বক্তব্য বিকৃত করার দাবি এইচ টি ইমামের

৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে এইচ টি ইমামের সংবাদ সম্মেলন আয়োজন নিয়েই এখন নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে একজন মন্ত্রীর কৌতূহলের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, রাজনৈতিক উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগই হয়নি। তবে, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এইচ টি ইমাম দাবি করেন, তাঁর সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী অবহিত আছেন।
গত বুধবার ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম গতকাল সকালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে ওই সংবাদ সম্মেলন করেন। আরেকজন সাবেক আমলা ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেন, গণমাধ্যমে তাঁর বক্তব্যের অর্থ বিকৃতি ঘটিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। খণ্ডিত শব্দায়ন করে কোনো কোনো সংবাদপত্র এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে বক্তব্যের সারমর্মকেই পাল্টে দেওয়া হয়েছে।
আগের দিন বিবিসি এবং প্রথম আলোর সঙ্গে দেওয়া বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে তিনি জানালেও গতকাল এ-সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি তাঁর কোনো কথা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই সংবাদ সম্মেলন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্দেশে ঠিক নয়, তবে তিনি সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে অবগত আছেন। তিনি প্রকারান্তরে আমাকে আমার বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে বলেছেন।’
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী এবং আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, এইচ টি ইমাম নিজেই বলেছেন, তাঁর সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী অবগত আছেন। আবদুস সোবহান নিজেও ওই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কোনো নির্দেশনা ছিল কি না জানতে চাইলে সরাসরি তার উত্তর না দিয়ে আবদুস সোবহান বলেন, ‘এইচ টি ইমাম আমাকে ফোন করে ধানমন্ডির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করবেন বলে জানান।’ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের কাছে এ বিষয়ে জানার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। এইচ টি ইমাম গতকালও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টায় সচিবালয়ে যান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ মেলেনি বলে একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে (ডান থেকে) প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান l ছবি: প্রথম আলো
সংবাদ সম্মেলনে (ডান থেকে) প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান l ছবি: প্রথম আলো

প্রধানমন্ত্রীর অস্বীকার: গতকাল মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজের রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের সঙ্গে কথা হয়নি বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে এ কথা জানা গেছে। সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এইচ টি ইমামের গতকালের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগই হয়নি।
গত বুধবার ছাত্রলীগের এক সভায় এইচ টি ইমাম ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পর্কে বলেন, ‘নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ পুলিশ ও প্রশাসনের যে ভূমিকা, নির্বাচনের সময় আমি তো প্রত্যেকটি উপজেলায় কথা বলেছি, সব জায়গায় আমাদের যারা রিক্রুটেড, তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের দিয়ে মোবাইল কোর্ট করিয়ে আমরা নির্বাচন করেছি। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে, বুক পেতে দিয়েছে।’
ইমামের এই বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা হয়। তাঁর এই বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারি দলের নেতারা নাখোশ হন। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রোববার তিনি নানাভাবে যোগাযোগ করে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ লাভেরও চেষ্টা করলেও তাঁর সাক্ষাৎ পাননি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষাতের সুযোগ না পেলেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়েছে। তবে কী ধরনের যোগাযোগ, তা তিনি খোলাসা করেননি।
পদত্যাগ করবেন না: বিরোধী দল বিএনপির দাবির পর পদত্যাগ করবেন কি না জানতে চাইলে এইচ টি ইমাম বলেন, বিএনপির দাবিতে পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না। তিনি সংবাদ সম্মেলনে তাঁর বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ করেন। এ ষড়যন্ত্র দলের ভেতরে, নাকি বাইরে থেকে হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দলের ভেতর থেকে নয়। আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করি।’ আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সাংসদ এবং উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তাঁকে সতর্ক হয়ে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন, এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি তাঁর বক্তব্য সরাসরি শুনিনি। সে সম্পর্কে কোনো কথা বলব না।’ আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে তাঁর সম্পর্কে সমালোচনা ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুব্ধ হওয়ার সংবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না। তবে দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান আমাকে জানিয়েছেন, এ ধরনের কোনো আলোচনা হয়নি। তা ছাড়া সংসদীয় বোর্ডে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আলোচনা হয়।’
৫ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘ওই সময় আমি সরকারের কেউ ছিলাম না। তাই প্রশাসনে মোবাইল কোর্ট (ভ্রাম্যমাণ আদালত) করানোর কথা বলার প্রশ্নই ওঠে না। তবে আমি আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। সে ক্ষেত্রে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ করতে হয়েছে। বিভিন্ন অভিযোগ জানাতে হয়েছে।’ সাবেক এই আমলা দাবি করেন, ‘আমি যা করেছি তা নির্বাচনী আইন-বিধি মেনেই করেছি। আর “আমাদের রিক্রুট করা” বলতে আমি প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বুঝিয়েছি। কোনো দলীয় পরিচয় উল্লেখ করিনি।’
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চাকরির সুবিধা দেওয়া প্রসঙ্গে এইচ টি ইমাম বলেন, ‘ওই দিন আমি যা বলেছি তা হচ্ছে, যারা লিখিত পরীক্ষায় উন্নীত হবে, তারাই প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি পাবে। লিখিত পরীক্ষায় ভালো করলে পরে মৌখিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং তখন কীভাবে নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তোলা যায়, সে ব্যাপারে আমি তাদের পরামর্শ দিয়েছিলাম।’ এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘১২ নভেম্বর আমি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলাম, একটি হলো লিখিত পরীক্ষা ভালো করতে হবে। কারণ এক হাজার নম্বর হচ্ছে লিখিত পরীক্ষায়। তারপর মৌখিকও ভালো করতে হবে। এ জন্য যা যা করা দরকার তা-ই করব। প্রয়োজনে আমি নিজেই তোমাদের কোচিং করাব। মৌখিক পরীক্ষায় গিয়ে কীভাবে প্রশ্ন উত্তর, সালাম দিতে হবে, সেটা শিখাব।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি আমলে একটি বিশেষ ভবনের সুপারিশে বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় ছাত্রদলের ক্যাডারদের পাস করিয়ে দিত। আমাদের সে অভিপ্রায় নেই। তাই সাহসিকতার সঙ্গে বলেছি লেখাপড়া শিখে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে।’
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, আওয়ামী লীগের নেতা বদিউজ্জামান ভূঁইয়া, আবদুস সোবহান, মৃণাল কান্তি দাস, অসীম কুমার উকিল, সুজিৎ রায় নন্দী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।