ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন মডেল সৃষ্টি হয়েছে

বাংলাদেশকে  ভারত ও ভূটানের স্বীকৃতির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে ডাক বিভাগ থেকে প্রকাশিত একটি স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করা হয়। জাতীয় প্রেসক্লাব, সোমবার
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের  বন্ধুত্ব, শান্তি, সহযোগিতা ও উন্নয়নের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি নতুন মডেল সৃষ্টি হয়েছে। পারস্পরিক সম্পর্কের এই মডেল বিশ্বের অন্যান্য দেশও অনুসরণ করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

আজ সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে বাংলাদেশকে  ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এই মন্তব্য করেন। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ-১৯৭১ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হওয়া এই অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। বিশেষ অতিথি ছিলেন ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী ও ভুটানের রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুইনসেল। অনুষ্ঠানে একটি স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করা হয়।  

প্রধান অতিথি এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতের মিত্রবাহীনির সদস্যদের রক্তেও আমাদের দেশের মাটি সিক্ত হয়েছে। সে কারণে ভারতের সঙ্গে আমাদের রক্তের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া, যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধ করাসহ প্রথম একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশক স্বীকৃতি দেওয়ায় ভারতের কাছে আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন, পাকিস্তানিরা বাঙালির জনযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ বলে প্রচার করছিল। এমন একটি সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর এই স্বীকৃতি এবং তার পরপর সেই দিনই ভুটানের স্বীকৃতি দেশ ও বিদেশে বাঙালিদের জন্য ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় নিশ্চিত হয়েছিল।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ভারতের সঙ্গে গত অর্ধশত বছরের কূটনৈতিক সম্পর্ক নানা চড়াই-উতরাইয়ের ভেতর দিয়ে এগিয়েছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আলোচনার মাধ্যেম উভয় দেশের মধ্যে ছোট-বড় অনেক অস্বস্তিকর বিষয় মিটিয়ে ফেলা হয়েছে। অর্থনীতি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। শুধু ভারত ও ভুটান নয়, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মাধ্যে অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে ভিসা ছাড়াই উভয় দেশের মানুষ অবাধে চলাচল করতে পারবেন এমন দিনের প্রত্যাশা তাঁদের রয়েছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতের সেনাবাহিনী, কর্মকর্তা ও জনসাধারণের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। একই সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

সম্মানিত অতিথি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃতপক্ষে এই দেশের মানুষের জনযুদ্ধ ছিল বলেই ভারতের পক্ষে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল। যুদ্ধের এক বিশেষ মুহূর্তে আমাদের সবার মধ্যেই একটি গভীর প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছিল, ভারত কখন আমাদের স্বীকৃতি দেবে। এটা আমাদের জন্য খুবই জরুরি ছিল। উপযুক্ত সময়েই ভারতের পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের স্বীকৃতির ঘোষণ দিয়েছিলেন। সেটি ছিল আমাদের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এখন সেই দিনটির সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করা আমাদের জন্য সৌভাগ্যেরও।

বিশেষ অতিথি ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন, আজকের এই দিনটি আমাদের উভয় দেশের জন্যই আনন্দের সঙ্গে উদ্‌যাপন করার মতো একটি দিন। অনেকে বলতে চেয়েছেন ভারত পাকিস্তানকে ভাঙার জন্যই এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ভারতের সেই উদ্দেশ্য ছিল না। প্রথমত, তথ্যপ্রমাণে এটা স্পষ্ট যে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনারা এখানে গণহত্যা চালিয়েছিল। এক কোটির বেশি মানুষ জীবন রক্ষার জন্য ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

এই মানুষের অনেকেই ব্রিটিশ ভারতের বাসিন্দা ছিলেন। দেশভাগের পর তাঁরা পাকিস্তানে চলে আসেন। তাঁদের অনেকেরই আত্মীয়স্বজন ভারতে থেকে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ এই দুই দেশের মানুষ কেবল প্রতিবেশীই নন, তাঁদের ভেতরের সম্পর্ক আরও গভীর, অভিন্ন। শুধু গণহত্যার কারণেই নয়, এই মানবিক সম্পর্কের কারণেও তাঁদের আশ্রয় দিতে হয়েছে, পাশে দাঁড়াতে হয়েছে।

ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, এখন নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। বিগত দিনে সম্পর্কে কিছু টানাপোড়েন হয়েছে, কিন্তু অতীতের ঘটনাকে অতিক্রম করে সামনে তাকাতে হবে। আগামী প্রজন্মকে এই দুই দেশের সম্পর্ক আরও সম্মানজনক উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে।

ভুটানের রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুইনসেল বলেন, বাংলাদেশ গত ৫০ বছরে অনেক এগিয়ে গেছে। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বও গভীর হয়েছে। ভবিষ্যতে এই বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র আরও বাড়বে। এই সম্পর্ক ও সহযোগিতা বহু বছর ধরে উদ্‌যাপিত হতে থাকবে। তিনি শহীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে উভয় দেশের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের ভেতর দিয়ে। এরপর মূল প্রবন্ধ পড়েন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের মহাসচিব বিশিষ্ট সাংবাদিক হারুন হাবীব। মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশকে ভারত ও ভুটানের স্বীকৃতি দেওয়ার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে প্রবন্ধে তিনি বলেন, পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিম অংশে আকস্মিক হামলা চালালে মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি বদলে যায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, বাংলাদেশের যুদ্ধ এখন থেকে ভারতেরও যুদ্ধ। গড়ে ওঠে দুই দেশের যৌথ সামরিক কমান্ড। মিত্রবাহিনী একের পর এক পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ৬ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিচার-বিবেচনা করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরে ভুটানও স্বীকৃতি জানায়। এই স্বীকৃতিতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম অভিষেক ঘটে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে বহুদূর এগিয়ে দেয়। সে কারণেই ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রীর সম্পর্ক অমোচনীয় কালিতে লেখা।

এই দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী ও সাংসদ আরমা দত্ত, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মহিউদ্দিন আহমদ। সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কার্যনির্বাহী সভাপতি নুরুল আলম। সঞ্চালনা করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত কামালউদ্দিন।

বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতিদানের অর্ধশত বছর পূর্তি উপলক্ষে ডাক বিভাগ ১০ টাকা দামের একটি স্মারক ডাকটিকিট ও খাম প্রকাশ করেছে। আলোচনা পর্বের পর প্রধান অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন অতিথিদের নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এটি অবমুক্ত করেন।