বিএনপির সংলাপ সামনে রেখে অলি-সেলিমের এলডিপি মুখোমুখি

অলি আহমদ ও শাহাদাত হোসেন (সেলিম), এলডিপির এই নেতারা এখন দুই ভাগে বিভক্ত

বিএনপির সংলাপ সামনে রেখে অলি আহমদ এবং আবদুল করিম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেনের (সেলিম) নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) দুই অংশ মুখোমুখি হয়ে পড়েছে। আজ সংবাদ সম্মেলন করে অলির নেতৃত্বাধীন এলডিপির নেতারা সেলিমদের ‘দুষ্কৃতকারী’ বলেছেন। এর জবাবে অলি আহমদের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার মানহানির মামলার হুমকি দিয়েছে সেলিমদের এলডিপি।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপির নেতারা রাজধানীতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে শাহাদাত হোসেন সেলিমদের বিরুদ্ধে এলডিপির নাম ব্যবহার করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগ করেন। বিকেলে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে অভিযোগের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে অপর অংশ।

এলডিপি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল। সম্প্রতি অলি আহমদের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে দলের বড় একটি অংশ আবদুল করিম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে পৃথক এলডিপি গঠন করে তৎপরতা চালাচ্ছে। আব্বাসী অলি আহমদের এলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সেলিম যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। বর্তমানে আব্বাসী এলডিপির একাংশের সভাপতি ও সেলিম মহাসচিব। দুই অংশই বিএনপির সঙ্গে আছে। গত মাসে অলি আহমদের এলিডিপি থেকে ২১৫ জন নেতা একযোগে পদত্যাগ করে সেলিমদের এলডিপিতে যোগ দিয়েছেন।

‘কতিপয় দুষ্কৃতকারী বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে’

আজ সংবাদ সম্মেলনে করে অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপির নেতারা অভিযোগ করেন, দলের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেনসহ কয়েকজন নেতা-কর্মী এলডিপির নাম ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন।

সংবাদ সম্মেলনে অলি আহমদ ছিলেন না। শাহাদাত হোসেনসহ কয়েকজন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজের অভিযোগ করা হয়। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীদের প্রলুব্ধ করে এলডিপির প্যাডে প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতে অভিযুক্ত হয়েছিলেন শাহাদাত হোসেন। সে কারণে ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর এলডিপির জাতীয় সম্মেলনে উপস্থিত হতে না পারায় শাহাদাত হোসেন নির্বাচিত হতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। সেই আক্রোশ থেকেই তিনি এলডিপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে লিপ্ত হন।

কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীর বিক্রম বিএনপি থেকে বেরিয়ে ২০০৬ সালে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে অলি আহমদ দলের প্রেসিডেন্ট ও রেদোয়ান আহমেদ মহাসচিব। রেদোয়ান আহমেদ ছাড়া এলডিপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের আর কেউ এখন অলি আহমেদের সঙ্গে নেই। এলডিপি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত একটি দল, এর প্রতীক ছাতা।

কিছু দিন ধরে ‘কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী’ এলডিপির নামে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়। লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, শারীরিক অসুস্থতা ও ব্যক্তিগত কারণে সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল করিম আব্বাসী ও আবদুল গনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন।

পরে শাহাদাত হোসেন এলডিপির নাম ব্যবহার করে একটি কমিটি গঠন করেন। ওই কমিটির মাধ্যমে শাহাদাত হোসেন নিজেকে মহাসচিব উল্লেখ করে বিভিন্ন অপরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন। তাঁরা সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে একটি নিবন্ধিত ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী ও বেআইনি কাজ করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছেন এবং এলডিপির সুনাম ও ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতি করছেন।

শাহাদাত হোসেনদের এলডিপির নামে কর্মকাণ্ড পরিচালনাকে সম্পূর্ণ অবৈধ দাবি করে অনতিবিলম্বে তা বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়। একই সঙ্গে ‘এই দুষ্কৃতকারীদের’ এলডিপির নেতা পরিচয় দিয়ে সংবাদ পরিবেশন থেকে বিরত থাকতে সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আওরঙ্গজেব বেলাল, মাহমুদ মোর্শেদ ও নেয়ামুল বশির, যুগ্ম মহাসচিব বিল্লাল হোসেন, উপদেষ্টা মাহবুবুর রহমান, আইনবিষয়ক সম্পাদক আবুল হাশেমসহ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

ক্ষমা চেয়ে বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে

পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে অলি আহমদের এলডিপির নেতাদের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া অধিকাংশ তথ্যই ‘মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ’ বলে দাবি করেছে আবদুল করিম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেনদের এলডিপি। তাঁরা এলডিপির নেতাদের লিখিত বক্তব্যকে চরম অসৌজন্যমূলক এবং ‘শব্দ সন্ত্রাস’ আখ্যায়িত করেছেন।

শাহাদাত হোসেনদের এলডিপির যুগ্ম মহাসচিব তমিজ উদ্দিন এই বিবৃতি পাঠান। তাতে এমন বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে এলডিপির এ অংশটি সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, এ রকম মিথ্যাচারের জন্য অনতিবিলম্বে ক্ষমা চাইতে হবে, বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হবে। না হলে শাহাদাত হোসেন সেলিম আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন।

বিবৃতিতে অলি আহমদদের এলডিপির নেতাদের বক্তব্য খণ্ডন করে বলা হয়, ২০১৯ সালের ২৬ অক্টোবর কোনো সম্মেলন ছিল না। সেটা ছিল প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সভা। সেখানে কমিটি গঠন করা হয়, যদিও এর কোনো সুযোগ নেই। ওই সভার বহু আগে থেকেই অলি আহমদের রহস্যজনক রাজনৈতিক কৌশল এবং জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে তাঁর বিষোদ্‌গার, জোটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বক্তব্য এবং সরকারের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগের রাজনৈতিক সত্যতা মেলায় অলি আহমদের নেতৃত্ব থেকে সরে আসেন শাহাদাত হোসেন সেলিম। পরে নেতা-কর্মীদের চাপে তিনি সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল করিম আব্বাসীকে নিয়ে এলডিপির পরিচ্ছন্ন রাজনীতি শুরু করেন।

এত দিন পর শাহাদাত হোসেনসহ কয়েকজন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসীদের প্রলুব্ধ করে এলডিপির প্যাডে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অবান্তর ও জঘন্যতম মিথ্যাচার।

বিবৃতিতে বলা হয়, এলডিপি গঠনে শাহাদাত হোসেন যে প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করেছেন, তা রাজনৈতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত সত্য। এই দল গঠনে সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল মান্নানসহ অনেকে যুক্ত ছিলেন। ফলে এলডিপি একমাত্র অলি আহমদের গৃহস্থালি ঐশ্বর্য, তা একমাত্র আত্মঅহমিকা আর মিথ্যাচারই বটে।

এ ছাড়া সংবাদ সম্মেলনে এলডিপির নামে কার্যক্রম চালানো এবং এর খবর প্রকাশে গণমাধ্যমকে বিরত থাকতে বলাকে হুমকি বলেছে এলডিপির এ অংশ। বিবৃতিতে বলা হয়, গণমাধ্যমকে খবর প্রকাশ থেকে বিরত থাকার বক্তব্য নিঃসন্দেহে আইনবিরোধী ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত। আর রাজনৈতিক দলের নাম অলি আহমদের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে এলডিপির (আব্বাসী-সেলিম) নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সব কার্যক্রম পরিচালনা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

বিএনপি যখন বৃহত্তর ঐক্যের লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে, সে সময় এলডিপির দুই অংশ মুখোমুখি হলো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সংলাপ সামনে রেখে দুই অংশের এই তৎপরতার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে।

অলি আহমদ চাইছেন, বিএনপি যেন আব্বাসী ও সেলিমদের ২০ দলের শরিক হিসেবে স্বীকার না করে এবং তাদের সঙ্গে বৈঠক না করে। আর সেলিমরা চাইছেন, জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে বিষোদ্‌গার এবং জোটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বক্তব্য দেওয়ার জন্য অলি আহমদদের বর্জন করাতে।