হিজড়া না হলে এমন করে হয়তো কেউ বলতে পারত না: নজরুল ইসলাম

নির্বাচনে জয়ের পর সমর্থকদের মধ্যে মালা পরিহিত  নজরুল ইসলাম ঋতু
ছবি: সংগৃহীত

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতু। তৃতীয় লিঙ্গের কেউ এই প্রথমবার ইউপি চেয়ারম্যান হলেন। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে এ পর্যন্ত আসার সংগ্রামটা সহজ ছিল না তাঁর। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন নজরুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আপনাকে অভিনন্দন জানাই। তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে প্রথম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হলেন। আপনার অনুভূতি কি?

নজরুল ইসলাম: আমি ভীষণ আনন্দিত। এলাকার মানুষ আমাকে বড় সম্মান দিয়েছে। এ জন্য তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। তাদের সবার সমর্থন না পেলে এ বিজয় হতো না। আমি দ্বিগুণের বেশি ভোট পেয়েছি আমার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর চেয়ে। এটা আমার প্রতি মানুষের সমর্থন তুলে ধরে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আমাদের সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের চলার পথটা সহজ না, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকারের নিম্নতম স্তর। কিন্তু সেখানেও একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের নির্বাচিত হওয়াটা খুব সহজে হয়নি নিশ্চয়ই। বলুন আপনার কথা।

নজরুল ইসলাম: আমি তো জনগণের মধ্যে আছি। জনগণ চেয়েছে নির্বাচন করার জন্য, করেছি। জনগণ চেয়েছে তাই জয়ী হয়েছি। তবে প্রথমে এলেই তো কেউ জায়গা দিয়ে দেয় না। মেহনত করতে হয়েছে। তাদের জন্য কিছু করতে হয়েছে। তারপরই না তারা আমার ওপর আস্থা রেখেছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: অনেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ প্রার্থিতার ফরমে নারী-পুরুষের মধ্যে নারী হিসেবে পরিচয় দেন। অন্যান্য বা হিজড়ার জায়গা ব্যবহার করেন না। আপনি কী করেছিলেন?

নজরুল ইসলাম: আমার জাতীয় পরিচয়পত্রে ‘নজরুল হিজড়া’ লেখা আছে। আমি নিজেও প্রার্থিতার ফরমে হিজড়া পরিচয় লিখেছি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: আগে নারী ও পুরুষ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের পরিচিতির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এই পরিচয় দেওয়ার ব্যবস্থাকে কীভাবে দেখেন?

নজরুল ইসলাম: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময় এই স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। এটা একটা বড় অর্জন। আমার এ পর্যায়ে আসার ক্ষেত্রে এই স্বীকৃতির একটি ভূমিকা আছে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: ভোটার হওয়ার সময় আপনার কোনো অসুবিধা হয়েছিল?

নজরুল ইসলাম: না না, অন্য সব মানুষ যেভাবে ভোটার হয়, আমিও সেভাবে হয়েছি। কেউ কোনো অসুবিধা করেনি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: নির্বাচনে দাঁড়ানোর মতো অবস্থায় কীভাবে এলেন? কী যোগ্যতায় আপনাকে মানুষ আস্থায় নিল?

নজরুল ইসলাম: আমি আসলে কোনো লেখাপড়াও জানি না। শুধু নিজের নামটা স্বাক্ষর করতে জানি। বড় কথা বলে লাভ নেই। জনগণ ভালোবেসেছে বলেই আমি এ জায়গায় এসেছি। প্রতিনিধি হয়েছি। তবে আমি সব সময় মানুষের জন্য কাজ করেছি। এই এলাকাতেই আমার জন্ম। এখানেই বেড়ে ওঠা। এরপর ঢাকায় চলে গেছি। কিন্তু যখন এলাকায় আসতাম, তখন মানুষের জন্য কিছু না কিছু করার চেষ্টা করতাম। মেয়েদের বিয়ের সময় সহায়তা দিয়েছি, কেউ অসুস্থ হলে পাশে দাঁড়িয়েছি। এলাকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সহায়তা দিয়েছি। রাস্তাঘাট করতেও আমি মানুষের পাশে থেকেছি। তখনই মানুষ ভেবেছে, এসব যখন করছে, তখন তো প্রতিনিধি হলে আরও কিছু করতে পারবে।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এবারই প্রথম নির্বাচন করলেন। তো নির্বাচনে প্রতিপক্ষের যারা ছিল, তারা আপনার এই পরিচয় নিয়ে কিছু বলেনি?

নজরুল ইসলাম: হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার পরিচয় নিয়ে নানা কথা হয়েছে। আমি হিজড়া, আমাকে ভোট দিলে কোনো কাজ করতে পারব না। এলাকায় থাকতে পারব না। আমি কী সেবা করব, আমার তো চেয়ারম্যান বা এসব বিষয় নিয়ে কোনো ধারণাই নেই—এসব নানা প্রচারণা হয়েছে। অনেক লাঞ্ছনা সহ্য করেছি। হিজড়া না হলে এমন করে হয়তো কেউ বলতে পারত না। কিন্তু এটা তো মৌখিক হেনস্তা। এর পাশাপাশি, আমার অনেক মানুষকে রীতিমতো মারপিট করা হয়েছে। আমার আত্মীয়স্বজনকে মারা হয়েছে। তারা আহত হয়েছে। তাদের সুস্থ করতে আমার খরচও হয়েছে। আমাকে এলাকায় প্রায় বেরোতেই দেওয়া হয়নি। তবে আমি বারবার বলেছি, আমাকে মারুক। মেরে যদি কেউ ভালো থাকতে চায়, থাকুক। যদি ভালোভাবে নির্বাচন করতে দেওয়া হতো, তবে আমি আরও বেশি ভোটে জিততাম।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: নির্বাচিত হওয়ার পর এখন আপনার পরিকল্পনা কী?

নজরুল ইসলাম: এখন এলাম কেবল। দেখি কী কী করা যায়। মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। সেবা করতে চাই। অত রাজনীতি বুঝি না। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিনীতভাবে বলতে চাই, উনি আমাদের স্বীকৃতি দিতে পেরেছেন। তাঁর সুনজর প্রত্যাশা করি।

প্রশ্ন:

প্রথম আলো: এখন কী ধরনের সমস্যা আছে সামনে?

নজরুল ইসলাম: নির্বাচনের আগে নানা দ্বিধা–দ্বন্দ্ব ছিল। নির্বাচন শেষ, এখন সব দ্বন্দ্বও শেষ। মারামারি, হাঙ্গামা এসব কোনো কিছু চলবে না। প্রতিপক্ষের লোকজন এরপরও যদি কিছু করতে চায়, আমি পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা চাইব।