থী মানিকগঞ্জে

এই ২৪টি পৌরসভায় সবচেয়ে বেশি অস্থাবর সম্পদের মালিক মানিকগঞ্জ সদর পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী রমজান আলী। অবশ্য হলফনামা অনুযায়ী তাঁর বার্ষিক আয় খুব বেশি নয়। তাঁর পেশা ব্যবসা ও কৃষি। এই দুই খাত থেকে তাঁর বছরে আয় হয় সাড়ে ৩ লাখ টাকার মতো। তবে তাঁর হাতে নগদ ও ব্যবসায়ের মূলধন মিলিয়ে আছে ২ কোটি ৯১ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে আছে ২৩ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। রমজানের নিজের ৩৫ ভরি সোনা আর স্ত্রীর আছে ৫৫ ভরি। এ ছাড়া নিজের নামে ১৮২ শতক কৃষি ও ১৯৬ শতক অকৃষিজমি আছে। একটি বেসরকারি ব্যাংকে তাঁর ঋণ আছে ৯৩ লাখ টাকার বেশি।

আওয়ামী লীগের এই প্রার্থীর নামে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে চারটি মামলা হয়েছিল। চারটি মামলাই এখন স্থগিত আছে বলে হলফনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।

রমজান আলীর প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী আতাউর রহমান। ২৪টি উপজেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের মধ্যে তাঁর ব্যাংকঋণই সবচেয়ে বেশি। একটি বেসরকারি ব্যাংকে তাঁর ঋণ আছে ৪ কোটি ৪৪ লাখ ৫১ হাজার টাকা। ইটভাটা ও কয়লা ব্যবসায়ী এই প্রার্থীর বছরে আয় ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৬০০ টাকা। তাঁর ধনসম্পদের মধ্যে আছে ৮০ হাজার টাকা, একটি মোটরসাইকেল, ২০ তোলা সোনা, ২টি টিনের ঘর এবং কৃষি ও অকৃষিজমি। তাঁর স্ত্রীর নামে আছে ২০ হাজার টাকা এবং ৫ দশমিক ৭৫ শতক জমি।

রমজান আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নিজের আয় কম, তবে পারিবারিকভাবে আমরা ধনী। হলফনামাতে সব পরিষ্কারভাবে লিখে দিয়েছি।’

যেভাবে হলফনামায় তথ্য দেওয়া হয়, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এর কারণ নির্বাচন কমিশন হলফনামার তথ্য যাচাই–বাছাই করে না। ফলে প্রার্থীরা অনেক তথ্য গোপন করেন, অনেকে অসম্পূর্ণ তথ্য দেন।
বদিউল আলম মজুমদার, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক

সবচেয়ে বেশি ও কম আয়ের প্রার্থী গফরগাঁওয়ে

হলফনামায় বছরে সবচেয়ে বেশি আয় দেখিয়েছেন গফরগাঁও পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী এস এম ইকবাল হোসেন। তিনি অটো রাইস মিলের মালিক। তিনি বলেছেন, ব্যবসা, ভাড়া, সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য খাত থেকে বছরে তাঁর ৪০ লাখ টাকার বেশি আয় হয়। এসবের মধ্যে ৩০ লাখ টাকা আসে কৃষি খাত থেকে। তাঁর হাতে নগদ টাকা আছে ২৬ লাখ ৪৭ হাজার। ব্যাংকে আছে ৩৪ লাখ ৭২ হাজার টাকা। অন্যান্য সামগ্রী মিলিয়ে তাঁর মোট ৮৫ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ আছে, আর স্থাবর সম্পদের মধ্যে আছে ঢাকায় ৫ তলা বাড়ি, ১ একর অকৃষি এবং এক একর কৃষিজমি, ৯ একর বাগান।

ইকবাল হোসেনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপির শাহ আব্দুল্লাহ আল মামুনের বছরে আয় ১ লাখ টাকা। প্রথম ধাপের পৌরসভাগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে বার্ষিক আয় সবচেয়ে কম মামুনের। তাঁর সম্পদের মধ্যে আছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা, এক ভরি সোনা, ৬০ শতাংশ জমি, একটি দালান ও একটি বাড়ি।

আওয়ামী লীগের প্রার্থী এস এম ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সম্পদ ও আয়ের পার্থক্যের কারণে নির্বাচনে কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি পারিবারিকভাবে ব্যবসায়ী এবং সচ্ছল।

বিএনপির ধনী প্রার্থী ১০ বাড়ির মালিক

বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী বরগুনার বেতাগী পৌরসভার মেয়র পদপ্রার্থী হুমায়ুন কবির। তিনি পেশায় ঠিকাদার ও গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। বছরে তাঁর আয় ২৬ লাখ টাকা। প্রায় ৪০ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ আছে। এ ছাড়া ঢাকা ও বেতাগীতে জমি, ঢাকায় একটি ৭ তলা, বেতাগীতে একটি দোতলা, একটি একতলা এবং ৭টি টিনশেড বাড়ি আছে এই ব্যবসায়ীর। তবে এসব বাড়ির আর্থিক মূল্য তিনি হলফনামায় উল্লেখ করেননি।

মামলার বোঝা বিএনপির প্রার্থীদের

বিএনপির ২৩ প্রার্থীর মধ্যে ১৪ জনই মামলার আসামি। বেশির ভাগ মামলা হয়েছে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে–পরে ২০১৪–২০১৫ সালে। বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা আছে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জের এফ এম অলি আহমেদের নামে। তাঁর বিরুদ্ধে মোট ১০টি মামলা। এগুলোর মধ্যে পাঁচটি বিচারাধীন আছে, দুটি মামলা হাইকোর্ট স্থগিত করেছেন, একটি শুনানির পর্যায়ে আছে, একটি তদন্তাধীন এবং একটিতে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে তিনটি মামলা ২০২০ সালে হয়েছে। এগুলো বাদে এর আগে চারটি মামলায় তিনি খালাস ও একটিতে অব্যাহতি পেয়েছেন। নিষ্পত্তি হয়েছে একটি মামলা।

এফ এম অলি আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক কারণে ফাঁসাতে মামলাগুলো দেওয়া হয়েছে।

পেশা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৪৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩৬ জনই ব্যবসায়ী। শতকরা হিসাবে প্রার্থীদের ৭৬ শতাংশই পেশায় ব্যবসায়ী। আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে ২০ জন এবং বিএনপির ১৬ জনের পেশা ব্যবসা। এর বাইরে আইনজীবী, শিক্ষক, দলিল লেখক ও সাংবাদিক রয়েছেন। কয়েকজন পেশা উল্লেখ করেছেন কৃষিকাজ।

কুষ্টিয়ার খোকসা ও রাজশাহীর কাটাখালীর বিএনপি প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ৯টি করে মামলা আছে বিস্ফোরক আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে।

কাটাখালীর বিএনপি প্রার্থী মো. সিরাজুল হকের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেও একটি মামলা হয়েছে। সিরাজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা। নির্বাচন সামনে রেখে গত বছর তাঁর বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা দেওয়া হয়। বাদী কোনো দিন আদালতে হাজিরা দেননি।

অন্যদিকে রাজশাহীর কাটাখালীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আব্বাস আলীর বিরুদ্ধে আগে ১০টি মামলা ছিল। সেগুলো থেকে তিনি খালাস পেয়েছেন। তবে ৩০২ ধারায় একটি মামলা আপিল পর্যায়ে আছে। এ ছাড়া গফরগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এস এম ইকবাল হোসেন ও ধামরাই পৌরসভায় প্রার্থী গোলাম কবিরের বিরুদ্ধে একটি করে মামলা আছে।