প্রতিচিন্তা সম্পর্কে

১. আমরা জ্ঞানচর্চার একটি সংকটের মধ্যে আছি। জীবনের দীর্ঘ একটি অংশ আমরা ব্যয় করেছি উপনিবেশিক ও আধুনিক পুঁজিবাদের প্রবল নৈতিক অস্বীকারের মধ্য দিয়ে। এর জন্য, অন্তত আমাদের কারো কারো কাছে, প্রধান অবলম্বন ছিল প্রথাগত সমাজতন্ত্রের আদর্শ ও অনুপ্রেরণা। আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই অনড় মানদণ্ডটি যা দিয়ে আমরা একদা সমাজ-প্রগতিকে বিচার করতাম তা অনেকটাই প্রত্যাখ্যাত হয়ে গেছে। এর জন্য আমাদের নিজেদের চিন্তার অসহায়তা অনেকাংশে দায়ী। পুরোনো স্থবির বিশ্বাসকে প্রশ্ন করার জন্য যে মানসিক সাহস দরকার আমাদের মধ্যে তার ছিল প্রচণ্ড অভাব। নইলে কেন আমরা প্রগতিপন্থায় অস্বীকার করব রাষ্ট্রের যথাযথ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি সমাজতন্ত্রের অর্থনীতিতে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে বাজার-ব্যবস্থা চালু রাখার স্বাভাবিক বাস্তবতা? কেন সমাজতান্ত্রিক দেশে প্রতিযোগিতামূলক গণতান্ত্রিক রাজনীতি অব্যাহত থাকুক তার জন্য আমরা সোচ্চার হইনি? কেন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদপত্র-মিডিয়ার স্বাধীন শক্তিশালী ভূমিকাকে জোরেশোরে স্বীকৃতি দেইনি? কেন সমাজতন্ত্রে যারা সামাজিক-রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য পার্টি ব্যবস্থার বাইরে থেকে গিয়েছিল সেই দুর্বলতর ‘অপর’-এর উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হইনি?

অন্যদিকে আধুনিকতার নামে বর্তমান যুগে পুঁজিবাদ আমাদের যা উপহার দিয়ে চলেছে তাতে ক্রমাগত বিবমিষা ও ক্ষোভের উদ্রেকই হচ্ছে কেবল—কি এই দেশে, কি বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব-পুঁজিবাদের মুদ্রার যে পিঠটি চকচক করছে তা আমাদেরকে কেব্ল টিভির কল্যাণে অহর্নিশ দেখানো হচ্ছে। মুদ্রার ওপিঠটি যে ঘষা খেয়ে বহু আগেই অচল সিক্কিতে পরিণত, তা আমরা ভুলে বসতে চলেছি। ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা বার্লিন দেয়ালের পতনের মধ্য দিয়ে লিবারেল পুঁজিবাদের চূড়ান্ত জয় দেখতে পারেন, ‘ইতিহাসের পরিসমাপ্তি’ দেখতে পারেন হেগেলীয় কাঠামোয়, কিন্তু বর্তমানের ইতিহাস আরও বৈষম্য-চিহ্নিত, আরও মানবাধিকার লঙ্ঘিত, আরও রক্তাক্ত যুদ্ধে স্পৃষ্ট, আরও অপরিণামদর্শী পরিবেশ-বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এটাই সত্য।

জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তাই নতুন অবলম্বন খুঁজছি আমরা। এবং এর জন্য প্রয়োজন হলে আমাদের একেবারে ‘শুরুর বিন্দু’তে ফিরে যেতে হবে, হয়তো একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে, যেমনটা আমরা পাই লেনিনের স্লাভো ঝিঝেক-কৃত ভাষ্যে (বর্তমান সংখ্যায় সে রকম একটি অনুবাদ রাখা হয়েছে)।

২. তিনটি আপ্ত-বাক্য দিয়ে আমাদের সময়কে নির্দিষ্ট করা যায়

এক , প্রথাগত সমাজতন্ত্র মৃত। শুধু ভৌগলিক অস্তিত্বের বিচারেই মৃত তা নয়। জ্ঞানচর্চার মানদণ্ড হিসাবেই তা মৃত। লেনিনীয় ‘নিউ ইকনমিক পলিসি’র ধারায় উদ্ভাবনী ছকে বিকাশমান হওয়ার পরিবর্তে ‘কমান্ড ইকনমি’র মডেলে পর্যবসিত প্রথাগত সমাজতন্ত্রের জ্ঞানকাণ্ডকে আঁকড়ে নতুন বামপন্থার আদর্শকে পরিণতি দেওয়া সম্ভব নয়। এই মৃত্যুর মধ্যে শেকস্পীরিয় ট্রাজিডির সমস্ত লক্ষণ অনুপস্থিত। সেটা লেনিন থেকে স্তালিনে পুরো ব্যাপারটার পর্যুদস্ত হওয়ার মধ্যে যেমন প্রতিফলিত হয়, তেমনিভাবে দেখা যায় বিশ্বাসের শেষ আশ্রয়-স্থল কম্যুনিস্ট চীনের পুঁজিবাদী ধারায় ক্রম-পরিণতি প্রাপ্তির সমূহ লক্ষণের মধ্যেও। মিখাইল গর্বাচভের সোভিয়েত ইউনিয়ন এমনকি অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মও সঠিক ধারায় নিয়ে যেতে পারেনি। আশির দশকে গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকার শ্লোগান তুলে শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক হঠকারিতার যে দৃষ্টান্ত গর্বাচভ এর আগে রেখে গেছেন তাতে করে ঐ একই কালপর্বের দেং শিয়াও পিং-এর তুলনায় তাঁকে রাজনীতিতে নাবালক শিশু ভাবলে খুব একটা বাড়িয়ে বলা হয় না। এলান বাদিয়্যু যাই বলুন না কেন, এক ধরনের পথ না-পাওয়ার অলিঘুলিতে হারিয়ে গেছে আদি সাম্যবাদী রূপকল্প ও ভাবাদর্শ। বাজার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার—এই তিনটি পাল্টা সমালোচনার মুখে হারিয়ে গেছে প্রথাগত সমাজতন্ত্রের একদার আকর্ষণী-ক্ষমতা।

দুই , আধুনিক পুঁজিবাদও বার্লিনের দেয়াল ধসে পড়ার গত দুই দশকে আমাদের জন্য কোনো আদর্শিক পথ-বিকল্প হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ও-রকম হওয়ার সম্ভাবনাও তার শোণিতে কখনো প্রবাহিত ছিল না। পুঁজিবাদ যা বলছে সে আসলে তা না। দেশে দেশে আধুনিক পুঁজিবাদ প্রবৃদ্ধির নামে সৃষ্টি করছে সম্পদ ও সুযোগের প্রকট বৈষম্য। নাগরিক-জীবন হয়ে পড়ছে মানবাধিকারবিহীন। ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’—এই দুই পরস্পর-বিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ছে বিশ্ব-পুঁজিবাদ। জগত্ জোড়া পরিবেশের বিপর্যয় নেমে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ নিজেই হয়ে পড়ছে তার বিঘোষিত গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এমনকি বিশ্বায়নের যুগে পশ্চিমা-ধাঁচের আধুনিকতার বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাধীন বিকাশের—‘নিজেদের আধুনিকতা’—দাবি করার পরিসরও অনেকগুণে কমে এসেছে। সবাইকে এক কাতারে ফেলে একই আধুনিকতার মানদণ্ডে ও ছাঁচে গড়ে তোলার বিশ্ব-পুঁজিবাদী ‘প্রকল্প’ অসমাপ্ত থেকে গেছে—মানুষের দৈনন্দিনের রুটি-রুজি ও আত্মসম্মানের সাথে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকারও অনেক দেশে অর্জন সম্ভবপর হয়নি। বেড়েছে ‘গ্লোবাল পভার্টি’, শুধু তা-ই নয়। উল্টো দেশে দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, সন্ত্রাস দমনের নামে অযাচিত মোড়লীপনা, রাষ্ট্র-ব্যর্থতাকে ঢাকতে গিয়ে দাতা দেশগুলোর গ্রহণ করা সুশাসনের প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতায় ও জন-অধিকারের দৈনন্দিন লঙ্ঘনে। ‘এক-বিশ্ব এক-সুপার পাওয়ার’ মডেলে সুপার-সাম্রাজ্যবাদ নিজের শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থানকে সবার দৃষ্টিগোচর রাখার জন্য মাঝেমধ্যেই হাইপার-ক্ষমতায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে জড়িয়ে পড়ছে একেকটা নিরর্থক, নিষ্ফল ও দীর্ঘস্থায়ী আঞ্চলিক যুদ্ধে, যা ফুকোয়ামা-প্রস্তাবিত ‘ইতিহাসের পরিসমাপ্তি’র গত দুই দশকেও কোনো শুভ গণতান্ত্রিক লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। এই বিশ্ব-পুঁজিবাদ কীভাবে আমাদের আদর্শ হতে পারে?

তিন , তার পরও মানবিক সার্বজনীনতার বোধ, লোভসর্বস্ব আত্মরতির সমাজের বিপরীতে পরার্থপরতার তাগিদ, পরিবেশ রক্ষা করে স্বস্তির সাথে আগামী কালকে বাঁচিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি, সর্বোপরি, এক বৈষম্যমুক্ত স্বাধীন গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজের স্বপ্ন আমাদের মধ্যে এখনো জাগ্রত। এই স্বপ্ন কী করে জন্মায় আমাদের মধ্যে, কী করে যৌথভাবে আমরা একই স্বপ্নের ভেতরে শেষ আশ্রয়স্থল খুঁজে পাই তার মনঃসমীক্ষণ আমাদের অজানা। কিন্তু যৌথতার স্বপ্ন জন্মায়। ক্ষমতাবলয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে থাকার পরও আমরা আমাদের শুভ বোধকে—আমাদের নির্দোষ মানবিকতাকে—বাঁচিয়ে রাখি। মিশেল ফুকো যেমন বলেছিলেন, যেখানেই ক্ষমতার অস্তিত্ব সেখানেই প্রতিরোধ দানা বাঁধে।

আজ তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে অন্য ইউটোপিয়ার, অন্য জ্ঞানকাণ্ডের, অন্য সাধনপ্রণালীর। অন্য সমতাবাদী সমাজের জরুররত আজ। এই সমতাবাদী সমাজ হবে নতুন মানবিকতার—যা বাজার ও রাষ্ট্র, ব্যক্তিস্বার্থ ও পরার্থপরতা, জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ বিচিত্রবিধ পরিচিতির অস্তিত্বরক্ষা ও বিশ্বজনীন সার্বজনীনতা, প্রবৃদ্ধি ও ন্যায়বিচারের মধ্যে নিরন্তর সাযুজ্য বিধান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই নতুন সমতাবাদী সমাজ পাশ্চাত্য-কেন্দ্রিক ইতিহাসকে অবলীলায় বিশ্ব-ইতিহাসের মূলধারা বলে শিরোধার্য করবে না, যেমন নির্বিচারে গ্রহণ করবে না প্রাচ্য-কেন্দ্রিক ইতিহাসের প্রস্তাব।

এই নতুনের অবয়ব আমরা এখনো জানি না, তাত্ত্বিকভাবেই এর চেহারা এখনো অনেকটাই ছায়াচ্ছন্ন, বাস্তবে তা অনুশীলনের সব নিয়ম এখনও আমাদের করায়ত্ত হয়নি। এই নতুন সমতাবাদী সমাজ এখনো সম্ভাবনার বলয়ে। অথবা অন্য অর্থে, এটা হচ্ছে প্রায়-অসম্ভবের প্রস্তাব, যা আমাদের প্রতিদিনের চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে আছে কিন্তু যা আমাদের চিন্তায় এখনো প্রথিত হয়নি। যা সম্ভব তা-ই শ্রেয় নয়। যেমনটা যা সম্ভব ছিল প্রথাগত সমাজতন্ত্রে বা আধুনিক পুঁজিবাদে—তা কালের বিচারে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। যা শ্রেয়োতর তা ছিল অসম্ভব, তাকে আমরা এখনও ধরায় পাইনি—নিজেদের জ্ঞানচর্চাতেও প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। এক অর্থে এই নতুন সমতাবাদের স্বপ্ন আমাদের এত দিনের ক্রমাগত ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক ব্যর্থতাজাত চরম উপলব্ধি। অন্য অর্থে, এটা আমাদের চালিত করে এক অনির্দেশ্য গন্তব্যে। আমাদের আরও একটি গিরিশৃঙ্গের উচ্চতা জয়ের স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু তার জন্য এতকাল উঠতে উঠতে গিরিশৃঙ্গের যে অবস্থানে গিয়ে আমরা আটকে গেছি, সেই অবস্থান থেকে আবারও মোহমুক্ত হয়ে নেমে আসতে হবে আমাদের, পরাজয়ের মধ্য দিয়েই নেমে আসতে হচ্ছে, হয়তো নেমে আসতে হবে একেবারে শুরুর বিন্দুতে, যেখান থেকে এক শোষণমুক্ত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একদা আমাদের ও আমাদের পূর্বপুরুষদের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

৩. আমরা তৃতীয় একটি পথ খুঁজছি। একে কেউ ‘মধ্যপন্থা’ বলতে পারেন, ‘অন্যপন্থা’ও বলতে পারেন। এর সংজ্ঞা একেকজনের বিচারে হবে একেকরকম। অর্থাত্ তৃতীয় পথও কোন নির্দিষ্ট সুসংজ্ঞায়িত মতাদর্শ নয়। বিভিন্ন ধরনের পুঁজিবাদের বা বিভিন্ন ধরনের সমাজতন্ত্রের ন্যায় বিভিন্ন ধরনের ‘তৃতীয় পথ’ খুঁজে পাওয়া যায়। ইতিপূর্বে যারা তৃতীয় পথের কথা ভেবেছিলেন সেসব মতবাদকে এক ঝলক বিচার করলেই এর মধ্যে নানা ঝোঁকের অস্তিত্ব চোখে পড়বে।

একসময় এদেশের ‘মস্কোপন্থী’ বামধারার সাহিত্যে ‘অপুঁজিবাদী বিকাশ’-এর তত্ত্ব আলোচিত ছিল। সদ্যস্বাধীন তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের মধ্যে না-পুঁজিবাদ না-সমাজতন্ত্র এমন একটি মধ্যপন্থার প্রয়োজনীয়তা অপুঁজিবাদী বিকাশের সোভিয়েত তাত্ত্বিকেরা (উলিয়ানভস্কি, ব্রুটেনস প্রমুখ) সত্তরের দশকে জোরে-শোরে তুলে ধরেছিলেন। এর বিপরীতে, এদেশের ‘চীনপন্থী’ বামধারার সাহিত্যে বলা হত মাও-কথিত ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের’ কথা—যা (স্তর-বিচারে) বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হলেও কার্যত তা সমাধা হবে শ্রমিক শ্রেণীর (বাম) নেতৃত্বে। কালের প্রবাহে সেসব তত্ত্ব হারিয়ে গেছে। এর স্থান গ্রহণ করেছে উন্নয়নবাদী জ্ঞানকাণ্ড। প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট হল কিনা, দারিদ্র কমল কিনা, বৈষম্য কিছুটা পরিমাণে কমল কিনা, ‘মানব-উন্নয়নের’ সূচকগুলোয় অগ্রগতি এল কিনা, ‘সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’ প্রসারিত হল কিনা—এসব আলোচনার মধ্যে সংকীর্ণ হয়ে গেল প্রগতিশীল জ্ঞানকাণ্ডের বৃহত্তর চর্চা। এমনকি উন্নয়নবাদী বিতর্কে অংশ নিয়ে যারা মানবাধিকারের কথা তুললেন তারাও বিষয়টাকে শেষাবধি সীমিত রাখলেন ‘উন্নয়নের জন্য মানবাধিকার’ প্রশ্নে। উন্নয়নবাদী বিতর্কের একটি বড় সীমাবদ্ধতা এই যে, উন্নয়নে রাজনৈতিক আন্দোলনের বা বৃহত্তর অর্থে সামাজিক/গণ-আন্দোলনের ভূমিকাকে প্রান্তবর্তী বিষয়ে পরিণত করা হয়। নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের স্বাধীন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা ও গণ-উদ্যোগকে উন্নয়নবাদী জ্ঞানকাণ্ডের ভেতরে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় দেখা হয়। এর ফলে এদেশে গণ-আন্দোলনের ও গণ-সংগঠনের এলাকাগুলো একে একে ছেড়ে দেয়া হলো ‘সেবা প্রদানকারী’ বেসরকারী এনজিও সংস্থার হাতে। বিশেষত ২০০০-এর দশকে এই ধারা এদেশে ও অন্যত্র সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রচলিত উন্নয়ন-মডেলের বিকল্প হিসেবে নতুন ধরনের সমাজ-ব্যবস্থা কিভাবে গড়ে উঠতে পারে সেই আলোচনাকে সামাজিক অনুশীলনের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরিয়ে কক্ষচ্যুত ও লক্ষ্যচ্যুত করে ফেলা হল এভাবেই এক-অর্থে। কোন ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের আশ্রয় নেয়া ছাড়াই একথা বলা যায় আজ।

তৃতীয় প্রথার পশ্চিম ইউরোপীয় ডিসকোর্সে যারা আদিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারাও যখন ক্ষমতায় এলেন তাদের পূর্ব-প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারলেন না। ব্রিটেনে নিউ লেবার গভর্নমেন্ট আসার আগের এক দশকে টনি ব্লেয়ার ও গর্ডন ব্রাউন ‘তৃতীয় পথ’-এর কথা বলতেন। প্রথম বার ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় নির্বাচনী অভিযানে ও তার পরপর যুক্তরাষ্ট্রে ‘নিউ ডেমোক্র্যাট’ বিল ক্লিনটনও নতুন ধারার সরকার ও সামাজিক কল্যাণমুখী অর্থনীতির কথা বলতেন। ‘রাষ্ট্রের পুননির্মাণ করতে হবে’ এমন শ্লোগান দিয়ে ক্লিনটন ১৯৯২ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ১৯৯৪ সালে ডেভিড মিলিব্যান্ড সম্পাদিত রি-ইনভেন্টিং দ্য লেফট বইয়ে গর্ডন ব্রাউন ‘দ্য পলিটিক্স অব পটেনশিয়াল’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি সকলের জন্য ‘সমান সুযোগের’ প্রশ্নটি অর্থনৈতিক যুক্তিতেই চালু রাখা প্রয়োজন এমন মত রাখেন: ‘যেসব অর্থনীতি তার নাগরিকদের অন্তর্নিহিত যা কিছু সেরা তা বের না করে আনতে পারে সেসব অর্থনীতি অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়ে’।

ফরাসী প্রধানমন্ত্রী লিওনেল জোসিপন আরো একধাপ এগিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে সোশালিস্ত ইন্টারন্যাশনাল-এর সম্মেলনে বললেন: ‘মার্কসীয় পদ্ধতির মধ্যে যা কিছু ফলপ্রসূ সেসব উপাদানকে পুনরায় আবিষ্কার করা প্রয়োজন—এর মধ্যে রয়েছে পুঁজিবাদ ও তার সামাজিক বাস্তবতার বিশ্লেষণ। পুঁজিবাদ নিয়ে আমাদের আরো ভাবতে হবে—যাতে করে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়, আয়ত্ব করা যায় এবং সংস্কার করা যায়’। ঐ একই বছরে ব্লেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ‘সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল’-এর নাম বদলে নতুন নাম ‘সেন্টার-লেফট্ ইন্টারন্যাশনাল’ রাখার, যাতে করে ক্লিনটন-গোর নেতৃত্বাধীন ডেমোক্রেটিক পার্টি তাতে যোগ দিতে পারে। ইউরোপে তৃতীয় পথ নিয়ে বলতে গিয়ে ঐ বছরেই টনি ব্লেয়ার ও জার্মানির চ্যান্সেলার গেরহার্ড শ্রোয়েডার এক যৌথ ইশতেহারে বললেন, ‘ন্যায্যতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সুযোগের সমতা, সহমর্মিতা এবং অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ—এগুলো চিরন্তন মূল্যবোধ। সামাজিক গণতন্ত্রীরা এসব [মূল্যবোধকে] কখনোই বলি দেবে না। আজকের দুনিয়ায় এসব মূল্যবোধ প্রাসঙ্গিক করার জন্য চাই একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার উপযোগী বাস্তব এবং ভবিষ্যত্-মুখীন নীতিমালা’।

নব্বই দশকে ইউরোপের ‘তৃতীয় পথ’-এর তাত্ত্বিক এন্থনি গিডেন্স ১৯৯৮ সালে দ্য থার্ড ওয়ে নামে অভিসন্দর্ভই রচনা করে ফেললেন। এর মূল ঝোঁক ছিল—প্রথাগত বাম ও প্রথাগত ডান—এই দুই প্রবণতার বাইরে অন্য কিছু খোঁজার চেষ্টা। ১৯৯৪ সালে এর পূর্বাভাস মিলেছিল তাঁর বিওয়েন্ড লেফট্ অ্যান্ড রাইট বইয়ে। পুরনো বামপন্থীরা (‘ওল্ড লেফট্’) যারা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার উপর অতিরিক্ত আস্থা রাখতেন, আর নতুন ডানপন্থীরা (‘নিউ রাইট’) যারা বাজারের উপর অতিরিক্ত বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন—এই দুই দলের বাইরে ‘তৃতীয় পথ’ খুঁজেছিলেন গিডেন্স। তার লেখায় ইউরোপে চার ধরনের ‘তৃতীয় পন্থা’ আবিষ্কৃত হলো। প্রথম গ্রুপে পড়লেন ‘বাজার-মুখীন’ তৃতীয় পন্থাবাদীরা যার নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাজ্যের নিউ লেবার। দ্বিতীয় গ্রুপে থাকল সুইডেন, যেটি ‘ওয়েলফেয়ার স্টেট’-এর নবতর সংস্করণ আঁঁকড়ে ছিল। তৃতীয় গ্রুপে রইল ফ্রান্স, যারা ‘রাষ্ট্র-নির্দেশিত’ উন্নয়নের উপর বেশি জোর দিচ্ছিল। আর চতুর্থ গ্রুপে ছিল ওলন্দাজেরা যারা ‘বাজার’ ও ‘নাগরিক সমাজ’—এই দুই উপাদানের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রকার্য পরিচালনা করছিল। আমাদের দেশেও এরকম কোন তৃতীয় পন্থার প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে কিনা—এ প্রশ্ন একুশ শতকে কখনো আমাদের মনে জাগতে বাধ্য।

কিন্তু গিডেন্স যা-ই বলুন না কেন, কার্যত তাঁর ভাবশিষ্য ব্লেয়ার বা ব্রাউন কেউই রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে নতুন কোন উপায় উদ্ভাবন করতে পারেননি। ইরাকের যুদ্ধে জড়িয়ে গেলেন ব্লেয়ার নিজে, ‘ওয়েপনস্ অব মাস ডেস্ট্রাকশন’ সংক্রান্ত মিথ্যে বিবৃতি দিয়ে, ক্লিনটন ঠেকাতে পারলেন না রুয়ান্ডায় ও বসনিয়ায় গণহত্যা, ব্রাউনের শাসনে শিক্ষাখাতে প্রবেশাধিকারের বৈষম্য বেড়ে চলল খোদ ব্রিটেনেই, ফ্রান্সে ও জার্মানিতে আরো কড়াকড়ি আরোপ করা হলো অভিবাসী আইনের উপর। আজ যারা নতুন করে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির সাথে সহযোগিতার কথা বলছেন তাদের সে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মনে রাখতে হবে। ক্ষমতাসীন হয়ে তৃতীয় পথের ইউরোপীয় পথিকেরা তাদের নিজেদের দেশের সাধারণ জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার আদায়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আশাভঙ্গের কারণ হয়েছেন (তৃতীয় বিশ্ব থেকে যাওয়া অভিবাসীদের অধিকারের অব্যাহত দৈন্যদশার কথা তো বাদই দিলাম)। প্রচলিত অধিকাংশ সূচকে তের বছরের লেবার পার্টির শাসনে যুক্তরাজ্য আরো বেশি অসম সমাজে পরিণত হয়েছে—এ-ই হচ্ছে সমাজতাত্ত্বিকদের অভিমত। একথা সত্য সোশালিস্ত শাসনাধীন ফ্রান্স ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক শ্রোয়েডারের আমলের জার্মানির ক্ষেত্রেও। অর্থাত্ তৃতীয় পন্থা কোন পরীক্ষিত আদর্শ হয়ে বিশ্ব-পরিসরে এখনো দাঁড়াতে পারেনি। এটাও গত দুই দশকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।

তৃতীয় পথের আরেকটি চিহ্ন আমরা পাই লাতিন আমেরিকায় গত এক দশকের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা থেকে। এখানেও বিভিন্ন ধারার তৃতীয় পন্থার সমাবেশ। প্রথম ধারায় রয়েছে ব্রাজিল ও চিলি। উদারনৈতিক অর্থনীতির সাথে সামাজিক ন্যায়বিচার মিলিয়ে তৃতীয় পথের নজির স্থাপন করেছেন কারখানা শ্রমিক থেকে প্রেসিডেন্ট হওয়া ব্রাজিলের ট্রেড ইউনিয়ন নেতা লুলা দা সিলভা।

২০০৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। ব্রাজিলের ওয়ার্কার্স পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লুলা ছিলেন টাইম সাময়িকীর চোখে সর্বকালের জনপ্রিয় ও সফলতম রাষ্ট্রনায়কদের একজন। লুলার ধারায় পড়বেন চিলির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট মিশেল বেশেলেত্, ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত যিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর পিতা বিমানবাহিনীর জেনারেল এলবের্তো বেশেলেত্ ১৯৭৪ সালে কুখ্যাত ফ্যাসিস্ত জেনারেল পিনোচেট-এর শাসনে বন্দী অবস্থায় নির্মমভাবে অত্যাচারিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

লুলা ও বেশেলেত্ উভয়েই তাদের শাসনামলে নানা ধরনের সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ (যেমন, মানবউন্নয়নের সাথে যুক্ত করে গরিবদের জন্য ‘কন্ডিশনাল ক্যাশ ট্রান্সফার’ কর্মসূচী) চালু করেন যার সুফল পেয়েছে সেসব দেশের জনগণ। তবে লুলা ও বেশেলেত্ দুজনেই বাজেট-ঘাটতি কমানোর ক্ষেত্রে ছিলেন অতি তত্পর, এবং বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বাইরের থেকে আনার ক্ষেত্রে অতি আগ্রহী।

লাতিন আমেরিকার তৃতীয় পথের ‘মধ্যপন্থী’ ধারায় ছিলেন আর্জেন্টিনার নেস্টর কির্শনের—২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তাঁরই স্ত্রী ক্রিস্টিনা কির্শনের। ২০১০ সালে হার্ট-সার্জারির কালে মৃত্যুবরণ করা পর্যন্ত নেস্টর কির্শনের ছিলেন ‘ওয়াশিংটন কনসেন্সাস’-এর তীব্র সমালোচক, এবং ‘বামপন্থী প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে বহুল আলোচিত। এঁদের বিপরীতে রয়েছেন গণতান্ত্রিক ভোটে নির্বাচিত আরো বেশি র্যাডিকেল ধারার নেতৃত্ব, যেমন ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ (১৯৯৯ সাল থেকে রয়েছেন ক্ষমতায়) ও বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট এভো মরালেস (২০০৬ সাল থেকে আছেন রাষ্ট্রকার্যে)। এই দু’জন লাতিন আমেরিকার তৃতীয় পন্থায় সবচেয়ে বেশি বামের অবস্থানে। বৈদেশিক বিনিয়োগের উপর জাতীয় গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ, পশ্চিম গোলার্ধে বহুজাতিক পুঁজির আধিপত্যকে হ্রাস, মার্কিনী প্রভাবকে প্রতিহত করার প্রয়াস, দেশের ভেতরে জনতুষ্টিবাদী নানা সামাজিক কর্মসূচী, গরিব ও আদিবাসীদের ক্ষমতায়ন ও স্বার্থ-সংরক্ষণ ইত্যাদি নানা পদক্ষেপে এসব দেশের সরকার এক ভিন্ন ঐতিহ্য রেখে গেছেন (এবং এখনো যাচ্ছেন) যা ইউরোপের তৃতীয় পন্থা থেকে অনেকটাই আলাদা।

নানা ঝোঁক বিশিষ্ট লাতিন আমেরিকার এই নতুন ‘তৃতীয় পন্থা’ নিয়ে আমাদের দেশে এখনো কোন আলোচনা, নিবিড় সংলাপ বা বিতর্ক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়াল-লিখন বলবার মতো করে চোখে পড়েনি। এর থেকেও আমাদের চলতি জ্ঞানকাণ্ডের বিশ্ব-বিচ্ছিন্ন চর্চার নিঃসঙ্গতা আঁঁচ করা যায়। আমাদের দেশেও লুলা বা বেশেলেত্ বা চাভেজ বা মরালেস বা কির্শনের (বা ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল অবধি উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট তাবারে ভাসকুয়েজ) অথবা এসব উদ্যোগের কোন মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে সামাজিক-অর্থনৈতিক নীতিমালায় ভিন্ন ধরনের ছকের অনুসরণ সম্ভব কিনা আগামী দুই দশকের বাংলাদেশে—এ প্রশ্ন ওঠা আজ আর অবান্তর নয়। ঝোঁক যা-ই হোক না কেন, তৃতীয় পন্থার অভিজ্ঞতা লাতিন আমেরিকায় এক নতুন যুগের সৃষ্টি করেছে—আশি/নব্বই দশকের ‘লস্ট ডেকেডের’ তুলনায় তাত্পর্যপূর্ণ অগ্রগতি এসেছে এসব দেশের সাধারণ মানুষের জীবন-যাত্রার মানে, প্রসারিত হয়েছে সিভিল সমাজের ক্ষমতায়ন, সামরিক শাসনের ভয়কে আইনী ভাবে ও নৈতিক ভাবে প্রাতিষ্ঠানিক বলয় থেকে সমূলে উত্পাটিত করা হয়েছে, এবং এই সবই করা হয়েছে ব্যালটের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে। ফলে ইতিহাসের পার্থক্য যা-ই থাক্ না কেন, বাংলাদেশের আধুনিক ও সম্ভাব্য উত্তর-আধুনিক অগ্রযাত্রায় লাতিন আমেরিকার তৃতীয় পন্থার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু আদরনীয় উপাদান সংগ্রহের বা অন্তত বিবেচনায় নেওয়ার মতো চিন্তা-ভাবনার খোরাক রয়ে গেছে বলে মনে হয় আমাদের।

৪. দক্ষিণ এশিয়ার জন্য তৃতীয় পথের বিতর্ক অবশ্য বেশ খানিকটা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে অগ্রসর হতে হবে। এর মূল কারণ আমাদের ইতিহাস ও সামাজিক বিকাশের ধারার ভিন্ন পরিস্থিতি। ফলে ইউরোপের বা লাতিন আমেরিকার তৃতীয় পন্থার তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কোন ঝোঁক বা ধারা দেখা দেবে কালক্রমে সেটাই স্বাভাবিক। ভারতে সোনিয়া গান্ধী-মনমোহন সিং-এর কংগ্রেস গত দুই দশক ধরে মূলত বাজার-মুখীন পুঁজিবাদের পথ অনুসরণ করছে, যা এর আগের নেহেরু-ইন্দিরা-রাহুল গান্ধী আমলের রাষ্ট্র-নির্ভর পুঁজিবাদের থেকে অনেকটাই আলাদা চরিত্রের। এই পরিবর্তন এসেছে রাষ্ট্র-নির্ভর পুঁজিবাদের সংকট থেকে—১৯৯১ সালে বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে তীব্র ঘাটতি ছিল এই সংকটের একটি উপসর্গ মাত্র। পলিসির ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছিল কোন তৃতীয় পন্থা অনুসরণের ইউরোপীয় বা লাতিন আমেরিকীয় তাগিদ থেকে নয়। এবারে (কংগ্রেস-এর দ্বিতীয় দফা ক্ষমতার কালে) অবশ্য ভারতে ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’-এর কথা মাঝে-মাঝে বলা হচ্ছে। এর কারণ প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে লক্ষণীয় অগ্রগতি সত্ত্বেও সামাজিক উন্নয়নে ভারত এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। কাশ্মীর প্রশ্নে অচলাবস্থা যেমন অব্যাহত, তেমনি দেশের ভেতরে অনগ্রসর এলাকা, রাজ্য ও জাতিগোষ্ঠীর সুষম বিকাশের প্রশ্নে কোন সমাধান দিতে পারেনি ভারতীয় এই নয়া-উন্নয়নের মডেল। পাশাপাশি দুর্নীতিও একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতে। এমনকি প্রথাগত উন্নয়নবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতেও—যথা দারিদ্র-প্রবণতা, অঞ্চলগত আয়-বৈষম্য, নারী-শিক্ষা ও শিশুপুষ্টিসহ মানব-উন্নয়নের সরলতম নানা সূচকের নিরিখে—এই মডেলের সীমাবদ্ধতা এখন সুস্পষ্ট। দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক শান্তি ও সহযোগিতা কার্যকর করার ক্ষেত্রেও দিল্লীর ব্যর্থতা ও প্রধান দায়-দায়িত্ব এড়াবার নয়।

আমাদের দেশে তৃতীয় পথের কোন আলোচনাই এখনো জাতীয় পরিসরে উত্থাপিত হয়নি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-র নেতৃত্বাধীন জোট সরকারগুলো প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ক্ষমতায় এসে মূলত একই প্রকারের অর্থনৈতিক নীতিমালা অনুসরণ করে চলেছে। বাজার-মুখীন প্রবৃদ্ধির সাথে কিছুটা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী মিলিয়ে তথাকথিত ‘মধ্য-আয়ের’ দিকে চলার চেষ্টা চলছে, যেন এর বাইরে উন্নয়ন-অভিজ্ঞতায় আর কোন ‘ছক’ আমাদের জানা নেই! কৃষি, প্রবাসী আয়, গার্মেন্ট শিল্প এবং মাইক্রো-ফাইন্যান্স—এই চারটি প্রধান উপাদানের বিকাশের কারণে আমাদের দেশে প্রবৃদ্ধি কিছুটা বেড়েছে এবং দারিদ্র বেশ কিছুটা কমেছে। কিন্তু এর পাশাপাশি আরো প্রবলভাবে বাড়ছে আয়-বৈষম্য ও সম্পদ-বৈষম্য, যার পেছনে রয়েছে উপার্জিত আয়ের বণ্টনে বৈষম্যের পাশাপাশি ‘অনুপার্জিত আয়ের’ বণ্টনে প্রবলতর বৈষম্য। বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা, দুর্নীতি নির্ভরতা ও পরিবেশ-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড। দুর্নীতি-প্রবণ ও পরিবেশ-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড প্রবৃদ্ধি বাড়ায় ঠিকই, কিন্তু আয় ও সম্পদের বৈষম্যকে তা বহুগুণে উসকে দেয় এবং ভবিষ্যতে দারিদ্র-দূরীকরণের পথে এধরনের প্রবৃদ্ধিমুখীন কর্মকাণ্ড শেষ পর্যন্ত বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

প্রধান দুই রাজনৈতিক দল যে-উন্নয়ন দর্শন আঁঁকড়ে ধরে আছে এখনো, তাতে করে এসব দলের চিন্তকেরা (বা দলীয় পরামর্শকেরা) স্ব-উদ্যোগে কোনো তৃতীয় ধারার কথা ভাববেন ইউরোপের বা লাতিন আমেরিকার ‘তৃতীয় পথ’-এর আদলে, সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বিপরীতে তৃতীয় কোনো রাজনৈতিক সমাবেশ গণতন্ত্রের গত দুই দশকে দানা বাঁধতে পারেনি। তৃতীয় দলের নামে গুটিসুটি যেসব কর্মকাণ্ড নিকট অতীতে দেখা গিয়েছিল তার আবার অনেকটাই সামরিক বাহিনী সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আনুকূল্যে বা প্রশ্রয়ে অনুপ্রাণিত। ফলে জনমনে সেসব কার্যক্রমের গ্রহণযোগ্যতা গোড়া থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। মোদ্দাকথা, আমাদের দেশে প্রথাগত উন্নয়নের ধারার বিপরীতে বিকল্প কৌশল নির্মাণে একটি সমতাবাদী স্বাধীন গণতান্ত্রিক মানবিক সমাজের আদর্শ ও ছক কীভাবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে বিকশিত হতে পারে তা নিয়ে কোনো আলোচনা উপস্থাপিত হচ্ছে না। রাষ্ট্র-সর্বস্ব সমাজতন্ত্রের দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে, বিশ্ব-পুঁজিবাদের অস্থিরতা ও বৈষম্য এড়িয়ে, আধুনিক প্রযুক্তিগত বিকাশকে আত্মস্থ করে আরো কল্যাণমুখী একটি সমাজ-ব্যবস্থা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তা নিয়ে কোনো বিতর্ক হচ্ছে না আমাদের জ্ঞানকাণ্ডে। এই অর্থে আমরা ভাবাদর্শগত এক স্বেচ্ছা-আরোপিত নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে আটকে পড়ে গেছি এমন বোধ হয়। পরস্পর পিঠ-চাপড়ানির পাতানো বাদানুবাদের মধ্য দিয়ে আজকের জ্ঞানচর্চার সংকট থেকে মুক্তি আসবে না। লুই আলথুসার যেমন বলেছিলেন, ‘পুশ থটস্ টু এক্সট্রিমস্’ অর্থাত্ এর জন্যে প্রয়োজনে চিন্তাকে চরম অবস্থানের দিকে ঠেলে দিয়ে এর ন্যায্যতা পরীক্ষা করতে হবে। এই উপলব্ধি থেকেও প্রতিচিন্তা প্রকাশের তাগিদ আমরা অনুভব করেছি।

কিন্তু আমাদের জ্ঞান সীমিত, আমাদের উদ্যোগে আয়োজনের অভাব, পূর্বানুমিত কোন আদর্শের কম্পাস নেই আমাদের হাতে। আমাদের আকাঙ্ক্ষা আমাদের সামর্থ্যকে ছাড়িয়ে যায়। এই নতুন জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য তৃতীয় পন্থার বা ‘অন্য পন্থার’ কিছু কিছু মৌল উপাদান আজ হয়তো নানাভাবেই চিহ্নিত করা সম্ভব। এই চিহ্নিত করার কাজটি কারো একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার সমষ্টির সাহস। এই জন্য দরকার মতবিনিময়, তর্ক-বিতর্ক, ভিন্ন পথ খোঁজা। এই জন্য দরকার—প্রতিচিন্তা। তদুপরি এই অন্বেষণ কোনো দার্শনিক বিমূর্তায়নের বলয়ে হচ্ছে না, এটা হচ্ছে আমাদের সময়ের প্রেক্ষিতে, যে-কালের মধ্যে ধরা থাকছে আমাদের স্বদেশ, সমাজ ও রাজনীতি, আমাদের ভূগোলের ১৬ কোটি মানুষের দৈনন্দিনের সংগ্রাম ও অনুশীলন। বাংলাদেশের পটভূমিতে আমাদের ভিন্ন পথ খোঁজা। এই জন্যেও দরকার—প্রতিচিন্তা।