রেলপথ নিয়ে সিলেটের রাজনীতিতে ‘আফাল’

এক পক্ষে পরিকল্পনামন্ত্রী। অন্য পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সুনামগঞ্জের পাঁচ সাংসদ। প্রকল্পের সমীক্ষা এখনো শেষ হয়নি।

এম এ মান্নান, এ কে আব্দুল মোমেন

প্রকল্পটি রেল যোগাযোগের। রেলের চলমান প্রকল্পগুলোর তুলনায় এটি বেশ ছোট। কিন্তু শুরুর আগেই প্রকল্পটি উত্তাপ ছড়াচ্ছে অনেক। ছাতক থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইনটি কোন এলাকা দিয়ে যাবে, তা নিয়েই বেধেছে গোল। সুনামগঞ্জের এক মন্ত্রী আর পাঁচ নেতার এ দ্বন্দ্বে সিলেট থেকে এসে যুক্ত হয়েছেন আরেক মন্ত্রী। এখন সমীকরণ দাঁড়িয়েছে পরিকল্পনামন্ত্রী বনাম পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সুনামগঞ্জের পাঁচ সাংসদ।

কী সেই প্রকল্প? সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক পর্যন্ত ১৯৫৪ সাল থেকেই রেললাইন আছে। একে সুনামগঞ্জ সদর পর্যন্ত টেনে নিয়ে জেলা সদরকে রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত করাই প্রকল্পের লক্ষ্য। এটা স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবিও। ২০১১ সালে এ নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়। ২০১৯ সালে প্রায় ১০ কোটি টাকার সমীক্ষা প্রকল্প শুরু হয়। আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা।

তাহলে এখনই কেন দ্বন্দ্ব? স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্র বলছে, সুনামগঞ্জে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সঙ্গে জেলার পাঁচ সাংসদের দ্বন্দ্ব পুরোনো। গত বছর সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচন নিয়ে একবার প্রকাশ্য হয়েছিল তাঁদের মতবিরোধ। রেলের প্রকল্প নিয়েও চলছে একই রকম মতবিরোধ। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন পাঁচ সাংসদের পক্ষ নিয়ে যেন আগুনে ঘি ঢেলেছেন। দলের স্থানীয় নেতারা মনে করছেন, সিলেটের নিস্তরঙ্গ রাজনীতিতে হঠাৎই হাওরের আফাল (ঢেউ) দেখা দিয়েছে রেলপথ নিয়ে।

হঠাৎ পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন যুক্ত হলেন? এ নিয়ে পাওয়া গেছে একাধিক মত। তবে বিবদমান দুই পক্ষসহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা মনে করছেন, সিলেট থেকে সব সময় অন্তত একজন জাতীয় পর্যায়ে নেতা থাকে বা হওয়ার চেষ্টা চলে। এ নিয়ে সব সময় দলে একাধিক নেতার বিরোধও ছিল। কিন্তু এবারই প্রথম আওয়ামী লীগে সিলেট থেকে এমন নেতা নেই। সাম্প্রতিক সময়ে এমন চেষ্টাও দেখা যায়নি। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আকস্মিক এ পদক্ষেপকে পুরো বিভাগের নেতা হওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন স্থানীয় রাজনীতিকেরা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিলেট সদর আসনের সাংসদ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুনামগঞ্জের যে পাঁচ সাংসদের পক্ষ নিলেন, তাঁরা হলেন জয়া সেনগুপ্ত, মহিবুর রহমান, পীর ফজলুর রহমান, মোয়াজ্জেম হোসেন ও শামীমা আক্তার খানম (সংরক্ষিত)। এর মধ্যে পীর ফজলুর রহমান জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সাংসদ। বাকি সবাই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাংসদ। ৬ জুন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলামকে আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দেন এই পাঁচ সাংসদ। ১০ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেল প্রকল্পের পথ নিয়ে সুনামগঞ্জের পাঁচ সাংসদের দাবি যৌক্তিক বলে রেলমন্ত্রীকে চিঠি দেন। সাংসদদের পছন্দমতো ছাতক-দোয়ারাবাজার-সুনামগঞ্জ সদর থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। তারপর ১৪ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। গত রোববার ফেসবুকেই এ স্ট্যাটাসের জবাব দেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

প্রকল্পের অবস্থা

প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০১১ সালে রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর সুনামগঞ্জ সদরের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপনের দাবি জোরালো হয়। ২০১২ সালে ছাতকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সুনামগঞ্জ সদরে রেলপথ সম্প্রসারণের ঘোষণা দেন তিনি। এরপর রেলের কর্মকর্তারা একাধিকবার এলাকাটি পরিদর্শন করেন। সম্ভাব্য পথ নিয়ে প্রাথমিক সমীক্ষা চালান। এরপর এম এ মান্নান পাঁচ বছর অর্থ প্রতিমন্ত্রী, পরে পরিকল্পনামন্ত্রী হয়ে রেললাইন স্থাপনের বিষয়ে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কথা জানান।

২০১৫ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে ইকোসার্ভ ইঞ্জিনিয়ারিং নামের বাংলাদেশি একটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে জরিপ করায়। তারা সম্ভাব্য তিনটি পথ সুপারিশ করে। তিনটি পথই ছাতক থেকে দোয়ারাবাজার হয়ে সুনামগঞ্জ শহর পর্যন্ত। পথগুলোর দূরত্ব ২৭ থেকে সাড়ে ২৮ কিলোমিটারের মধ্যে। এরপর বিষয়টি আর এগোয়নি।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই ও বিশদ নকশা প্রণয়নের জন্য গত বছরের ৯ জুলাই চীনের সিএইচইসির-বাংলাদেশের মজুমদার এন্টারপ্রাইজের (যৌথ) সঙ্গে চুক্তি সই করে রেলওয়ে। তারা প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে। এরই মধ্যে কয়েকটি সম্ভাব্য পথ পর্যালোচনা করে প্রাথমিকভাবে একটি পথকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এটি হচ্ছে ছাতকের আফজালাবাদ স্টেশন থেকে গোবিন্দগঞ্জ, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জ শহর। এ পথের দূরত্ব হবে ৪৩ কিলোমিটার।

এ প্রাথমিক পথেরই বিরোধিতা করছেন সুনামগঞ্জের পাঁচ সাংসদ। তাঁরা দাবি করছেন, এ পথ ধরে রেললাইন নির্মাণ হলে তা পরিকল্পনামন্ত্রীর এলাকা দিয়ে যাবে। এর আগে এই সাংসদদের বিরোধিতার কারণে সুনামগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান বদল করা হয়েছিল।

রেলের এ প্রকল্পের পরিচালক মহিউদ্দিন আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, দোয়ারাবাজার দিয়ে রেলপথ নেওয়া হলে তা হাওরের মাঝখান দিয়ে যাবে। এতে হাওর ও এর জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবে। বিকল্প হিসেবে উড়ালপথে রেললাইন নির্মাণের চিন্তা করা হয়েছিল। তবে তা খুবই ব্যয়বহুল। এ জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হাওরকে পাশ কাটিয়ে এবং বেশি লোকালয় আছে, এমন পথের প্রাথমিক সুপারিশ করেছে। তিনি জানান, প্রকল্পের নকশা চূড়ান্ত হয়নি। ফলে কত টাকা ব্যয় হবে, সেটাও ঠিক হয়নি।

তবে সুনামগঞ্জের স্থানীয় সাংসদদের দাবি, পরিকল্পনামন্ত্রীর কথায় রেলপথ মন্ত্রণালয় আগের পথ বদলানোর উদ্যোগ নিয়েছে। তাই এর বিরোধিতা করে তাঁরা চিঠি দিয়েছেন রেলমন্ত্রীকে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেলপথ কোন দিকে হবে, এ বিষয়ে রেলমন্ত্রীকে আমি কোনো চিঠি লিখিনি। মৌখিকভাবেও কিছু বলিনি। আমাকে একবার এক বৈঠকে দাওয়াত দিয়েছিল। সেখানে কয়েকটি বিকল্প পথ দেখান রেলের কর্মকর্তারা। আমি বলেছি, আমার কোনো পছন্দের পথ নেই। যেভাবে হলে মানুষের উপকার হয়, সেভাবেই হোক।’ তিনি দাবি করেন, এখন যে রেলপথের প্রস্তাব এসেছে, তাতে তাঁর এলাকায় মাত্র তিন কিলোমিটার। মহিবুর রহমানের নির্বাচনী এলাকায় ১২ এবং পীর ফজলুর রহমানের এলাকায় ১০ কিলোমিটার পড়েছে।

এলাকার সাংসদদের সঙ্গে মতবিরোধ সম্পর্কে এম এ মান্নান বলেন, তিনি পুরো জেলার উন্নয়নে, গরিব মানুষের উপকারে কাজ করছেন। এতে অন্য সাংসদেরা কেন ক্ষুব্ধ হচ্ছেন, তা তাঁর বোধগম্য নয়।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্পৃক্ততার বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দেখা–সাক্ষাৎ হয়। তাঁকে কিছু না বলে রেলমন্ত্রীকে ডিও লেটার দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অনুলিপি দেওয়া হয়েছে সুনামগঞ্জের পাঁচ সাংসদকে। কিন্তু তাঁকে (পরিকল্পনামন্ত্রী) দেওয়া হয়নি। এ থেকেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশ্য বোঝা যায়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বিদেশে আছেন। গত রাতে তাঁর দেশে আসার কথা। এ অবস্থায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

শুরুটা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে

গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বিল সংসদে ওঠে। বিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান উল্লেখ ছিল না। পরে বিলটি এ-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়টি দক্ষিণ সুনামগঞ্জের স্থাপনের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। সুনামগঞ্জের সাংসদদের দাবি, পরিকল্পনামন্ত্রী নিজ এলাকার নাম যুক্ত করেছেন। পরে অবশ্য এ নিয়ে স্থানীয়ভাবে পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া চলে। এ পরিস্থিতিতে বিতর্ক তৈরি হলে জেলা আওয়ামী লীগ এক জরুরি সভায় বসে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়টি সুনামগঞ্জ ‘দেখার হাওর’ পাড়ে স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। পরে সে সিদ্ধান্তের একটি কপি দলের নেতারা দলীয় প্যাডে লিখিতভাবে পরিকল্পনামন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। জেলা আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করেন বাকি পাঁচ সাংসদ। জেলা আওয়ামী লীগের এ সিদ্ধান্ত এবং সাংসদদের মতামত লিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রীকেও অবহিত করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়টি ‘দেখার হাওর’ পাড়ে স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ও সময় থেকেই পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের সঙ্গে জেলার অন্য সাংসদদের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্র বলছে, দেখার হাওরটি সদর উপজেলা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, ছাতক ও দোয়ারাবাজার—এ চার উপজেলাকেই যুক্ত করেছে। ফলে দেখার হাওরের কোন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় হবে, এটা নিয়ে এখনো স্থানীয়ভাবে জটিলতা আছে। কারণ, সব সাংসদই নিজ নির্বাচনী এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি চাইছেন।

সুনামগঞ্জ টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট স্থাপিত হচ্ছে মন্ত্রীর নিজে উপজেলা দক্ষিণ সুনামগঞ্জে। সাংসদেরা মনে করছেন, সবকিছু মন্ত্রীর এলাকায় হচ্ছে।

মন্ত্রিসভার একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ছোট একটা বিষয়ে দুজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী এভাবে ফেসবুকে কথার লড়াইয়ে জড়াবেন—এটা কিছুটা অস্বাভাবিক। এর মধ্যে রাজনীতি আছে। সিলেটের জাতীয় নেতাদের প্রায় সবাই প্রয়াত হয়েছেন। এ শূন্যস্থান পূরণে হয়তো ভেতরে-ভেতরে মন্ত্রী-সাংসদদের মধ্যে একধরনের প্রতিযোগিতা আছে। স্থানীয় রাজনীতির বিভক্তিও এর পেছনে কাজ করছে।