সুজনের কুমিল্লা জেলা সভাপতি
মেসেজ আসছে চিহ্নিত এলাকায় চাপ সৃষ্টি করার
আর মাত্র দুই পর কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। সেখানকার বর্তমান পরিস্থিতি, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনের অবস্থান, প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থীদের বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) কুমিল্লা জেলা সভাপতি শাহ মো. আলমগীর খান। তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি সেলিম জাহিদ।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: দুই দিন পরই তো নির্বাচন। এখন পর্যন্ত পরিবেশ কেমন দেখছেন?
আলমগীর খান: বাহ্যিক পরিবেশ তো ভালো। এখন পর্যন্ত কোনো গোলযোগ হয়নি। তবে আমাদের কাছে কিছু মেসেজ আসছে, কোনো পক্ষ চিহ্নিত এলাকার কিছু কিছু তার পক্ষে আনার জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। বাস্তবে এটা কতটুকু, এখনো পরিষ্কার নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, এমন একটা কিছু হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: বলছিলেন বিশেষ বিশেষ এলাকায় চাপ সৃষ্টির ম্যাসেজ পাচ্ছেন, সেটা কোন পক্ষ থেকে?
আলমগীর খান: সাধারণত প্রেশার ক্রিয়েট করার ক্ষমতা কারা রাখে? যার পাওয়ার বেশি, যারা ক্ষমতাসীন, তাদেরই হাতেই তো এই ক্ষমতা থাকে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এই জায়গায় সুজনের করণীয় কী, কিছু ভেবেছেন?
আলমগীর খান: আমরা যেটা প্রচার-প্রচারণা করছি, সেটা হলো ভোটাররা যেন ভোটকেন্দ্রে আসে। আমরা বলছি, প্রতীক দেখে ভোট না দিয়ে আপনি দেখুন, যাঁরা দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের মধ্যে স্বচ্ছতা বেশি কার, তাঁর মধ্যে জবাবদিহি থাকবে কি না, তিনি দুনীতি মুক্ত থাকবেন কি না, দেশপ্রেম আছে কি না, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের কি না—এসব দেখে যে ব্যক্তিটাকে আপনার পছন্দ হয়, তাঁকে ভোট দেবেন।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: ভোটার ভোট দিতেই ঘর থেকে বের হলো। কিন্তু পথের বাধা নিয়ে আপনারা কী ভাবছেন?
আলমগীর খান: কেন্দ্রে আসার ক্ষেত্রে যদি প্রতিবন্ধকতা আসে, সে জন্য আমরা প্রচারণা চালাচ্ছি। বলছি, শত বাধা এলেও আপনি আপনার আমানতটা, ভোটটা কেন্দ্রে এসে দিয়ে দেবেন। আমরা ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি, পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলেছি, রিটার্নিং কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি, স্মারকলিপি দিয়েছি। রিটার্নিং কর্মকর্তাকে বলেছি, পুলিশ বিভাগ যদি আপনাকে সেভাবে সহযোগিতা না করে, যতই ক্যামেরা লাগান, কাজ হবে না।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: পুলিশ বিভাগ ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে বলে মনে হচ্ছে?
আলমগীর খান: পুলিশের মুভমেন্ট কিন্তু এখন পর্যন্ত ঠিক আছে। তারা মাঠপর্যায়ে ভালো মুভমেন্ট নিয়ে কাজ করছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার গতকালও কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে, কাউকে ছাড় দেবেন না; সরকারি দল হোক, তিনি যে ব্যানারেই নির্বাচন করেন না কেন। কাউকে তিনি (সিইসি) ছাড় দেবেন না। প্রশাসনের প্রতিও তিনি অনেক চাপ সৃষ্টি করেছেন।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: নতুন কমিশন এসেই কুমিল্লা সিটির নির্বাচন করেন এবং সেটা ভালো নির্বাচন হয়। এবার?
আলমগীর খান: এবারও আমরা আশা করছি ভালো নির্বাচন হবে। প্রশাসন আমাদের সেভাবে আশ্বস্ত করছেন। আমরাও ভোটারদের কাছে যখন যাচ্ছি, তাঁরাও উদ্বুদ্ধ যে হ্যাঁ, আমরা ভোট দিতে পারব। আমরা চাই ভয়ভীতি কাটিয়ে তাঁরা যেন কেন্দ্রে আসতে পারেন। কারণ, আমরা ভালো মেয়র চাই।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: আলোচনা আছে, এ নির্বাচন স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের জন্য ভাবমূর্তির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক তাঁরই অনুগত এবং পছন্দের প্রার্থী। নির্বাচনে আরফানুল হারলে বাহারই রাজনৈতিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এ কারণে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে অনেকে সংশয়ে আছেন। আপনি কী মনে করেন?
আলমগীর খান: আমি এখনো আশা করি নির্বাচনটা সুষ্ঠু হবে। আর আপনি যে কথা বলেছেন, স্বাভাবিকভাবে আমি যখন আমার পছন্দের মানুষকে দিয়ে নির্বাচন করব, প্রচেষ্টা থাকবে আমার মানুষটিকে কীভাবে ওই চেয়ারে বসাতে পারি। আমার যত রকমের কৌশল অবলম্বন করা দরকার, যেহেতু আমি ক্ষমতায় আছি, সেহেতু সব পলিসি অ্যাপ্লাই করে আমার নির্ধারিত প্রার্থীকে জয়লাভ করিয়ে আনা—এ হতে পারে।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: কেমন মেয়র চান?
আলমগীর খান: সুজন চায় দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহি থাকবে, স্বচ্ছতা থাকবে—এমন মেয়র। সিটি করপোরেশনের যে বাজেট থাকবে, প্রকল্পগুলো আসবে, সেটা সঠিকভাবে ব্যয় হবে, আমরা সেটাই চাই এবং মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করি। নির্বাচনে একজন সরকারি দলের প্রার্থী। তিনি কিন্তু প্রটোকল পোস্ট নিয়ে আছেন। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং কুমিল্লা জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তাঁর এই কর্মের মধ্য দিয়ে কিছুটা তো জনগণের টাচে আছেন। আরেকজন আছেন কায়সার (মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন), তিনি নতুন। আর সাবেক মেয়র (মনিরুল হক সাক্কু) সম্পর্কে সবাই জানেন, যিনি দুবার মেয়র ছিলেন, একবার পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৫ বছর ধরে সিটি করপোরেশনে আছেন। একটা গাছ লাগালে এটি যতই দুর্বল হোক, ১৫ বছরে কিন্তু শিকড় অনেক ভেতরে ঢুকে যায়। সেটা উপড়ে ফেলা কিন্তু এত সহজ নয়।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: সাবেক মেয়রের কর্মকাণ্ডে নাগরিক–সমাজ সন্তুষ্ট? তাঁর কার্যক্রম সম্পর্কে সংক্ষেপে বলুন।
আলমগীর খান: সাবেক মেয়র কাজ করেনি, সেটা বলা যাবে না। তিনি কিছু না কিছু কাজ করেছেন। তবে কাজের স্বচ্ছতাটা সঠিকভাবে প্রমাণ করা তাঁর জন্য খুব কঠিন হবে। কারণ, আপনি যদি ড্রেনের জলাবদ্ধতা, ফুটপাতগুলো এবং ময়লা-আবর্জনার চিহ্নিত জায়গাগুলো দেখেন, তিনি যে কমিটমেন্ট দিয়েছিলেন, সেটা তিনি সেভাবে করতে পারেননি। এটা তিনি নিজেও বলছেন, এটা বাস্তব। আর যেগুলো করেছেন, তিনি যাঁদের দিয়ে করিয়েছেন টেন্ডারের মাধ্যমে হয়তো। এ জায়গায় যেটা আমরা বলি, দুর্নীতিগ্রস্ত যদি না হতো, অর্থাৎ ১০০ টাকার টেন্ডারের যদি ৭০ টাকার কাজও হতো, তাহলে এই টাকায় (যে টাকায় পদ্মা সেতু করা হয়েছে) এ রকম পদ্মা সেতু আরও দুটি করা যেত। কিন্তু আমাদের দেশের কাজগুলো তো সে মানের হচ্ছে না। যার কারণে আমরা নাগরিক–সমাজের পক্ষ থেকে মেয়রকে প্রায়ই বলতাম, আপনি যাদের দিয়ে কাজ করাচ্ছেন, নিজে একটু মনোযোগ দেন, আপনার পরিষদকে বলেন দেখাশোনা করতে। কিন্তু সে জায়গাটুকুতে তিনি সাবলীলভাবে শক্ত হতে পারেননি। কেন হতে পারেননি, তিনি সেটা ভালো জানেন। এটা কি তাঁর কাউন্সিলরদের কারণে? না তাঁর ওপরের লেভেলে আরও কেউ ছিলেন, তাঁদের জন্য পারেননি, সেটা তিনি ভালো বলতে পারবেন। তবে আমাদের কাছে মনে হয়েছে, তাঁর কোথাও না কোথাও একটু দুর্বলতা ছিল। এই দুর্বলতার কারণে স্বচ্ছতার জায়গা থেকে তাঁকে অনেক সময় সরে যেতে হয়েছে। সে কারণেই হয়তো তিনি (সাক্কু) বলেছেন, আমি অনেক কাজ করেছি, অনেক কাজ করতে পারিনি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: নির্বাচন কমিশন সব কেন্দ্রে সিসিটিভি বসাবে। একটি ভালো নির্বাচনের জন্য কমিশনের এ পদক্ষেপকে কীভাবে দেখছেন?
আলমগীর খান: পদক্ষেপটা খারাপ নয়, ভালো। বরং আমরা বলছি, আপনারা পারলে আরেকটা বসান। যে মানুষ (ভোটার) কেন্দ্রে ঢুকলেন ভোট দেওয়ার জন্য, আসলেই তিনি ভোট দিচ্ছেন কি না। বাইরে আরেকটি ক্যামেরা বসালে আদৌ আমি ভোট দিলাম কি না, সেটা শতভাগ প্রুভড হবে। সে প্রস্তাবও আমরা রিটার্নিং কর্মকর্তার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে দিয়েছি।
প্রশ্ন :
প্রথম আলো: এবার পুরো ভোট ইভিএমে (ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন) হবে, এ বিষয়ে আপনাদের পর্যবেক্ষণ কী?
আলমগীর খান: ইভিএম নিয়ে যখন আমরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলি, তখন তাদের ধারণা, ইভিএমে ভোট কারচুপি হতে পারে। আমি দেব (ভোট) হাঁস মার্কায়, চলে যাবে মোরগে। কেন এ ধারণা? তারা বলছে, এ রকম বিগত দিনে হয়েছে। মানুষ মনে করে, তারা যদি মেশিনটা এ রকম করেই রাখে, আমি যতই হাঁসে দেব, ততই মোরগে যাবে। এ রকম একটা সন্দেহ কিন্তু আছে। এই সন্দেহটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের এক সদস্য। তিনি বলেছেন, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে একজন ডাকাত থাকে। ডাকাতটা কে? ডাকাতকে তো চিহ্নিত করতে হবে। এই ডাকাত যদি কেন্দ্রে থেকেই থাকে, তাহলে আমি–আপনি কীভাবে নিরাপদে ভোটটা দেব?