বিএনপির ভোট ভাগাভাগি হওয়ায় হারলেন মনিরুল

বিএনপির একটি অংশ মনিরুলকে ঠেকাতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একধরনের ‘সমঝোতা’ করেছিল, এমন আলোচনা কুমিল্লায়।

মনিরুল হক ও আরফানুল হক

বিএনপির সব ভোট নিজের পক্ষে টানতে না পারায় এবার মেয়র পদে মনিরুল হককে হারতে হয়েছে—কুমিল্লার বিভিন্ন মহলে এমন আলোচনাই এখন বেশি। অন্যদিকে নৌকার প্রার্থী আরফানুল হকের বিজয়ের পেছনে স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের মুখ্য ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হচ্ছে।

সব নির্বাচনের পরই প্রার্থীদের জয়-পরাজয় নিয়ে নানামুখী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হয়, কুমিল্লার ভোট নিয়েও তা–ই হচ্ছে। তবে জয়-পরাজয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ছাপিয়ে মূল আলোচনা এখন ভোটের ফলাফল ঘোষণার একেবারে শেষ মুহূর্তের নাটকীয়তাকে ঘিরে। পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়েও ভোটারদের মধ্যে আলোচনা আছে।

মাত্র ৩৪৩ ভোটে কুমিল্লা সিটির মেয়র পদে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে। নৌকা প্রতীকের আরফানুল হক (রিফাত) পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী টেবিলঘড়ি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা মনিরুল হক (সাক্কু) পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। ভোটের লড়াইয়ে তৃতীয় হওয়া ঘোড়া প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯৯ ভোট। মনিরুল ও নিজাম দুজনই বিএনপি থেকে পদত্যাগ করে এবার ভোটে অংশ নিয়েছেন। দুজনে মিলে পেয়েছেন ৭৯ হাজার ৬৬ ভোট। দলচ্যুত হলেও তাঁদের ভোটের মূল উৎস ছিল বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা।

‘সাক্কু (মনিরুল হক) ওয়ানম্যান আর্মি। তাঁর নীরব ভোট ছিল। নির্বাচনে অংশ না নিলেও বিএনপি বড় দল। এ দলের অধিকাংশই কাজ করেছে কায়সারের (নিজাম উদ্দিন) পক্ষে।’
আহসানুল কবীর, কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ ও স্থানীয় বিএনপির নেতারা বলছেন, দুবারের মেয়র মনিরুল বিএনপির সাধারণ সমর্থকদের ভোট টানতে পারলেও সাংগঠনিক কাঠামোতে থাকা নেতা-কর্মীদের ভোট সেভাবে পাননি। এ কারণে বিএনপি–অধ্যুষিত এলাকা হিসেবে পরিচিত এলাকাগুলোতে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভোট পেয়েছেন নিজামউদ্দিনও। এর মধ্যে কুমিল্লা শহরের শাকতলা, পদুয়ার বাজার, সিটি কলেজ, তাজপাড়া, নেউরা, বল্লভপুর, চৌয়ারা, তেলিকোনা ও ইসলামপুর এলাকা উল্লেখযোগ্য।

কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আহসানুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাক্কু (মনিরুল হক) ওয়ানম্যান আর্মি। তাঁর নীরব ভোট ছিল। নির্বাচনে অংশ না নিলেও বিএনপি বড় দল। এ দলের অধিকাংশই কাজ করেছে কায়সারের (নিজাম উদ্দিন) পক্ষে।’

আরও পড়ুন

কুমিল্লার রাজনৈতিক অঙ্গনে আগে থেকেই এমন আলোচনা ছিল, এবার নিজামের প্রার্থিতার পেছনে স্থানীয় বিএনপিরও একটা ‘রাজনীতি’ আছে। মনিরুলকে ঠেকাতে দলের একটি অংশ এবার আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিনের সঙ্গে একধরনের গোপন ‘সমঝোতা’ করেছিল। অতীতে যা করেছিলেন মনিরুল হক। এই সমঝোতায় কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমিন উর রশীদ ইয়াছিনের নাম এসেছে। ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী নিজাম তাঁর শ্যালক। দলীয় রাজনীতিতে স্থানীয়ভাবে তাঁর একটা অবস্থান আছে এবং কুমিল্লায় তাঁর শিল্পকারখানাও রয়েছে। সেখানে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ভোটে এসব বিষয়ও নিজামের জন্য সহায়ক হয়েছে।

স্থানীয় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পক্ষ বলছে, মেয়র ভোটে পরাজয় মনিরুল হককে ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা অবস্থানে ফেলতে পারে। এর রেশে জেলা বিএনপিতে দলাদলি, অন্তঃকোন্দল আরও বেড়ে যেতে পারে। তবে ভোটের ফলাফলে অনেকটাই স্পষ্ট যে মনিরুল হক বিএনপির বাইরে সাধারণ মানুষের ভোটই বেশি পেয়েছেন। দলীয় প্রতীক ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের বিপক্ষে নৌকা প্রতীকের সঙ্গে লড়ে মাত্র ৩৪৩ ভোটে হেরেছেন। দুর্নীতি, অস্বচ্ছতার নানা অভিযোগের পরও এত ভোট পাওয়া তাঁর জনভিত্তির প্রমাণ দিয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে।

অন্যদিকে আরফানুল হকের জয় ছিল অনেকটা চমক। স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আফজল খানকে (এখন প্রয়াত) ২৯ হাজার ও তাঁর মেয়ে আঞ্জুম সুলতানাকে (বর্তমানে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য) ১১ হাজার ভোটে হারানো মনিরুলকে এবার হারাতে পেরেছেন আরফানুল। তবে গত মেয়র নির্বাচনে আরফানুলের চেয়ে সাড়ে সাত হাজার ভোট বেশি পেয়েও মনিরুলের কাছে হেরেছিলেন আঞ্জুম সুলতানা।

আরফানুলের এই জয় সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহারের জয় হিসেবে বলতে চান আওয়ামী লীগ ও বিএনপির স্থানীয় নেতারা। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বুধবার রাতে কুমিল্লা জেলা শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে ফলাফল ঘোষণার পরপরই ‘নৌকা নৌকা’ এবং ‘বাহার ভাই, বাহার ভাই’ স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে শহর।

আরফানুল হকও তাঁর জয়ের পেছনে বাহাউদ্দিনের ভূমিকার কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আ ক ম বাহাউদ্দিনের নেতৃত্বে দলীয় সাংগঠনিক শক্তি এবং কুমিল্লার মানুষের ভালোবাসায় আমি জয়ী হয়েছি।’

এই জয় কুমিল্লার রাজনীতিতে বাহাউদ্দিনের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে আরও নিরঙ্কুশ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।

৪৫ মিনিটের নাটকীয়তা

ভোটের ফলাফল ঘোষণার শেষ দিকে ৪৫ মিনিটের নাটকীয়তা নিয়ে কুমিল্লায় এখন বেশ আলোচনা চলছে। বুধবার বিকেল চারটায় ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর রাত প্রায় আটটা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন মোট ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৭২টির ফলাফল ঘোষণা করেছিল। তখন পর্যন্ত আরফানুলের ভোট ছিল ৩৩ হাজার ৭৯৩টি। মনিরুলের ছিল ৩২ হাজার ৩২২ ভোট। তখন ১ হাজার ৪৭১ ভোটে এগিয়ে ছিলেন আরফানুল।

টান টান উত্তেজনার ওই সময়ে ভোটের চূড়ান্ত ফল জানতে নেতা-কর্মীদের নিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে (এখান থেকে ভোটের ফলাফল ঘোষণা হচ্ছিল) আসেন মনিরুল হক। এ সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী মাইকে ঘোষণা দেন, ১০১টি কেন্দ্রের ফল এসে পৌঁছেছে। তবে তখন থেকে সমন্বিত ফলাফল (ঘোষিত সব কেন্দ্র মিলে কোন প্রার্থী কত ভোট পেয়েছেন) আর জানানো হয়নি, কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল ঘোষণা হচ্ছিল। অর্থাৎ কোন কেন্দ্রে কে কত ভোট পেয়েছেন, শুধু সেটি বলা হতো।

রাত নয়টার দিকে তুমুল করতালি আর স্লোগান দিতে দিতে নৌকার মেয়র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরাও সেখানে হাজির হন। তাঁরা মনিরুলের সামনে এসে কয়েক মিনিট ‘নৌকা নৌকা’ স্লোগান দেন। এরপরই আরফানুলের সমর্থনে আরেকটি মিছিল সেখানে হাজির হয়। একপর্যায়ে তাঁরা মনিরুল হকের ওপর মারমুখী হয়ে ওঠেন। এ সময় সঙ্গে থাকা সমর্থকেরা মনিরুলকে রক্ষা করেন।

এ সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা স্লোগান বন্ধ করে সবাইকে শান্ত হতে বলেন। কিন্তু কেউ স্লোগান থামাচ্ছিলেন না। একপর্যায়ে রাত সোয়া নয়টার দিকে উত্তেজিত নেতা-কর্মীদের থামাতে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে।

এ সময় পুলিশ মনিরুলকেও সরানোর চেষ্টা করে। তখন তিনি চারটি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা করা না হলে সেখান থেকে যাবেন না বলে জানান। হট্টগোলের মধ্যে রাত সাড়ে নয়টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা ঘোষণা দেন, তাঁরা সব কেন্দ্রের ফল হাতে পেয়েছেন, শিগগির ফল ঘোষণা করা হবে। এরপরই ১০৫টি কেন্দ্রের চূড়ান্ত ফলাফলে আরফানুলকে ৩৪৩ ভোটে মেয়র ঘোষণা করা হয়। তবে শেষ চারটি কেন্দ্রের ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ও বিভ্রান্তি তৈরি হয়।

এ বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা শাহেদুন্নবী চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁর কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘আমি ১০৫টি কেন্দ্রেরই আলাদা আলাদা ফল ঘোষণা করেছি। গন্ডগোলের কারণে হয়তো আপনারা শেষের চারটি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণা শুনতে পাননি।’

ইভিএমে ভোটের পরেও বিলম্বে ফল ঘোষণা নিয়েও বিভ্রান্তি আছে। যদিও রিটার্নিং কর্মকর্তা ভোটের দিন বৃষ্টি, কিছু সময় বিদ্যুৎ না থাকা, চারটার পরেও অনেক কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ এবং দুই প্রার্থীর সমর্থকদের হট্টগোলের কারণে ফলাফল ঘোষণায় বিলম্ব হয়েছে বলে জানান।

ফল ঘোষণার শেষ মুহূর্তে মুঠোফোনে কারও সঙ্গে কথা বলা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রিটার্নিং কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি তখন এসপি-ডিসি মহোদয়কে বলছিলাম যে কীভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তখন সিইসি স্যারের সঙ্গেও কথা হচ্ছিল। স্যারকেও বললাম, সিচুয়েশন এমন। এখানে অন্য কিছু বা একটি ফোনের কারণে কিছু হয়েছে, এমন না।’

যদিও সাবেক মেয়র মনিরুল হক পরাজয় মেনে নিতে নারাজ। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরাজয়ের কারণ কেন বিশ্লেষণ করতাম। নির্বাচনের ফলই তো প্রত্যাখ্যান করি।’