স্থানীয় সরকার নির্বাচনের চিত্র বলে দেবে জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে: অধ্যাপক সালাহউদ্দিন

দেশজুড়ে চলছে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন। স্থানীয় সরকারের নিম্নতম এই স্তরের নির্বাচন নিয়ে ইতিমধ্যে নানান বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় সরকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নিয়ে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: দ্বিতীয় ধাপে সারা দেশে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৬৫১ বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে কোথাও আবার দলীয় সাংসদদের আত্মীয়স্বজনও রয়েছেন। কীভাবে দেখছেন এই পরিস্থিতিকে?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: এবারের নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রে মাননীয় সাংসদদের ভূমিকা বেশ দৃশ্যমান। অনেকের বিবেচনায় এ ভূমিকা ‘প্রশ্নবিদ্ধ’। পত্রিকায় এসেছে, নির্বাচন কর্মকর্তা খোদ বলেছেন, ‘এমপি স্যারের সঙ্গে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে যে... কোনো নির্বাচন হবে না। সবাই সিলেক্টেড হবে।’ (প্রথম আলো ২৮ অক্টোবর ২০২১)। যদিও সাংসদ মহোদয় তা অস্বীকার করেছেন। তা–ই যদি হয়, তাহলে নির্বাচন কর্মকর্তা কি দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করছেন, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। এই উক্তির কারণে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েছে কি না, জানা যায়নি। সব মিলিয়ে নির্বাচনের যে গণতান্ত্রিক আমেজ আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তার কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে ইউনিয়ন পরিষদগুলো আরও দুর্বল হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে উচ্চতর পর্যায়ে রাজনৈতিক নির্ভরশীলতা বাড়বে। রাজনৈতিক চর্চার দৃশ্যমান অভাবের কারণেই এত বিদ্রোহ বলে আমার ধারণা।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: এবারের নির্বাচনে ১৯ জেলায় আওয়ামী লীগ মনোনীত ৭৬ চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর এলাকা লাকসাম উপজেলায় প্রায় সব প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এই সংস্কৃতি আসলে কিসের ইঙ্গিত দেয়?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের এই প্রবণতা স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে বিশাল প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। শুধু স্থানীয় পর্যায়েই নয়, জাতীয়ভাবে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ওপর প্রভাব পড়বে। এতে গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো আর ভিত্তিমূল দুর্বল বা অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। মনে রাখতে হবে, স্থানীয় সরকারগুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের বিবেচনায় ‘গণতন্ত্রচর্চার সূতিকাগৃহ’। এগুলো জন–আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক আচরণচর্চার শুরুটা এখানেই হয়ে থাকে। কিন্তু যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয়, আমরা আমাদের গণতন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রকে দুর্বল করে দিচ্ছি, যার ফলাফল হবে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এই প্রক্রিয়া চললে একসময় নির্বাচন হবে পেশিশক্তি, অর্থবিত্ত এবং ক্ষমতাশীলদের চারণভূমি, যা সন্দেহাতীতভাবে গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থানীয় সরকারকে শুধু দুর্বলই নয়, আস্থাহীন, অকার্যকর ও অবিশ্বাসের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: শাসক দল থেকে বলা হয়েছে, যাঁরা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে থাকবেন, তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এমন হুমকি পাওয়া সত্ত্বেও বিদ্রোহীরা মাঠে রয়ে গেছেন। এটি কি দলীয় শৃঙ্খলাহীনতার বহিঃপ্রকাশ?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: দলীয়ভাবে নির্বাচন হলে এ ধরনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল হতেই পারে এবং হচ্ছেও তা–ই। কিন্তু দিন শেষে যিনিই জয়ী হবেন, তাঁকেই দল থেকে গ্রহণ করে নেবে, এটা প্রত্যেক বিদ্রোহী প্রার্থীর অনুমান। স্থানীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সব দলে আছে। তবে এই দ্বন্দ্ব বাড়ে বা প্রকাশ পায় নির্বাচনের সময়। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, স্থানীয় নির্বাচনের প্রার্থীরা অনেকেই স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যানদের আশীর্বাদপুষ্ট। অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, দিন শেষে জয়ী প্রার্থী দলের কাছে বড় ‘অ্যাসেট’, তিনি বিদ্রোহীই হোন আর কাঙ্ক্ষিত প্রার্থীই হোন। দলের বিদ্রোহী প্রার্থী বাংলাদেশের প্রায় সব নির্বাচনেই দেখা যায়। আর দলগুলোও বিদ্রোহী জয়ী হলে তাঁকে দলে ফিরিয়ে আনে।

নির্বাচন কমিশন

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: বিরোধী দল বিএনপি দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও দলটির ৩১১ নেতা-কর্মী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনের মাঠে আছেন। প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির নেতারা নানান রকম যুক্তি দেখাচ্ছেন। তাঁরা কেউ কেউ বলছেন, তৃণমূল পর্যায়ে অস্তিত্বের স্বার্থেই তাঁরা মাঠে রয়ে গেছেন। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে বিএনপির মাঠ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কি ঠিক হয়েছে বলে আপনার মনে হয়?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একটি কথা আমার ইদানীং বারবার মনে হয়। উক্তিটি অনেকটা এমন, দুর্দিনে যদি কেউ মৃদু সাহস আর প্রত্যয় নিয়ে বেঁচে থাকে, সে সুদিনের বড় কোনো বীরের চেয়ে কম কিছু নয়। নির্বাচনী ফলাফল কী হবে জানি না বা অনেকে তা অনুমান করতে পারেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি বিএনপির সমর্থকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাটাকে ইতিবাচকভাবে দেখছি। হয়তো ফলাফল কী হবে, তা তারা জানেন বা অনুমান করতে পারেন। কিন্তু নিজ দলের অস্তিত্বের এই সংকটে এতে হয়তো তৃণমূল পর্যায়ে কিছুটা কাটাতে পারবেন বলে মনে করছেন। তবে তাঁদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু সুদূরপ্রসারী বিবেচনায় দলটির রাজনৈতিক অস্তিত্ব আর উপস্থিতিকে প্রকাশ করার একধরনের প্রয়াস।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: স্থানীয় সরকারকে বলা হয় জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির সূতিকাগার। সেখানে এখন শাসক দলের প্রার্থীদেরই প্রাধান্য। আবার কোথাও নির্বাচন হচ্ছেও না। গণতান্ত্রিক বিকাশের স্বার্থে এটা কি একটা বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করেন না?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: গণতান্ত্রিক বিকাশ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণহীন নির্বাচন সার্বিক বিবেচনায় দেশের, রাজনৈতিক দলগুলোর আর জনগণের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। এতে গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা কমে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, স্থানীয় নির্বাচনকে জনগণ ভালোভাবেই বোঝে। এর প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য গতিপ্রকৃতি তারা বোঝে এবং এর ব্যাখ্যাও করতে পারে। রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষ অজ্ঞ, এটা ভাবা কিন্তু ঠিক নয়। অনেক জরিপেই রাজনীতি নিয়ে তাদের আশা, আকাঙ্ক্ষা, হতাশার তথ্য উঠে এসেছে। হয়তো কখনো কখনো নির্বাচনী ফলাফল দেখে তারা হতাশ হয়, কিন্তু তারা ঠিকই নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা বোঝে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহারের ফলে নির্বাচনগুলো আরও একপেশে হয়ে গেছে বলে অনেক সমালোচক বলেন। আপনার মন্তব্য কী?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক আগে ছিল না। তখন যে আমরা খুব সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখেছি, তা নয়। প্রত্যেক প্রার্থীর কোনো না কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল। কাজেই দলীয় প্রতীক ব্যবহার শুধু বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া। নির্বাচন আর দলীয় রাজনীতি পাশাপাশি চলে। কিন্তু সমস্যা হলো, দলীয় নির্বাচনে স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক বিভাজনটা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমার বিবেচনায়, দলীয় পর্যায়ে নির্বাচন করাটা বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া। এতে জবাবদিহির আরও একটি ক্ষেত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে দলভিত্তিক নির্বাচন একপেশে, এমনটা বলা কঠিন। বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচনী ফলাফল সম্পর্কে অনেকটা পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। নির্বাচন শুধু আইনি কাঠামোতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা নির্ভর করে ‘রাজনৈতিক আবহাওয়া’র ওপর।

ইউপি নির্বাচন
প্রতীকী ছবি

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকার পরিষদগুলোর নির্বাচনী প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। জাতীয় রাজনীতিতে এর কী প্রভাব পড়তে পারে বলে আপনি মনে করেন? সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। স্থানীয় সরকারের বর্তমান নির্বাচনী ধারা অব্যাহত থাকলে সেই নির্বাচন কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: যেকোনো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হলে তা রাজনীতিকে দুর্বল করে। গণতান্ত্রিক কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় জনগণকে ‘নির্বাচনবিমুখ’ বলেই মনে হয়েছে। নির্বাচনী আবহাওয়া, রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে ক্ষমতাশীল ও প্রধান বিরোধী দলের আচরণ ও কর্মকাণ্ড মানুষ মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ ও বোঝার চেষ্টা করে। নির্বাচন, বিশেষ করে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের উৎসাহ আর আস্থা দুটোই ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। এই প্রত্যাশাহীনতার কারণে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ বা কৌতূহল হারাচ্ছে মানুষ। স্থানীয় সরকারকে গণতন্ত্রচর্চার সূতিকাগার হিসেবে মেনে নিলে বলা যায়, এই ধারা উদ্বেগজনক। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের চিত্রই বলে দেবে, জাতীয় নির্বাচনের চেহারা কেমন হবে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: স্থানীয় সরকারের নির্বাচনী ব্যবস্থা যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে, তা থেকে উত্তরণে কী করা যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান: স্থানীয় রাজনীতি বা নির্বাচন তথা স্থানীয় সরকারের চরিত্র জাতীয় সরকারের নির্বাচন ও গুণগত কাঠামোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। নির্বাচন কমিশনের সীমাবদ্ধতা, দক্ষতা আর সদিচ্ছা নিয়ে বারবার অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এখনো তুলেছেন। রাজনৈতিক আচরণের বিশ্লেষণে ক্ষমতাসীন দল এখনো প্রধান বিরোধী দলের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। তেমনিভাবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে সমালোচিত হচ্ছে। সার্বিকভাবে মনে হয়, জাতীয় নির্বাচনের গুণগত মান, অংশগ্রহণের সুযোগ, নির্বাচনী পরিবেশ এবং সবার অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য তৈরি না হওয়া পর্যন্ত কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হতে পারে না। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশেষ করে শাসক দলের সমর্থকদের মধ্যে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক দ্বন্দ্বের ঘটনায় জনমনে কিছুটা হলেও উদ্বেগ রয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও কোনো উৎসাহ আছে বলে মনে হচ্ছে না।