সংসদে দলিতদের প্রতিনিধিত্ব করতে চান বনানী

বনানী বিশ্বাস। ছবি: দীপু মালাকার
বনানী বিশ্বাস। ছবি: দীপু মালাকার

বনানী বিশ্বাস। তাঁর নামের সঙ্গে দলিত, নমশূদ্র, মতুয়া শব্দগুলো যুক্ত আছে। আর শুধু এই শব্দগুলোর জন্যই তিনি হয়ে যান ‘অস্পৃশ্য’। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। দেশে এ পর্যন্ত অনেক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু জন্ম ও পেশাগত কারণে বৈষম্য এবং বঞ্চনার শিকার দলিতদের অধিকার নিয়ে তেমনভাবে কেউ কথা বলেনি। সংসদ, গণমাধ্যম কোথাও এই দলিতরা প্রাধান্য পায় না। তাই জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে নিজেদের বৈষম্যের কথা তুলে ধরতে চান বনানী বিশ্বাস।

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন বনানী বিশ্বাস। তিনি ছাড়াও ঋষি সম্প্রদায়ের ধরা দেবী দাস, হরিজন সম্প্রদায়ের সুচিত্রা রানী ভক্ত এবং মণি রানী মনোনয়ন ফরম কিনেছেন।

বনানী বিশ্বাস বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ইচ্ছে করলেই আমাদের চারজনের মধ্য থেকে একজনকে সংরক্ষিত আসনের জন্য মনোনীত করতে পারে। এটি করলে দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আওয়ামী লীগ ও সরকারের ভাবমূর্তিতেই বাড়তি কিছু যোগ হবে। প্রশংসিত হবে সব জায়গায়।’

মনোনয়ন ফরম কেনাসহ বনানী বিশ্বাসকে সার্বিক সহায়তা দিয়েছেন ২০১৯ সালকে জাত-পাতবিরোধী বর্ষ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া দলিত ১৯টি সংগঠনের প্রতিনিধিরা। বনানী বলেন, সংগঠনের প্রতিনিধিদের মধ্যে কেউ কেউ ১০০ টাকা করে দিয়েও সহায়তা করেছেন।

বনানী বিশ্বাস দলিতদের সংগঠন ‘অভিযান’-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ১২টি দলিত সংগঠনের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ দলিত উইমেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি খুলনার বিএল কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ করেছেন। বাবা ভরত চন্দ্র বিশ্বাস তাঁর গ্রামের প্রথম বিএ পাস ছিলেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। দুই ভাইও পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছেন। বনানীর স্বামী তন্ময় বিশ্বাস কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একটি কোম্পানিতে কর্মরত। তাঁদের সাত বছর বয়সী এক মেয়ে আছে।

বনানী বলেন, দলিত কোনো সম্প্রদায়ের নাম নয়, এটি হচ্ছে রাজনৈতিক পরিচিতি। ভারতের সংবিধান রচয়িতা বাবা সাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকর ছোট ছোট সম্প্রদায়, যারা দলিত-মথিত—তাদের দলিত নামকরণ করেন। জাতিসংঘও এ নামেই স্বীকৃতি দিয়েছে।

বনানীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনার একটি গ্রামে। শুধু দলিত হওয়ার কারণে এবং মুসলমানসহ গ্রামের অন্য সম্প্রদায়ের চাপে এবং ভয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থা থেকে বনানীকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে পরিবার। বনানী বলেন, ‘দলিতদের মধ্যে শিক্ষিত একটি পরিবারেরই চিত্র এটি। চাচাতো বোনেরা মিলে আমরা ছিলাম ১৩ বোন। ৯ জনেরই বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরের কম বয়সে। আর যে দলিত পরিবারে শিক্ষার ছোঁয়া লাগেনি সেখানে একটি কিশোরীকে কিসের মধ্য দিয়ে বড় হতে হয়, তা সহজেই অনুমেয়।’

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন বনানী বিশ্বাস। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন বনানী বিশ্বাস। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

বনানী বলেন, সাম্প্রদায়িকতার ভয়কে তোয়াক্কা না করে, ‘বুড়ি’ হয়ে গেছেসহ বিভিন্ন সামাজিক বাধাকে পাত্তা না দিয়ে অষ্টম শ্রেণি থেকে শুরু করে এমএ পর্যন্ত নিজেই প্রায় ১০০টি বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন বিভিন্ন কৌশলে। সে জন্য পরিবার এবং সমাজ থেকে নানা কটূক্তি শুনতে হয়েছে। তবু দমে যাননি। তাই সাংসদ হতে পারলে প্রথমেই দলিত শিশুদের লেখাপড়ার দিকে নজর দেবেন বলে জানালেন। এরপরই বাল্যবিবাহ ও যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে কাজ করবেন। বর্তমানে দলিতদের সুদে টাকা নিয়ে হলেও যৌতুক দিতে হচ্ছে বলে জানালেন বনানী।

বনানী বলেন, দলিতরা নিজেদের এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত যে বৈষম্যের শিকার হয়, বলতে গেলে তার আর শেষ নেই। হরিজনদের কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। ঢাকার বাইরে ডোম-সুইপাররা হোটেলে বসে খেতে পারে না, বাড়ি থেকে গ্লাস, প্লেট নিয়ে বাইরে বসে খেতে হয়। গোত্র ভেদে বৈষম্য নানা রকম। উচ্চবর্ণের কেউ নমশূদ্রের মেয়েকে বিয়ে করে না। দলিত নারীরা উচ্চশিক্ষিত হলেও শুধু গোত্রের জন্য কম শিক্ষিত ছেলেকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। আর সমাজের কাছে দলিত মানেই অস্পৃশ্য।

নিজের উদাহরণ দিয়ে বনানী বলেন, ‘আমি শিক্ষিত, বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে কথা বলি। প্রথম দিকে যখন পরিচয় জানে না তখন অনেকে একরকম আচরণ করেন। আর যখন জানেন আমি দলিত নারী, তখন ওই ব্যক্তিদেরই আচরণ পাল্টে যায়। ছোটবেলায় স্কুলে অন্যরা সহজে আমার সঙ্গে মিশতে চাইত না, অথচ শিক্ষাদীক্ষায় কোনো অংশেই পিছিয়ে ছিলাম না। শুধু সমস্যা আমাদের নিচু জাত।’

সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ বলছে, বাংলাদেশে প্রায় ১৩ লাখ ২৯ হাজার ১৩৫ জন অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং ৭৫ হাজার ৭০২ জন বেদে জনগোষ্ঠী রয়েছে। জেলে, সন্ন্যাসী, ঋষি, বেহারা, নাপিত, ধোপা, হাজাম, নিকারী, পাটনী, কাওড়া, তেলী, পাটিকর, বাশফোর, ডোমার, রাউত, তেলেগু, হেলা, হাড়ি, লালবেগী, বাল্মিকী, ডোম ইত্যাদি তথাকথিত নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠীকে এ অনগ্রসর সম্প্রদায়ভুক্ত করেছে সমাজসেবা অধিদপ্তর। তবে বেসরকারি হিসাবে ৬৫টি গোত্রে দেশে দলিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। দলিত নারীদের পক্ষ থেকে এবারই প্রথম চারজন সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন পেতে ফরম কিনলেন।

বনানী বলেন, দলিত জনগোষ্ঠীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা হয়, ফলে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ কম। অর্থ ও প্রতিপত্তিও নেই। তাই দলিতদের কেউ সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জিতে আসবেন সে আশা করার মতো সময় আসেনি। তবে দলিত নারীদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়ন পাওয়া একটি সুযোগের ব্যাপার। দল চাইলে মনোনয়ন দিতে পারে।

বনানীর মতে, ‘আমাদের বড় একটা দাবিই হচ্ছে সব রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন কমিটিতে একজন করে দলিত প্রতিনিধি রাখতে হবে। আর এই প্রক্রিয়া শুরু হলে রাজনীতিতে আমাদের অংশগ্রহণও বাড়ানো সম্ভব হবে। এখন কোনো কোনো সংগঠন কথা বলার জন্য আমাদের ডাকে। আমরা কথাও বলি। কিন্তু গণমাধ্যমে তা তেমনভাবে জায়গা পায় না। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিও আকর্ষণ করতে পারি না। সুইপাররা অন্যদের টয়লেট পরিষ্কার করেন, আর আমাদের একেকটা সুইপার কলোনি একেকটা নর্দমা। পুনর্বাসন না করে দলিতদের উচ্ছেদ চক্রান্ত চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সুইপারদের জাত ব্যবসাও এখন হাতছাড়া। মুসলমানেরা ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা দিয়ে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাকরি নিচ্ছে। কিন্তু ঠিকা কাজ করে দিচ্ছেন সুইপাররা। সুইপারদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হলেও শুধু একটি ঘরের জন্য জাত পেশায় ঢুকতে বাধ্য হচ্ছেন।’

বনানী জানালেন, কয়েক বছর ধরে বৈষম্য বিলোপ আইনের খসড়া ঝুলে আছে। নির্বাচনের আগে ও পরে সহিংসতার শিকারে দলিতরা এগিয়ে থাকে। নাসিরনগরে জেলে পাড়া, অভয়নগরে ঋষি পাড়া আক্রমণ তার উদাহরণ। দলিত নারীদের ধর্ষণের বিচার হয় না। এ পর্যন্ত যশোরে ধর্ষণের শিকার ঋষি সম্প্রদায়ের এক নারীকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ শতক জমি দেওয়া হয়েছে।

বনানী বিশ্বাস বলেন, ‘আমাদের নিজেদের কথা নিজেদেরই বলতে হবে। বিভিন্ন সরকারের নেতা, মন্ত্রীরা যদি আমাদের নিয়ে কথা বলতেন, তাহলে আমাদের অবস্থা এত খারাপ থাকত না। আওয়ামী লীগের হাতে আছে সংরক্ষিত নারী আসনের ৪৩টি আসন। দলটি ইচ্ছে করলেই একটি আসন আমাদের জন্য ছেড়ে দিতে পারে।’