বিএনপিতে অসন্তোষ, বিদ্রোহের শঙ্কা

পৌরসভা নির্বাচন
পৌরসভা নির্বাচন

পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে পক্ষপাত এবং আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বিএনপিতে। এতে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে নেতাদের মধ্যে। প্রার্থী বাছাইয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো কমিটি না থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন নেতারা।
বিএনপি ২৩৫টি পৌরসভায় কাদের মনোনয়ন দিয়েছে, তা গতকাল বুধবার পর্যন্ত গণমাধ্যমকে জানায়নি। দুই দিন ধরে বিচ্ছিন্নভাবে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে জড়ো হওয়া সম্ভাব্য মেয়র পদপ্রার্থীদের নাম ডেকে ডেকে প্রত্যয়নপত্র বিলি করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। মনোনয়ন জানাজানি হওয়ার পর সেখানেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অনেকে।
গতকাল বিকেলে চেয়ারপারসনের কার্যালয়েই মারামারি করেছেন নরসিংদীর মনোহরদী পৌরসভায় দুই মনোনয়নপ্রার্থীর সমর্থকেরা। সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন মাহমুদুল হক। পাননি আবদুল খালেক মিয়া। মাহমুদুল সংস্কারপন্থী নেতা সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুলের সমর্থক; খালেক সাবেক সাংসদ জয়নুল আবদিনের।
মাহমুদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রত্যয়নপত্র নেওয়ার জন্য ডাকলে আমি গুলশানের কার্যালয়ে যাই। হঠাৎ কয়েকজন পেছন থেকে আমাকে কিল-ঘুষি মারতে শুরু করেন।’
বিক্ষুব্ধ নেতারা অভিযোগ করেছেন, প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের সুপারিশ রাখা হয়নি। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তদবির ও আর্থিক সুবিধা নিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মনোনয়নবঞ্চিত অন্তত ১০ জন নেতা প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের বলেছেন, তাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়বেন।
আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে প্রার্থী মনোনয়নের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের লিগ্যাসি হলো, সব দলেই কম-বেশি মনোনয়ন বাণিজ্য হয়। এবারও যে সেটি একদম হচ্ছে না, তা আমি শপথ করে বলতে পারি না।’
রাজশাহীর তাহেরপুর, কাঁটাখালী, নওহাটা ও আড়ানী—এই চার পৌরসভায় মেয়র পদে দলীয় মনোনয়ন পাওয়াদের বাইরে গিয়ে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী (স্বতন্ত্র) হিসেবে লড়বেন বিএনপি চার নেতা। এর মধ্যে দুজন বিএনপি-ঘোষিত প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন। তাহেরপুর পৌর ছাত্রদলের সভাপতি এস এম আরিফুল ইসলাম মনোনয়ন চেয়ে পাননি।
আরিফুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তৃণমূলের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি। ঢাকায় বসে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান নিজের ইচ্ছায় মনোনয়ন দিয়েছেন। তৃণমূলের মতামত নিলে তিনিই পেতেন বলে দাবি করেন।
রাজবাড়ী পৌরসভার মনোনয়ন নিয়ে স্থানীয় সাবেক সাংসদ আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়মের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে প্রতিপক্ষ।
মাদারীপুরের শিবচর পৌরসভায় বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন জাহাঙ্গীর কামাল। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার খুলনা সফরের পথে কাওড়াকান্দি ফেরিঘাটে গাড়িবহরে হামলার অভিযোগে স্থানীয় বিএনপির নেতা আবদুল মান্নান খান যে মামলা করেছিলেন, তিনি সেই মামলায় ১৫ নম্বর আসামি। জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন নিয়ে স্থানীয় বিএনপিতে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
অবশ্য জাহাঙ্গীর কামাল বলেছেন, তিনি ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। রাজনৈতিক বিরোধের কারণে তাঁকে আসামি করা হয়েছিল।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভায় জাতীয় পার্টির (জাফর) প্রার্থী মহিউদ্দিন বানাত, মিরপুরে আবদুল আজিজকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। দলীয় সূত্র বলছে, জেলা, থানা ও পৌর বিএনপি ভেড়ামারায় যুবদল নেতা শামীম রেজা ও মিরপুরে থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক রহমত আলীকে প্রার্থী করার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু কেন্দ্র তা রাখেনি।
জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক সাংসদ শহীদুল ইসলাম বলেন, এই মনোনয়নে বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিস্মিত, ক্ষুব্ধ। রাগিব রউফ চৌধুরী নামে একজন আইনজীবীর অনুরোধে মিরপুরে আবদুল আজিজকে প্রার্থী করা হয়। আর মহিউদ্দিন বানাত চার-পাঁচ শ ভোট পাবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জানতে চাইলে বিএনপির নির্বাচন সমন্বয়ে যুক্ত দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘তৃণমূলের সিদ্ধান্তেও কিছু ত্রুটি আছে। আবার এলাকার প্রভাবশালী নেতারও মতামত থাকে। সব মিলিয়ে আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা তো আছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না।’ তবে একজন মনোনয়ন পেলে অন্যদের নানা অভিযোগকে ‘চিরাচরিত সংস্কৃতি’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা পৌরসভার বর্তমান মেয়র আবু ইউসুফ চৌধুরীকে প্রার্থী করেনি বিএনপি। সেখানে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন বাদশা মিয়া। এতে হস্তক্ষেপ ছিল এলাকার সাবেক সাংসদ আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়ার। তাঁকে গত মঙ্গলবার রাতে ও আগের দিন বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে দলীয় প্রার্থীদের প্রত্যায়নকারী মো. শাহজাহানের সঙ্গে দেখা গেছে।
চট্টগ্রামের মিরসরাই পৌরসভায় রফিকুল ইসলাম ও বারইয়ারহাটে মাইনুদ্দিন লিটনকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। থানা ও পৌর বিএনপি সুপারিশ করেছিল মিরসরাইয়ে মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী আর বারৈয়ারহাটে দিদারুল আলম মিয়াজির জন্য। দুজনই গতকাল প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, দলের সাবেক একজন সাংসদের তদবির ও আর্থিক সুবিধার কাছে তাঁরা হেরে গেছেন।
দিদারুল আলম মিয়াজী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ছাত্রজীবন থেকে এলাকায় আছি। এ পর্যন্ত ২৩টি মামলা খেয়েছি। মাইনুদ্দীন গত নির্বাচনে হেরে এলাকা ছেড়েছেন।’
আর আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেছেন, ‘দল যে প্রার্থী মনোনয়নে ভুল করেছে, তা চার-পাঁচ হাজার লোক নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে দেখাব।’
মৌলভীবাজারের বড়লেখার বর্তমান মেয়র ফখরুল ইসলাম বিএনপির মনোনয়ন পাননি। তাঁর বদলে প্রার্থী করা হয়েছে দ্বিধাবিভক্ত পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলামকে। যদিও তাঁর কমিটির ৫৮ জন সম্প্রতি পদত্যাগ করেছিলেন। ফেনী সদর পৌরসভায় মনোনীত প্রার্থী ফজলুর রহমানকে নিয়ে দলেই বিতর্ক আছে। সেখানে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত সাবেক পৌর মেয়র নুরুল আবছারকে গুরুত্ব না দেওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে।
এই বিশৃঙ্খলার কারণ হিসেবে বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে নির্দলীয় উপজেলা নির্বাচন, সর্বশেষ চট্টগ্রাম ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিচালনার জন্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের সমন্বয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কমিটি করেছিল বিএনপি। কিন্তু প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠেয় দলভিত্তিক পৌরসভা নির্বাচন উপলক্ষে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো কমিটি করা হয়নি। দলের একজন যুগ্ম মহাসচিবকে এ-সংক্রান্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁকে সহযোগিতা করছেন দলের সহসম্পাদক পর্যায়ের কয়েকজন নেতা। জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য মনোনয়ন বোর্ডের আদলে কিছু না করা বা নির্বাচন পরিচালনার জন্য আনুষ্ঠানিক কোনো কমিটি না করায় বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রার্থী মনোনয়ন বোর্ডের মাধ্যমে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে।
এ বিষয়ে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘আমরা যে মনোনয়ন বোর্ড করব, এর সময়টা কই?’ তিনি বলেন, প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় স্থায়ী কমিটির কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত দূরে সরে ছিলেন। আবার যে এলাকায় যাঁর দরকার মনে হয়েছে, সেখানে তাঁর মতামত নেওয়া হয়েছে। আমিও যে এর সঙ্গে পুরোপুরি যুক্ত ছিলাম তা নয়। আমারও এলাকাভিত্তিক মত নেওয়া হয়েছে।’
আর মাহবুবুর রহমান বলেছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচন নিয়ে বড় পরিসরে বৈঠক করেছেন। সেখানে নির্বাচনের কিছু দায়িত্বও বণ্টন করা হয়েছে। তবে নির্বাচনের প্রার্থী বাছাই ও পরিচালনার জন্য স্থায়ী কমিটির সদস্য ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের সমন্বয়ে আলাদা কমিটি হতে পারত।
আরও পড়ুন:

মনোনয়ন পেলেন যাঁরা