বিএনপির ঐক্য এখনো ‘আউলাঝাউলা’

বিএনপির সমাবেশে বক্তব্য দেন দলীয় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
ফাইল ছবি

ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গঠনে বিএনপির দীর্ঘদিনের চেষ্টা থমকে গেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সমমনাদের মধ্যে ঐক্যের চেয়ে বরং দূরত্ব দৃশ্যমান হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির ঐক্য প্রচেষ্টা হঠাৎ করেই যেন ‘আউলাঝাউলা’ হয়ে পড়েছে।

একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে প্রায় এক বছর ধরে বিএনপি সরকারবিরোধী সব পক্ষকে একসূত্রে গাঁথার ভাবনা নিয়ে এগোচ্ছিল। এ লক্ষ্যে বিএনপির নেতারা গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একাধিক শরিক দলের পাশাপাশি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ও বাসদসহ অন্তত ৩০টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই ঐক্যপ্রক্রিয়া ভিত্তি পায়নি। এরই মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যের মূল সূত্র নির্বাচনকালে নির্দলীয় সরকার, নাকি জাতীয় সরকার—তা নিয়ে কিছু কিছু দলের মতভিন্নতা এবং আলাদা তৎপরতা প্রকাশ পেয়েছে। এ অবস্থায় বিএনপির ঐক্যপ্রক্রিয়া অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৃহত্তর ঐক্যের জন্য লাগাতার চেষ্টা থাকতে হয় এবং এর জন্য একটি বেজলাইন, গাইডলাইন থাকতে হয়। বিএনপি বিভিন্ন সময়ে ভাঙা ভাঙা বক্তৃতায় বৃহত্তর ঐক্যের কথা বলে আসছে। কিন্তু এর জন্য সে রকম কোনো চেষ্টা ছিল বলে আমার কখনো মনে হয়নি।’

নুরুল হক নুরের গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন নিয়ে মাঠে সক্রিয় নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না
ফাইল ছবি

অন্যদিকে বৃহত্তর ঐক্যে ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীকে বাইরে রাখার চিন্তা করছিলেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। ভিন্ন কোনো কৌশলে জামায়াতকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত রাখার কথা ভাবা হচ্ছিল। এ লক্ষ্যে ২০-দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্ট ছাড়াও একাধিক বামপন্থী দলের নেতাদের সঙ্গে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা পৃথক বৈঠক করে প্রাথমিক আলাপ-আলোচনাও করেন বলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। এটিও সেভাবে এগোয়নি। এর মধ্যে হঠাৎ করেই আলোচনায় সামনে এসেছে সরকারবিরোধী ঐক্যের মূল সূত্র নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি।

‘নির্দলীয় সরকার, না জাতীয় সরকার—এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। আমাদের মূল বিষয় হচ্ছে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। আমরা মনে করি, শেষ পর্যন্ত এটা একটা জায়গায় যাবে।’
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপির মহাসচিব

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে উঠলে এবং এর পরিণতিতে সরকার পদত্যাগে বাধ্য হলে তখন নির্বাচনকালীন সরকারের রূপ কী হবে। সেটি নির্দলীয় সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নাকি জাতীয় সরকার হবে—তা নিয়ে একাধিক বিরোধী দলের মধ্যে কিছুটা মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে।

বিএনপি শুরু থেকেই নির্বাচনকালে নির্দলীয় সরকারের জোর দাবি করে এলেও ২০-দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের দুই শীর্ষ নেতা আ স ম আবদুর রব ও অলি আহমেদ জাতীয় সরকারের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।

হঠাৎ করে অলি আহমেদের বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠক করলেন আ স ম আবদুর রব। পরে জানা যায়, তাঁরাও নির্বাচনের সময় জাতীয় সরকারের পক্ষে।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

এ বিষয়ে আ স ম আবদুর রব গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় সরকার, তত্ত্বাধায়ক সরকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার— এগুলোতে কি খুব বেশি পার্থক্য আছে? আমি যেটা বলেছি, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে যারাই আন্দোলনে সরকার পতনের জন্য কাজ করবে, তারা সবাই মিলে একটা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠন করবে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য। আমি একটা প্রস্তাব রেখেছি, এটাই চূড়ান্ত নয়। সবাই আলোচনা করে যেটা সিদ্ধান্ত নেব, সেটাই চূড়ান্ত।’

১৪ মার্চ রাতে একান্ত বৈঠক করেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের(জেএসডি) সভাপতি ও লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি অলি আহমেদ। বৈঠক শেষে এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, বৈঠকে জাতীয় সরকারের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে আসছে। আর জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলছেন, নির্বাচনের আগে জাতীয় সরকার করতে হবে।
ফাইল ছবি

যদিও এর আগেই জাতীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান প্রকাশ করে বক্তব্য দেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি সরাসরি রাজনীতি না করলেও তাঁর সঙ্গে জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদসহ বাম ঘরানার কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সখ্য রয়েছে। এ কারণে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টি নিয়ে বেশ বিব্রত ও চিন্তিত। এতে সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্যের মোড় ঘুরে যাবে কি না, তা নিয়ে দলে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়েছে।

যদিও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, এটি কোনো সমস্যা নয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্দলীয় সরকার, না জাতীয় সরকার—এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। আমাদের মূল বিষয় হচ্ছে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। এ নিয়ে প্রতিটি দলের নিজস্ব মতামত থাকতে পারে। আমরা মনে করি, শেষ পর্যন্ত এটা একটা জায়গায় যাবে।’

বৃহত্তর ঐক্য গড়ার বিষয়ে ২০-দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা মনে করেন, বিএনপি এখন পর্যন্ত ঐক্যের কর্মপন্থা ঠিক করতে পারেনি। তা ছাড়া তারা যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি করছে, সে বিষয়েও এখন পর্যন্ত স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেনি। বিএনপি বলছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে তিন মাস। কিন্তু বর্তমান সরকার সংবিধানসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে দলীয় কর্মী নিয়োগ করে তছনছ করে দিয়েছে, এই তিন মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কী পরিবর্তন করবে। তা ছাড়া আন্দোলন ও নির্বাচন প্রশ্নে তারেক রহমানের অবস্থান কী? তাঁর দেশে ফেরা, মামলার পরিণতি নিয়েও বিএনপির অবস্থান ও চাওয়াটা এখনো স্পষ্ট নয় বলে মনে করছেন দুই জোটের অধিকাংশ নেতা।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, এটি কোনো সমস্যা নয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নির্দলীয় সরকার, না জাতীয় সরকার—এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। আমাদের মূল বিষয় হচ্ছে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জামায়াতে ইসলামীকে জোটে রাখা হবে কি না, কাদের কাদের নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য হবে, তা কীভাবে হবে—এসব মৌলিক বিষয়ে স্পষ্ট কোনো রূপরেখা নেই। বিশেষ করে জামায়াতকে জোটে রাখা না রাখা নিয়ে খোদ বিএনপির ভেতরেই বিতর্ক ও মতবিরোধ আছে। জামায়াতকে ছেড়ে বাম প্রগতিশীল দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য হলে বিএনপি নেতিবাচক প্রচার থেকে বের হয়ে আসবে, কিন্তু ভোটের মাঠে এর প্রতিক্রিয়া কী হবে, তা নিয়েও বিতর্ক আছে দলের নীতিনির্ধারণী মহলে।

তবে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, বর্তমান সরকারের ভোটাধিকার হরণ ও অপশাসনের ব্যাপারে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একমত। এখন দলমত-নির্বিশেষে যার যার অবস্থান থেকে এ বিষয়ে সোচ্চার ও সক্রিয় হলেই একটি বৃহত্তর আন্দোলনের সূত্রপাত হতে পারে। এই পথ ধরেই ধীরে ধীরে যুগপৎ কর্মসূচির দিকে যাবে দলগুলো। এ প্রক্রিয়ায় মাঠের ঐক্যের মধ্য দিয়ে একটি বৃহত্তর ঐক্য তৈরি হবে। এ রকম চিন্তা থেকেই পুরোনো জোট কাঠামো থেকে বের হয়ে আন্দোলনের বৃহত্তর ক্ষেত্র তৈরি করতে চাইছে বিএনপি।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ঐক্যের প্রক্রিয়া চলছে। তবে এ ধরনের কাজে একটু সময় লাগে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বৃহত্তর ঐক্য দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিণতি পাবে কি না, জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘দ্রুত হবে কি না জানি না, তবে ঐক্য একটি পরিণতিতে যাবে—এ বিশ্বাস আমাদের আছে।’