১৭ নেতায় যুবদলের ৩ কমিটির ৩ বছর পার

সাইফুল আলম নীরব ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। ছবি: সংগৃহীত
সাইফুল আলম নীরব ও সুলতান সালাউদ্দিন টুকু। ছবি: সংগৃহীত

বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে দাপট ছিল যুবদলের। এখন দল ক্ষমতায় নেই, চুপসে গেছে যুবদলও। তিন বছর আগে আংশিকভাবে যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। একই সময়ে করা হয় ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটিও। এই তিন কমিটিতে মোট নেতার সংখ্যা ১৭ জন। কমিটির মেয়াদ তিন বছর, সেটা এখন শেষ পর্যায়ে। কিন্তু এখনো কেন্দ্রীয় কমিটিই পূর্ণাঙ্গ হয়নি। ঢাকা মহানগর কমিটিরও একই অবস্থা।

সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রম না থাকলেও যুবদলের শীর্ষ নেতৃত্ব, বিশেষ করে সভাপতি সাইফুল আলম ওরফে নীরবকে নিয়ে অস্বস্তি আছে মূল দল বিএনপিতে। অভিযোগ আছে, রাজধানীর অপরাধজগতে সাইফুল আলমের যোগাযোগ রয়েছে। এমনকি ক্যাসিনো–কাণ্ডে যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের সঙ্গে তাঁর সখ্য নিয়েও সংগঠনের ভেতরে আলোচনা আছে।

বিএনপির অন্যতম অঙ্গসংগঠন জাতীয়তাবাদী যুবদল ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। তিন বছর অন্তর সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি হওয়ার কথা থাকলেও ৪১ বছরে কমিটি হয়েছে ছয়বার। আগামী মাসে বর্তমান কমিটির তিন বছরের মেয়াদ শেষ হবে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আংশিক কমিটি ঘোষণার সময় বলা হয়েছিল, এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হবে। কিন্তু এখন মেয়াদ শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে নেতারা তৎপর হয়েছেন।

যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত চার-পাঁচ বছরে বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো পরিবেশ ছিল না। ম্যাডামকে (খালেদা জিয়া) প্রতি সপ্তাহে কোর্টে যেতে হয়েছে। তখন আমরা রাস্তায় থাকতাম। তারপরও আমরা সারা দেশে যুবদলের ৮২টি ইউনিটের মধ্যে ৮০টিতে কমিটি দিয়েছি।’

নেতাদের নিয়ে নানা কথা
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাইফুল আলমকে ঢাকা-১২ আসনে প্রার্থী করেছিল বিএনপি। রাজধানীর অন্য আসনগুলোতে বিএনপির প্রার্থীরা কমবেশি প্রচার চালালেও তিনি এক দিনের জন্যও নির্বাচনী প্রচারে নামেননি, কোনো পোস্টারও লাগাননি। এ নিয়ে নেতা-কর্মীদের মনে তখন প্রশ্ন ছিল।

নির্বাচনী হলফনামায় সাইফুল আলম তথ্য দেন, তাঁর বিরুদ্ধে ২৬৭টি মামলা আছে। এর মধ্যে হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের নাশকতার অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইন, সন্ত্রাসবিরোধী আইন ও বিস্ফোরক আইনে করা মামলার সংখ্যাই বেশি। অধিকাংশ মামলাই ২০১০ সালের পরের।

বিএনপি ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাইফুল আলমের উত্থান হয় ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর। তখন যুবদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক পদে থেকে তিনি তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করেন এবং চাঁদাবাজির জন্য পরিচিতি পান। সে সময় তেজগাঁওয়ে ছাত্রদলের নেতা মাসুদ, যুবদলের মনু ও খোকন এবং যুবলীগের গালিব হত্যার পর এলাকায় তাঁর ব্যাপক প্রভাব বাড়ে। এর মধ্যে গালিব হত্যা মামলায় তিনি এজাহারভুক্ত আসামি।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সূত্রের দাবি, সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় ঢাকায় গাড়ি পোড়ানো, বাসে আগুন, ককটেল বিস্ফোরণের বিভিন্ন ঘটনার পেছনে সাইফুল আলমের ভূমিকা আছে। তবে সাইফুল আলম দাবি করেন, রাজনৈতিক কারণে এসব অভিযোগ তোলা হয়েছে। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে এত বিপুলসংখ্যক মামলা দেওয়া হয়েছে।

সাইফুল আলমের ঘনিষ্ঠ যুবদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর। তিনি ১৩৮ মামলার আসামি। একসময় তেজগাঁও কলেজের ভিপি, ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি ছিলেন জাহাঙ্গীর। ২০০২ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় সেনা নেতৃত্বে পরিচালিত ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে সন্ত্রাসবিরোধী যে অভিযান হয়, তখন জাহাঙ্গীর বিদেশে পালিয়ে যান।

যুবদল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি রফিকুল আলম বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। রফিকুল আলম যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা সম্রাটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলতেন বলে সংগঠনের ভেতরে প্রচার আছে।

যুবদলের বর্তমান কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন ওরফে টুকু। জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোর্ত্তাজুল করিম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম ও সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসান। তাঁদের মধ্যে সুলতান সালাউদ্দিন ১৩ মাস ও মামুন হাসান সাত মাস জেল খেটে সম্প্রতি বের হয়েছেন।

সুলতান সালাউদ্দিনের বিরুদ্ধে এখন ২১২টি মামলা আছে। যুবদলের আগে তিনি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। তিনি সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী এবং ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই।

ভুল হাতে যুবদল?
নেতা-কর্মীদের অনেকেই মনে করেন, নেতৃত্বের বদনাম ও অক্ষমতা এবং সাংগঠনিক নিষ্ক্রিয়তায় যুবদল অকার্যকর সংগঠনে পরিণত হয়েছে। এ কারণে সংগঠনের সাবেক নেতারাও অসন্তুষ্ট। একসময় মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বরকত উল্লা ও সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন যুবদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এখন তাঁরা মূল দল বিএনপির নীতিনির্ধারণী ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। কিন্তু সাবেক নেতাদের অনেকে এখন যুবদলকে এড়িয়ে চলেন অথবা যুবদল তাঁদের এড়িয়ে চলে।

যুবদলের সাবেক এক শীর্ষ নেতা বর্তমানে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় অতীতের আন্দোলনের সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিল যুবদল। সেই যুবদল এখন আর নেই। নেতৃত্বও ভুল ব্যক্তির হাতে।