ইসলাম ও আত্মিক উন্নতি

ধর্ম
ধর্ম

মানুষ আত্মার নাম; দেহ তার বাহন। ব্যক্তি হলো গুণাবলিসহ সত্তার নাম। তাই আত্মিক উন্নতি ব্যতীত মানুষ অন্য প্রাণীর তুল্য। আত্মিক বা আধ্যাত্মিক মানে হলো আত্মসম্পর্কিত, আত্মার সঙ্গে যোগ আছে যার। উন্নতি তথা ইতিবাচক পরিবর্তন বা মনোজাগতিক ইতিবাচক পরিবর্তন।
আচরণে (কর্মে) অভীষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তথ্য প্রদান বা জ্ঞান দান করাকে শিক্ষা বলে। খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর এক প্রশ্নের জবাবে হজরত উবায় ইবনে কাআব (রা.) বলেন, ‘ইলম হলো তিনটি বিষয়—আয়াতে মুহকামাহ (কোরআন), প্রতিষ্ঠিত সুন্নত (হাদিস) ও ন্যায় বিধান (ফিকহ)।’ (তিরমিজি)। ন্যায় হলো যা ন্যায্য, যার যা পাওনা বা অধিকার, তা প্রতিষ্ঠা করা ও আদায় তথা প্রদান করা।
আমরা শিক্ষিত কাকে বলি? হজরত উমর (রা.)-এর এ প্রশ্নের উত্তরে হজরত উবায় ইবনে কাআব (রা.) বলেন, ‘(শিক্ষিত তিনি) যিনি শিক্ষানুযায়ী কর্ম করেন (অর্থাৎ শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষাও থাকে)।’ (সহিহ তিরমিজি ও সুনানে আবু দাউদ)।
আত্মিক উন্নতির জন্য প্রয়োজন সদ্গুণাবলি অর্জন ও ষড়্রিপু নিয়ন্ত্রণ। সদ্গুণাবলিকে পরিভাষায় বলা হয় ফাজায়িল বা অর্জনীয় উত্তম বৈশিষ্ট্যাবলি। আর ষড়্রিপুসহ বর্জনীয় বদগুণাবলিকে বলা হয় রজায়িল বা মন্দস্বভাবসমূহ। মানুষ দোষে-গুণে সৃষ্টি। সাধারণত মানুষের মধ্যে ১০টি সদ্গুণ ও ১০টি বদগুণ বিদ্যমান থাকে। পরিভাষায় এগুলোকে রজায়িল (কুপ্রবৃত্তি) ও ফাজায়িল (সুকুমারবৃত্তি) বলা হয়। মানুষের উচিত বদগুণ বর্জন ও সদ্গুণ অর্জনের মাধ্যমে পূর্ণতা অর্জন করা। এ ছাড়া কিছু উত্তম বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অর্জন করা মানুষের জন্য বাঞ্ছনীয় ও প্রশংসনীয় এবং আত্মিক উন্নতির পথে সহায়ক।
আত্মিক উন্নতি সম্বন্ধে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদের মধ্য থেকে তাদের নিকট এক রাসুল প্রেরণ করুন, যিনি আপনার আয়াতসমূহ তাদের নিকট তিলাওয়াত করবেন; তাহাদিগকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। আপনি তো পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৯)। ‘অতঃপর উহাকে উহার অসৎ কর্ম ও উহার সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে-ই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে। এবং সে-ই ব্যর্থ হবে, যে নিজকে কুয়াশাচ্ছন্ন করবে।’ (সূরা-৯১ শামছ, আয়াত: ৮-১০)।’
কিতাবিদের মধ্যে যারা কুফরি করে, তারা এবং মুশরিকরা জাহান্নামের অগ্নিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে; তারাই সৃষ্টির অধম। যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে, তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। (সূরা-৯৮ বাইয়িনা, আয়াত: ৬-৭)।
আত্মিক উন্নতি সম্পর্কে হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে এমন একটি অংশ আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীর তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে অঙ্গটি হলো কলব।’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৯-৪০, হাদিস: ৫০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, পঞ্চম সংস্করণ)।
হারাম ও সন্দেহজনক কার্যাবলি থেকে বাঁচতে চাইলে প্রথম স্বীয় বিবেককে যথার্থরূপে সুষ্ঠু ও সঠিক করতে হবে। কারণ, মানুষের বিবেকই মানবদেহরূপী কারখানার জন্য চালকযন্ত্রস্বরূপ। মানবের কর্তব্য, তার বিবেক-বুদ্ধিকে সুষ্ঠু করে তারপর সেই সুষ্ঠু জ্ঞান-বিবেক দ্বারা স্বীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পরিচালিত করা। আলোচ্য হাদিসটিকে হাদিসে এছলাহে কলব বা আধ্যাত্মিক শুদ্ধি লাভের হাদিস বলা হয়। নবী করিম (সা.)-এর হাদিসসমূহের মধ্যে এ হাদিসটিকে সব শরিয়ত ও তরিকত-তাছাওউফের মূল উৎস বলা যেতে পারে। এই হাদিসটির এই তথ্যটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মানুষের সৃষ্টিতত্ত্ব ও দেহতত্ত্বের ইঙ্গিতদানে মানবের প্রকৃত উন্নতির উপায় উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং সতর্ক করা হয়েছে যে স্থূল দেহের উন্নতি অপেক্ষা সূক্ষ্ম আত্মার ও বিবেকের উন্নতির ওপরই মানুষের প্রকৃত ও মূল উন্নতি নির্ভর করে। আত্মা বা বিবেকের উন্নতি সাধিত না হলে মানবজীবন বিফল ও অত্যন্ত বিড়ম্বনায় পতিত হয়। এই হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) মানবদেহের যে বিশিষ্ট অংশটির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন, তা হচ্ছে আকল বা বিবেক। এর উন্নতিতে পূর্ণ মানবদেহের উন্নতি এবং এর অবনতিতে সম্পূর্ণ মানবদেহের অবনতি ঘটে থাকে। অর্থাৎ, বিবেক রত্নটির উন্নতি সাধিত হলে সমগ্র মানবদেহের উন্নতি হবে এবং এর অবনতিতে সমগ্র মানবদেহেরই অবনতি ঘটবে।
এখন দেখতে হবে যে ওই অংশটির উন্নতির অর্থ কী? বস্তুত, প্রতিটি জিনিসের উন্নতি বা অবনতি বিচার করা হয় তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের সুষ্ঠুতা দিয়ে। তাই এখানে দেখতে হবে যে বিবেকের ওপর কী কী দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়েছে। বিবেকের কর্তব্য হলো সদাচার, সততা, সত্যতা, আল্লাহর বশবর্তিতা ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট করা এবং সঙ্গে সঙ্গে নফসের মধ্যে যে অপশক্তি আছে, সেগুলোকে বশে এনে ফেরেশতার সদ্গুণাবলিতে পরিচালিত করা। অতএব, বিবেকের দায়িত্ব ও কর্তব্যও তা-ই হবে। এই মহান কর্তব্য পালনে বিবেক যতটুকু উন্নতি করতে পারবে, পূর্ণ মানবদেহটি ততটুকুই উন্নতি লাভ করবে। পক্ষান্তরে বিবেক নিজের ওই কর্তব্যে ত্রুটি করে নিজেই যদি প্রবৃত্তির বশ্যতা স্বীকার করার অবনতিতে পতিত হয়, তাহলে পূর্ণ মানবদেহই অবনতির তিমির গর্তে পতিত হবে।
আধ্যাত্মিক জ্ঞানবিশারদেরা বিবেকের উন্নতির পাঁচটি স্তর বর্ণনা করেছেন: (১) আল্লাহকে স্মরণ করা, আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে জিকির করা, (২) আল্লাহর মহৎ গুণাবলির ধ্যান করা এবং ওই ধ্যানের দ্বারা নিজের মধ্যে ওই গুণের প্রতিবিম্ব হাসিল করা, (৩) আল্লাহর গুণাবলির তত্ত্বজ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত করা, (৪) আল্লাহর গুণে মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে আল্লাহর আশেক ও প্রেমিকে পরিণত হওয়া এবং নিজের নফসের সব কুপ্রবৃত্তির প্রতি ঘৃণা জন্মানো এবং সেগুলো ফানা ও বিলুপ্ত করে দেওয়া। অর্থাৎ, সেগুলোকে পূর্ণরূপে দখল ও অধিকার করার সামর্থ্য অর্জন করা, (৫) আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হওয়া, যাকে আল্লাহর খেলাফত লাভ বলে। এই অবস্থাতেই বিবেক ও আকলের পূর্ণ শুদ্ধি হয়ে যায়। এই অবস্থার পরে আর বিবেক ও আকলকে কুপ্রবৃত্তির বশীভূত হতে হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) মানবের স্বীয় আকল ও বিবেককে সঠিক করার যে প্রেরণা দান করেছেন, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবতার চরম ও পরম উন্নতির উচ্চ পর্যায়।’ (শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৭১-৭৪, হাদিস: ৪৭, হামিদিয়া লাইব্রেরি, ত্রয়োদশ সংস্করণ।)
আত্মিক উন্নতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, দুর্নীতি দমন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, সন্ত্রাস দমন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা ইত্যাদি। সদ্গুণাবলি, সুচিন্তা ও সৎকর্ম ছাড়া মুমিন মুসলমান হওয়া তো দূরের কথা, একজন মানুষ হওয়াও সম্ভব নয়।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail. com