
উত্তম স্বভাব, উত্তম আচরণ ও উত্তম কাজ, যা মানুষের মানবিক গুণাবলি ও সুকুমারবৃত্তির বিকাশ সাধন করে, সেসবকে ফাজায়েল বলা হয়। মৌলিক ১০টি ফাজায়েল হলো: ১. তওবা (গুনাহের জন্য অনুতাপ করা, ক্ষমা চাওয়া); ২. ইনাবাত (সর্বদা আল্লাহর দিকে রুজু থাকা); ৩. যুহদ (দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তি); ৪. অরা (সন্দেহজনক জিনিস থেকে বেঁচে থাকা); ৫. শোকর (কৃতজ্ঞতা); ৬. সবর (ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা); ৭. তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর নির্ভরশীলতা); ৮. কানাআহ (অল্পে তুষ্টি বা স্বল্পে সন্তুষ্ট থাকা); ৯. তাছলিম (আল্লাহর হুকুম-আহকাম তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া এবং আল্লাহর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা) এবং ১০. রেজা বা রেদা (আল্লাহর ইচ্ছার ওপর রাজি থাকা, খুশিমনে তাঁর আনুগত্য করা)।
সবর
‘সবর’ অর্থ ধৈর্য, সহ্যক্ষমতা, সহিষ্ণুতা ইত্যাদি। বাংলায় সবুর বা ছবুর লেখা হয়। ছাবির অর্থ ধৈর্যশীল পুরুষ, ছাবিরা মানে ধৈর্যশীলা নারী। ইসলামি পরিভাষায় সবর হলো অপারগ হয়ে ধৈর্য অবলম্বন করা। সবরের উন্নততর অবস্থাকে বলে ‘হিলম’ (সহিষ্ণুতা), যার মানে হলো সক্ষমতাসহ ধৈর্য ধারণ করা। আল্লাহ তাআলার সবর হিলম অর্থেই পরিগণিত হয়। কখনো সবর ও হিলম একই অর্থে বা একটি অন্যটির স্থলে ব্যবহৃত হয়। সবর মানুষের অনন্য বৈশিষ্ট্য। মানবজীবনের সফলতা অর্জনের জন্য সবর বা ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই। ‘সবর’-এর জোড়া শব্দ হলো শোকর। যথা: ‘সবর-শোকর’ বা ‘শোকর-সবর’। সবর ও শোকরের অন্তর্নিহিত বা ভাবগত সম্পর্ক রয়েছে। সবর করলে আল্লাহ খুশি হয়ে নিয়ামত দেবেন, যা পেয়ে শোকর করতে হবে। সবর সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন: ‘তোমরা ধৈর্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই আছেন।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৩)।
সবর তিন প্রকার। যথা: ১. সবর আনিল মাছিয়াত (পাপ থেকে বিরত থাকা); ২. সবর আলাত তআত (ইবাদতে কষ্ট স্বীকার করা) এবং ৩. সবর আলাল মুসিবাত (বিপদে ধৈর্য ধারণ করা)। এই তিনের সমন্বয় হলো পরিপূর্ণ সবর।
তাওয়াক্কুল
‘তাওয়াক্কুল’ অর্থ নির্ভর করা ও ভরসা করা। বাংলা উচ্চারণে তাওয়াক্কাল বা তওয়াক্কালও বলা হয়ে থাকে। ইসলামি পরিভাষায় তাওয়াক্কুল হলো কর্ম শেষে ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা ও নির্ভরতা। কর্মবিহীন তাওয়াক্কুল অর্থহীন। যার ওপর তাওয়াক্কুল করা হয়, তাকে বলে ওয়াকিল বা উকিল। ‘আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট, তিনি সর্বোত্তম অভিভাবক।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৭৩)। তাওয়াক্কুল মানুষকে দুশ্চিন্তামুক্ত সহজ-সরল ও আনন্দঘন জীবন উপহার দেয়। তাওয়াক্কুল (ভরসা, নির্ভরতা) সাধারণত নফছ দ্বারাই সম্পাদিত হয়। পর্যায়ক্রমে তা বিভিন্ন স্থানে বাহ্যিকভাবে প্রকাশ পায়। তাওয়াক্কুলের সঙ্গে নফছের (প্রবৃত্তির) সম্পর্ক। তাওয়াক্কুল সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন: যে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, তবে তিনি তার জন্য যথেষ্ট। (সুরা-৬৫ তলাক, আয়াত: ৩)। ‘আল্লাহ আমার জন্য যথেষ্ট, নির্ভরকারীগণ তাঁর ওপরই নির্ভর করে।’ (সুরা-৩৯ জুমার, আয়াত: ৩৮)।
কানাআহ
‘কানাআহ’ অর্থ অল্পে সন্তুষ্ট হওয়া বা স্বল্পে তুষ্টি। উর্দু, ফারসি, বাংলা ও হিন্দিতে একে ‘কানাআত’ বলা হয়। ইসলামি পরিভাষায় কানাআত হলো হালালভাবে সহজ উপায়ে আল্লাহ যা দিয়েছেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকা। ১০টি ফাজায়েল বা বিশেষ ১০টি উত্তম স্বভাবের অষ্টমটি হলো কানাআত বা তুষ্টতা। কানাআত রুচিশীল মানুষের সম্ভ্রান্ততার পরিচায়ক। কানাআত (তুষ্টি বা সন্তোষ) আব লতিফা দ্বারা সংঘটিত হয়। পর্যায়ক্রমে তা প্রকাশ পায়। তাই কানাআতের সঙ্গে লতিফায়ে আব-এর সম্পর্ক বিদ্যমান। এর দ্বারা অল্পে সন্তোষ লাভ করার ক্ষমতা জন্মে এবং ভবিষ্যতে বহু ধন-দৌলতের আকাঙ্ক্ষা হয় না। এর দ্বারা
মানুষ স্বীয় মনোজগতে যেমন শান্তি ও সুখ লাভ করে এবং সমৃদ্ধির তৃপ্তি অনুভব ও স্বাদ আস্বাদন করে, তেমনি মানবসমাজে সম্মানের পাত্রে পরিণত হয়। কানাআত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন: ‘যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তোমরা তাহা হতে আহার করো এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্ত ও যাঞ্ছাকারী অভাবীকে। এভাবেই আমি তাদিগকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।’ (সুরা-২২ হজ, আয়াত: ৩৬)।
তাছলিম
‘তাছলিম’ অর্থ আত্মসমর্পণ, সম্মতি প্রদান, আনুগত্য ও স্বীকৃতি জ্ঞাপন ইত্যাদি। বাংলায় তাসলিম, তসলিম ও তছলিম লেখা হয়। ইসলামি পরিভাষায় তাছলিম হলো আল্লাহর হুকুম-আহকাম সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেওয়া এবং আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা। আল্লাহর হুকুম মানার ক্ষেত্রে যুক্তিতর্কে প্রবৃত্ত না হওয়া ও কার্যকারণ অনুসন্ধানে লিপ্ত না হয়ে অকৃত্রিম ও সরল মনে আনুগত্য করা। এটি ইসলাম শব্দের মূল ক্রিয়া থেকে নিষ্পন্ন। আল্লাহ যখন যে অবস্থায় রাখেন, তাতে অনুগত ও সম্মত থাকা তাছলিম বান্দার সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য। তাছলিম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন, ‘তার প্রতিপালক যখন তাকে বললেন, আত্মসমর্পণ করো; সে বলল, আমি আত্মসমর্পণ করলাম জগৎসমূহের প্রভুর সমীপে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৩১)। ‘যখন তারা উভয়ে (ইব্রাহিম ও ইসমাইল) আনুগত্য প্রকাশ করল এবং সে (ইব্রাহিম) তাকে (ইসমাইলকে কোরবানি করার জন্য) কাত করে শোয়াল, আর আমি তাকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহিম! তুমি তোমার স্বপ্নাদেশ (কোরবানি) সত্যই বাস্তবায়ন করলে; এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয় এ ছিল এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা।’ (সুরা-৩৭ ছফফাত, আয়াত: ১০৩-১০৬)। ‘তিনি (রানি বিলকিছ) বললেন, হে আমার প্রভু! আমি আমার নিজের প্রতি অবিচার করেছি; আমি আত্মসমর্পণ করলাম জগৎসমূহের রবের প্রতি, সুলাইমান (আ.)-এর সহিত।’ (সুরা-২৭ নমল, আয়াত: ৪৪)।
রিযা
‘রিযা’ অর্থ সন্তোষ, সন্তুষ্টি, তৃপ্তি, তুষ্টি, স্বীকৃতি জ্ঞাপন, সম্মতি প্রদান ইত্যাদি। মূল আরবি উচ্চারণে রিদা বা রেদা। উর্দু, ফারসি, হিন্দি ও বাংলায় রেজা বা রেযা হয়। ইসলামি পরিভাষায় ‘রিযা’ হলো আল্লাহর হুকুম-আহকাম সানন্দচিত্তে মেনে নেওয়া এবং তা সম্পাদন শেষে তৃপ্তি অনুভব করা। আল্লাহর হুকুম মানার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করা। আল্লাহ যখন যে অবস্থায় রাখেন, তাতে আনন্দিত ও খুশি থাকা। ‘রিযা’ বান্দার সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। রিযার জোড়া শব্দ হলো তাছলিম। যেমন ‘রেজা ও তাছলিম’ (সন্তুষ্টি ও আনুগত্য) বা ‘তাছলিম ও রেজা’। রিযা মূলত তাওয়াক্কুল, ইখলাছর ও ইয়াকিনের বাহ্যরূপে প্রকাশ পায়। একে আকায়েদের পরিভাষায় ‘রিযা বিল কযা’ বলা হয়। অর্থাৎ কযা তথা আল্লাহর ফয়সালা ও সিদ্ধান্ত এবং কদর তথা তাকদির মানে ভাগ্যের ওপর সর্বোপরি আল্লাহর ইচ্ছার ওপর রাজি থাকা। কখনো রিযা ও তাছলিম সমার্থক হয় বা একটি অন্যটির স্থানে ব্যবহৃত হয়। তবে রিযায় তৃপ্তি ও তাছলিমে আনুগত্য প্রধান। তাই রিযা সাধকের পরম অবস্থান। রিযা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার রবের নিকট ফিরে আসো, সন্তুষ্ট হয়ে। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।’ (সুরা-৮৯ ফজর, আয়াত: ২৭-৩০)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।