
রমজান মাসে সক্ষম মুমিন নারী-পুরুষের রোজা পালন করা ফরজ ইবাদত। কিন্তু যারা রোজা পালনে সক্ষম নয়, তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য রমজানে রয়েছে বিশেষ ছাড়। করুণাময় আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘সিয়াম বা রোজা নির্দিষ্ট কয়েক দিন (এক মাস মাত্র)। তবে তোমাদের মধ্যে যারা পীড়িত থাকবে বা ভ্রমণে থাকবে, তারা অন্য সময়ে তা এর সমপরিমাণ সংখ্যায় পূর্ণ করবে। আর যাদের রোজা পালনের সামর্থ্য নেই, তারা এর পরিবর্তে ফিদ্ইয়া দেবে একজন মিসকিনের খাবার। অনন্তর যে ব্যক্তি অধিক দান করবে, তবে তা তার জন্য অতি উত্তম। আর যদি তোমরা পুনরায় রোজা পালন করো তবে তা তোমাদের জন্য অধিক উত্তম।’ (আল কোরআন, সুরা-২ [৮৭] আল বাকারা (মাদানি), রুকু: ২৩/৭, আয়াত: ১৮৪, পারা: সাইয়াকুল-২, পৃষ্ঠা: ২৮/৬)।
রমজানে রোজা ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত হলো: (১) স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া, (২) সাবালক হওয়া, (৩) সুস্থ ও সক্ষম হওয়া, (৪) নারীদের পবিত্র অবস্থায় থাকা, (৫) সফর বা ভ্রমণে না থাকা। দয়াময় আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘রমজান মাস! যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে মানবের দিশারিরূপে ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শন হিসেবে। সুতরাং তোমাদের যারা এ মাস পাবে, তারা যেন তাতে রোজা পালন করে। আর তোমাদের যারা পীড়িত থাকবে বা ভ্রমণে থাকবে, তারা অন্য সময়ে তা এর সমপরিমাণ সংখ্যায় পূর্ণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তিনি তোমাদের প্রতি কঠিন করতে চান না; যাতে তোমরা আল্লাহর মাহাত্ম্য ঘোষণা করো যে তিনি তোমাদের হিদায়াত দিয়েছেন সে জন্য এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।’ (আল কোরআন, সুরা-২ [৮৭] আল বাকারা (মাদানি), রুকু: ২৩/৭, আয়াত: ১৮৪, পারা: সাইয়াকুল-২, পৃষ্ঠা: ২৯/৭)।
ইসলামের বিধান পালন করা হয় মানুষের নিজেদের স্বার্থে বা নিজেদের উপকারার্থে; এতে আল্লাহ তাআলার লাভ, স্বার্থ
বা উপকার নেই। সুতরাং আল্লাহ তাআলা মানুষের কল্যাণের জন্য বিধান দিয়েছেন মানুষেরই সামর্থ্য অনুযায়ী। মহান প্রভু বলেন: ‘আল্লাহ কোনো সত্তাকে তার সামর্থ্যের অধিক দায়িত্ব চাপান না।’ (আল কোরআন, সুরা-২ [৮৭] আল বাকারা (মাদানি), রুকু: ৪০/৮, আয়াত: ২৮৬, পারা: তিলকার রাসুল-৩, পৃষ্ঠা: ৫০/৮)।
হাদিস শরিফে আছে, যখন কোরআন করিমের আয়াত নাজিল হলো: ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথরূপে ভয় করো।’ (সূরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১০২)। (আল কোরআন, সুরা-৩ [৮৯] আলে ইমরান (মাদানি), রুকু: ১১/২, আয়াত: ১০২, পারা: লান তানালু-৪, পৃষ্ঠা: ৬৪/২)। তখন সাহাবায়ে কিরাম অসহায়ত্ব ও অপারগতা প্রকাশ করে নবীজি (সা.)-এর দরবারে আবেদন করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! (সা.) মহান আল্লাহ তাআলার শান মতো তাঁকে যথার্থরূপে ভয় করা আমাদের পক্ষে কীভাবে সম্ভব! আপনি আমাদের তরফ থেকে আল্লাহ তাআলার দরবারে এই বিষয়টি সহজ করার আবেদন করুন। তখন আল্লাহ তাআলা মেহেরবানি করে নাজিল করলেন: ‘তবে তোমরা তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী আল্লাহকে ভয় করো; আর তোমরা শোনো ও আনুগত্য করো।’ (আল কোরআন, সুরা-৬৪ [১০৮] আত তাগাবুন (মাদানি), রুকু: ২/১৬, আয়াত: ১৬, পারা: কাদ সামিআল্লাহ-২৮, পৃষ্ঠা: ৫৫৮/১৬)।
কেউ যদি সফরে বা ভ্রমণে থাকেন, তিনি সম্ভব হলে রোজা পালন করবেন; এটাই উত্তম। আর কষ্ট হলে রোজা ছাড়তে পারবেন; তবে এই রোজা পরে কাজা আদায় করতে হবে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কোনো এক রমজানে রোজা অবস্থায় মক্কার পথে যাত্রা করলেন। কাদিদ নামক স্থানে পৌঁছার পর তিনি রোজা ছেড়ে দিলে সবাই রোজা ছেড়ে দিলেন। (বুখারি শরিফ, সওম অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ১,২১৭, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ২৬১-২৬২, হাদিস: ১,৮২০)।
অনুরূপ মুসাফির বা ভ্রমণকারীর জন্য নামাজেও ছাড় রয়েছে। চার রাকাত ফরজ নামাজগুলো কসর (সংক্ষিপ্ত) অর্থাৎ দুই রাকাত আদায় করবে। সুন্নতে মুআক্কাদাগুলো নফলের পর্যায়ে চলে যাবে। আদায় করলে সুন্নতের সওয়াব পাবে; তরক করলে নফল নফল তরকের মতো হবে।
ফিদ্ইয়া আরবি শব্দ। অর্থ হলো বিনিময়, মূল্য, পণ বা মুক্তিপণ; বিকল্প বা স্থলাভিষিক্ত; সম্মানজনক প্রতিদান। (লিসানুল আরব)। যদি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমান বার্ধক্য, অসুস্থতা বা যেকোনো কারণে রোজা পালনে অক্ষম বা অপারগ হন এবং পুনরায় সুস্থ হয়ে বা সক্ষমতা ফিরে পেয়ে রোজার কাজা আদায় করার মতো সম্ভাবনাও না থাকে। এমতাবস্থায় এই ব্যক্তির প্রতিটি রোজার জন্য একটি সদকাতুল ফিতরের পরিমাণ সদকা আদায় করতে হবে।
ফিদ্ইয়া জাকাত ও সদকার হকদারদের বা জাকাত প্রদানের খাতসমূহে প্রদান করা যাবে। এক দিনের ফিদ্ইয়া একাধিক ব্যক্তির মাঝে বণ্টন করে দেওয়া যাবে আবার একাধিক দিনের ফিদ্ইয়া এক ব্যক্তিকে দেওয়া যাবে। কয়েক দিনের রোজার ফিদ্ইয়া একত্রেও আদায় করা যায় এবং অগ্রিমও প্রদান করা যায়। যাকে ফিদ্ইয়া দেওয়া হবে তার রোজাদার হওয়া জরুরি নয়, যেমন: নাবালেগ মিসকিন শিশু বা অতিবৃদ্ধ দুর্বল অক্ষম অসুস্থ অসহায় গরিব ব্যক্তি, যিনি নিজেও রোজা পালন করতে পারছেন না। একজনের রোজা আরেকজন রাখতে পারে না, তাই ফিদ্ইয়া রোজার পরিবর্তে রোজা নয়; ফিদ্ইয়া হলো রোজার পরিবর্তে খাদ্য বা উহার মূল্য প্রদান করা। (ফাতাওয়া আজিজি)।
অন্তঃসত্ত্বা নারীরা রোজা রাখলে যদি তাঁর নিজের বা গর্ভস্থ সন্তানের সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা থাকে; তবে পরে কাজা আদায় করতে পারবেন। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ধর্মীয় বিধানের গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। বিনা কারণে বা সামান্য অজুহাতে ফরজ রোজা ছাড়া যাবে না। (ফাতাওয়া আজিজি)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।