সমাজটা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে: মেনন

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অজয় রায়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অজয় রায়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানের অতিথিরা। ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সমাজটা ক্রমাগত অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। সামাজিক মূল্যবোধের বিপর্যয় ঘটছে। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের চেহারাটা কেমন হবে, তা ভেবে পাচ্ছি না।’

মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অজয় রায়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন মেনন। রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় গণগ্রন্থাগারের সেমিনার হলে আজ বৃহস্পতিবার সকালে এ স্মরণসভার আয়োজন করা হয়। আয়োজক তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংগঠন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন।

২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর প্রয়াত হন বাংলাদেশের বাম-প্রগতিশীল আন্দোলনের পুরোধা-ব্যক্তিত্ব অজয় রায়। ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা প্রমথ নাথ রায় ভারতের বারানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ভাষার অধ্যাপক ছিলেন। ছাত্রজীবনের মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হন অজয় রায়।

জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তিনি। পার্টির মুখপত্র সাপ্তাহিক ‘একতা’র সম্পাদক ছিলেন অনেক দিন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন স্নাতকে। কারাবন্দী অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অর্জন করেন মাস্টার্স ডিগ্রি। তাঁর লেখা অনন্য একটি বই ‘বাংলা ও বাঙালি’। ইতিহাস, অর্থনীতি ও রাজনীতির এমন অনেক গ্রন্থের লেখক তিনি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়। ১৯৯৮ সালে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। আমৃত্যু সেই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। ২০১০ সালে ‘সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠা করেন।

আজ অজয় রায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর অসাম্প্রদায়িক আদর্শের কথা স্মরণ করেন গুণমুগ্ধ ভক্ত, রাজনীতি ও সামাজিক নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা। শুরুতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানস্থলে রাখা তাঁর ছবিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অজয় রায়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ছবি: প্রথম আলো
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অজয় রায়ের তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ছবি: প্রথম আলো

স্মরণ অনুষ্ঠানে বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা নিয়ে হতাশার নানা চিত্র তুলে ধরে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘অজয় রায়ের সারা জীবনের সংগ্রাম ছিল সহিষ্ণু সমাজের নির্মাণ। এই পরিস্থিতির মধ্যে অজয় রায় আমাদের অনুপ্রেরণা জোগান প্রতিনিয়ত।’

অজয় রায়ের স্মৃতিচারণা করেন তাঁর বন্ধুভাজন সহযোগী সাবেক বিচারপতি কাজী এবাদুল হক। সমাজের দরিদ্র মানুষের বিপদে-আপদে অজয় রায় কীভাবে প্রত্যক্ষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন, সেসব ঘটনা তুলে ধরেন তিনি। এবাদুল হক বলেন, মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। অনেক রাজনৈতিক নেতাকেই দেখেছি, ক্ষমতায় গিয়ে মানুষের জন্য কিছু করার কথা বলতেন সব সময়। অজয় রায় ক্ষমতায় না থেকেও মানুষের কল্যাণে ব্রতী ছিলেন।

বাংলাদেশকে ঘিরে অজয় রায়ের নানা ভাবনা ও উদ্বেগের কথা স্মরণ করেন তাঁর নিকটজন ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারোয়ার আলী। তিনি বলেন, ‘সমাজে যে বৈষম্য আছে, তা থেকে মানুষকে মুক্ত করে একটি মানবিক সমাজ নির্মাণই অজয় রায়ের লক্ষ্য ছিল। রাজনীতির বাইরে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষকে সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত করার লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন আমৃত্যু। ছিলেন এক মানবদরদি মানুষ।’

সারোয়ার আলী বলেন, মুদ্রার এক পিঠের সঙ্গে অন্য পিঠের ব্যবধান অনেক। একদিকে উন্নয়ন চলছে, সামাজিক নানা সূচকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে রাজনীতিক, প্রশাসন ও অপরাধী চক্র মিলে এক দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে। এর কারণে সাধারণ মানুষ অতিষ্ঠ। এখন মনে হচ্ছে, খোদ মুদ্রাটাই না অচল হয়ে যায়।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সদস্যসচিব অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে অজয় রায়কে আমরা শিক্ষক হিসেবে পাইনি। তিনি রাজনীতির মানুষ শুধু ছিলেন না, ছিলেন বিশুদ্ধ শিক্ষক।’

অজয় রায়ের ছবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের শ্রদ্ধা। ছবি: প্রথম আলো
অজয় রায়ের ছবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠনের শ্রদ্ধা। ছবি: প্রথম আলো

আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সভাপতি জিয়াউদ্দিন তারেক আলী বলেন, অজয় রায় ছিলেন নিখাদ মানবতাবোধসম্পন্ন মানুষ। সম্প্রদায় ও শ্রেণি বিভাজনের বাইরে গিয়ে বৃহত্তর মানুষ ছিল তাঁর ভাবনার কেন্দ্রে।

অজয় রায় সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন। প্রথা অনুযায়ী দাহের মাধ্যমেই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁর অন্তিম ইচ্ছা ছিল, বাংলাদেশের মাটিতে তাঁর দেহ মিশে যাক। সে জন্য তাঁকে সমাহিত করা হয় তাঁর গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীর বনগ্রামে। বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসার কথা আজ জানান অজয় রায়ের সহধর্মিণী জয়ন্তী রায়। তিনি বললেন, ‘অজয় রায়কে কখনো হতাশ হতে দেখিনি। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অকৃত্রিম বিশ্বাস।’

আজকের অনুষ্ঠানও শুরু হয় অজয় রায়ের প্রিয় সংগীত ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পুণ্য হোক হে ভগবান’ দিয়ে। গান গেয়ে শোনান জয়ন্ত আচার্য।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স, মুক্তিযোদ্ধা মুকুল চৌধুরী প্রমুখ।