সংলাপে বসার সময় আসেনি: রাজ্জাক, সংলাপে বসলে বিএনপি মনে করবে সরকার দুর্বল: তৃণমূল নেতা ওয়াহাব

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জন্য ২০১৬ কেমন ছিল? নতুন বছরে রাজনীতি কোন দিকে যেতে পারে? এসব নিয়ে প্রথম আলো আলাদাভাবে কথা বলেছে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় একজন ও তৃণমূলের একজন নেতার সঙ্গে। এই দুজন হলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য আবদুল ওয়াহাব। আবদুর রাজ্জাক মনে করেন, বিএনপির সঙ্গে সংলাপের সময় আসেনি। আর তৃণমূল নেতা মনে করেন, সংলাপ করলে বিএনপি মনে করতে পারে সরকার দুর্বল। আবদুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবদুর রশিদ। ঢাকা থেকে মুঠোফোনে আবদুল ওয়াহাবের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কাজী আলিম-উজ-জামান
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রাজ্জাক

প্রথম আলো: ২০১৬ সাল আওয়ামী লীগের জন্য কেমন ছিল?

আবদুর রাজ্জাক: আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছি ২০০৯ সাল থেকে। প্রথম পর্যায়ে পাঁচ বছর এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে তিন বছর অতিবাহিত হচ্ছে। এই আট বছরের প্রতিটি বছরই আমাদের অর্জনের বছর, সাফল্যের বছর। তারপরও আমি বলব, ২০১৬ সালে এসে আমাদের অর্জনগুলো অনেক দৃশ্যমান হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে এই ২০১৬ সাল অনেক স্থিতিশীল ছিল। একদিকে অর্থনীতিতে উন্নতি করেছি, অন্যদিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল। মানুষের জীবনে নিরাপত্তা ছিল। দুটি ঘটনা ঘটেছিল, একটা হলো হলি আর্টিজানের ঘটনা, অন্যটি শোলাকিয়ার ঘটনা। দুটিতে ধর্মান্ধরা, জঙ্গিরা সন্ত্রাসী ও নাশকতা কর্মকাণ্ডে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আত্মহননের পথ তারা বেছে নিয়েছিল। জুলাই মাসের ওই ঘটনার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকার ও কর্তৃপক্ষ যেভাবে মোকাবিলা করেছে, মোকাবিলায় যে অগ্রগতি হয়েছে, সেটা প্রশংসার যোগ্য। দেশ এখন অনেকটা শান্ত। আমরা হয়তো ধর্মীয় সন্ত্রাসী বা জঙ্গিদের নির্মূল করতে পারিনি। কিন্তু অনেকটা দুর্বল করা হয়েছে। ২০১৬ সালটি আমাদের জন্য আনন্দের, গৌরবের ও স্বস্তির।

আবদুল ওয়াহাব: অনেক মূল্য দিয়ে হলেও আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। করে চলেছে। আমরা ধন্যবাদ জানাই। কেবল পদ্মা সেতু, ডাবল রেললাইন, ফোর লেন করছে না, গ্রামের ছোটখাটো উন্নয়নও করছে। ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা চুরি (বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি) করে নেওয়া হয়েছে, তারপরও দেশ টিকে আছে। বিএনপির অনেক মানুষও স্বীকার করে, সরকার উন্নয়ন করছে, ভালো করছে। তবে সরকার যদি দেশকে মাদকমুক্ত করতে পারত, তবে আরও ভালো হতো। কারণ, মাদক উন্নয়নকে ধামাচাপা দেয়।

প্রথম আলো: কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি হলো। কমিটিতে তৃণমূলের প্রতিফলন ঘটেছে কি, আপনার কী মনে হয়?

আবদুর রাজ্জাক: আওয়ামী লীগ পরিচালিত হয় একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে। গঠনতন্ত্রে প্রতিটি বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে। সেটার ব্যত্যয় ঘটানোর ক্ষমতা আওয়ামী লীগের কারও নেই, যে যতই ক্ষমতাশালী হোক। যেসব সংগঠন রাষ্ট্রীয় অপশক্তি হিসেবে দেশে এসেছে, সংবিধান লঙ্ঘন করে এসেছে, এই দলগুলো; যাদের জন্ম ক্যান্টনমেন্ট কিংবা পর্দার অন্তরালে কিংবা ষড়যন্ত্র, চক্রান্তের মাধ্যমে, তাদের দল কিন্তু এক ব্যক্তির হাতে। যেমন বিএনপি। আপনারা দেখবেন, খালেদা জিয়া কাউকে ইচ্ছা করলে সাধারণ সম্পাদক করতে পারেন, কাউকে সরিয়ে দিতে পারেন। আবার কমিটিতে এনে নতুন একটি পদ দিতে পারেন। জাতীয় পার্টিও আরেকটি দল। সেটি আরেকজন সামরিক স্বৈরাচার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। সেখানেও একই। কিন্তু আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্ট বলা আছে, কীভাবে কমিটি গঠিত হবে। সুনির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্য দিয়ে যখন দল পরিচালিত হয়, সেখানে তৃণমূলকে বাদ দিয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতেই সবকিছু করা হয়। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রেই আমাদের তৃণমূল নেতাদের অধিকার, দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে বলা আছে।

আবদুল ওয়াহাব: নেত্রী যা মনে করেছেন, তা তৃণমূলেরই মতামত। তৃণমূল থেকে মতামত গেলেও শেখ হাসিনা সভাপতি, কাদের সাহেব (ওবায়দুল কাদের) সেক্রেটারি হতেন। আগের সেক্রেটারির কথা শুনিনি। এখন কাদের সাহেব মাঠেঘাটে ঘুরছেন। তাঁর কথা শুনছি। তবে কমিটি গণতান্ত্রিক পন্থায় না হওয়ায় একটু সমালোচিত তো হয়েছেই। রাজনীতি এখন এমপিদের। এমপি-মন্ত্রীদের তোষামোদ করলে রাজনীতি করা যায়।

প্রথম আলো: আওয়ামী লীগের দলীয় ফোরামে কখনো ভিন্নমত দেখা যায় না। এটা দল ও গণতন্ত্রের কতটা সহায়ক?


আবদুর রাজ্জাক: ভিন্নমত দেখা যায় না কেন? আমি একটা ইস্যু বলি। ২০০৪-০৫ সালের দিকে ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগ একটি সমঝোতা স্মারক করেছিল। এটি আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদে দীর্ঘ আলোচনা হয় এবং তাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করি। সেখানে দু-একজন সদস্য বলেছিলেন যে তাঁর এলাকায় ভোট বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে সব সময় আলাপ করেন। মতামত নেন। ফরমাল ফোরামে যতটা না আলোচনা হয়, ঘরোয়াভাবে আরও বেশি আলাপ-আলোচনা হয়। পঞ্চগড়ের নেতা-কর্মী কী করছেন, সেটাও তিনি জানেন। এমনভাবে খোঁজখবর নেন যে আপনারা চিন্তাও করতে পারবেন না।


আবদুল ওয়াহাব: অবশ্যই ভিন্নমতের দরকার আছে। দলে যদি গণতন্ত্র না থাকে, তবে কীভাবে হবে? সংসদেও গণতন্ত্র নেই। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কথা বলতে পারবে, এ রকম নিয়ম থাকা উচিত। বহুমত থাকা দরকার।

প্রথম আলো: বিএনপি সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসার দাবি জানাচ্ছে। আপনি কি মনে করেন বিএনপির সঙ্গে সরকারের সংলাপে বসা উচিত?


আবদুর রাজ্জাক: বিএনপি কী নিয়ে সংলাপ করতে চাইছে, তা তো আমরা জানি না। সংলাপের এখনো সময় হয়নি। আগামী নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে তখন একটি সরকার থাকবে। কিন্তু সরকার হবে নিরপেক্ষ, নির্বাচনের আগে রুটিন কাজগুলো এগিয়ে নেবে। এর আগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হতেই পারে। কাজেই তখন বিএনপির সঙ্গে প্রয়োজনে আলাপ-আলোচনা হবে। তবে এই মুহূর্তে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা দেখি না।

আখাউড়া রেলওয়ে জংশনের সামনে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল ওয়াহাব। ছবি: প্রথম আলো
আখাউড়া রেলওয়ে জংশনের সামনে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল ওয়াহাব। ছবি: প্রথম আলো

আবদুল ওয়াহাব: বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসা উচিত, এটা আমি মনে করি না। সংলাপে বসলে বিএনপি মনে করতে পারে, সরকার দুর্বল। তারা মাঠ গরম করবে।

প্রথম আলো: নতুন বছরে জাতীয় রাজনীতি কোন দিকে যেতে পারে? আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে কি?

আবদুর রাজ্জাক: ইনশা আল্লাহ অবশ্যই পারবে। আগামী বছর আরও ভালো হবে। গত অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ ভাগের ওপরে। আমার বিশ্বাস, এ বছর এটিকেও ছাড়িয়ে যাবে। এ বছর আরও প্রবৃদ্ধি হবে। আমি মনে করি, ধারাবাহিকতা থাকবে এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি হবে। সামনের বছরটি রাজনৈতিকভাবে আরও বেশি স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করব। আশা করি, দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও শান্তির স্বার্থে সব রাজনৈতিক দল আমাদের সহযোগিতা করবে।

আবদুল ওয়াহাব: দলের কমিটিতে গণতন্ত্র থাকুক, এটা চাই। মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যার সমাধান হোক। প্রয়োজনে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া হোক। ভূমি অফিসে জালিয়াতি সরকার বন্ধ করতে পারেনি। একটা বিষয় বিশেষভাবে বলতে চাই, সরকার যেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা দেয়, তাই সরকার মাদক নির্মূলের দায়িত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ছেড়ে দিক। একটা প্রজ্ঞাপন জারি করুক। দেখি আমরা কতটুকু পারি।

প্রথম আলো: আপনাকে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ।


আবদুর রাজ্জাক: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।


আবদুল ওয়াহাব: প্রথম আলোকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।