পুণ্যময় হজ একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিময় ইবাদত। আদি পিতা প্রথম মানব ও প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত বহু নবী-রাসুলদের স্মৃতিপূর্ণ এই হজ। হজের প্রতিটি আনুষ্ঠানিকতায় সে স্মৃতি স্মরণ হলে হজের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুধাবন সম্ভবপর হবে এবং পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি অর্জন করা সহজতর হবে। আল্লাহ তাআলার বাণী: ‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর, যা মানুষের জন্য স্থাপিত হয়েছে, সেটাই হচ্ছে এ ঘর, যা বাক্কায় (মক্কায়) অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য হিদায়াত ও বরকতময়। এতে রয়েছে মাকামে ইব্রাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে ব্যক্তি এর ভেতরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে। আর এ ঘরের হজ করা হলো মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার। আর যে লোক কুফরি করে (তা মানে না), আল্লাহ সারা বিশ্বের কোনো মুখাপেক্ষী নন।’ (আল কোরআন, সুরা-৩ [৮৯] আলে ইমরান (মাদানি), রুকু: ১০/১, আয়াত: ৯৬-৯৭।
মক্কা মোকাররমা অর্থ সম্মানিত মক্কা। মক্কার প্রাচীন নাম হলো বাক্কা। হজের কর্মসীমানাকে হারাম শরিফ বলে। হারাম মানে নিষিদ্ধ ও সম্মানিত। যেহেতু এই সীমানার মধ্যে বিশেষ কিছু বিষয় নিষিদ্ধ এবং এই জায়গা বিশেষ সম্মানিত, তাই একে হারাম শরিফ বলা হয়। হারামাইন অর্থ দুটি হারাম বা দুটি সম্মানিত স্থান। মক্কা শরিফ ও মদিনা শরিফকে একত্রে হারামাইন শরিফাইন বলা হয়। পবিত্র মক্কা শরিফ ও মদিনা শরিফে অমুসলিমদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
পবিত্র মক্কার হারাম শরিফের সীমানা হলো বায়তুল্লাহ শরিফের পশ্চিমে জেদ্দার পথে শুআইদিয়া পর্যন্ত ১০ মাইল, পূর্বে জেরুজালেমের পথে ৯ মাইল, দক্ষিণে তায়েফের পথে ৭ মাইল, উত্তরে মদিনা শরিফের পথে ৫ মাইল। এখানে জীবজন্তু শিকার করা নিষিদ্ধ। এমনকি গাছপালা, তৃণলতা ইত্যাদি ছেঁড়াও নিষেধ। হারাম শরিফের প্রাণকেন্দ্র হলো মসজিদুল হারাম, এর কেন্দ্রস্থলে খানায়ে কাবা শরিফ বা পবিত্র কাবাঘর অবস্থিত। এ কালো বর্ণের চতুষ্কোণ ঘরটিই হলো বায়তুল্লাহ শরিফ বা মহান আল্লাহর সম্মানিত ঘর। হজরত আদম (আ.)-এর সময়কালেই কাবাগৃহের সৃষ্টি। হজরত নূহ নবী (আ.)-এর সময় সংঘটিত মহাপ্লাবনের পর নবী ও রাসুল হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তদীয় পুত্র নবী ও রাসুল হজরত ইসমাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে এর পুনরায় সংস্কার করেন। বর্তমান কাবাঘরের আয়তন হলো: পশ্চিম পাশ ২২ হাত, পূর্ব পাশ ১৮.৫ হাত, দক্ষিণ পাশ ১৮ হাত, উত্তর পাশ ১২ হাত এবং উচ্চতা ২৭ ফুট।
কাবা শরিফের পূর্ব-উত্তর পাশে সোনালি বেষ্টনীতে কাচঘেরা পায়ের ছাপযুক্ত যে প্রস্তরখণ্ডটি সংরক্ষিত রয়েছে, তা হলো মাকামে ইব্রাহিম। মাকাম অর্থ স্থান বা দাঁড়ানোর জায়গা। এ পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘরের প্রাচীর গাঁথতেন।
হজরত উমর (রাহ.) প্রথম এখানে নামাজ পড়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। সকল প্রকার তাওয়াফের পর এই পবিত্র স্থানের কাছে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। এই নামাজ ওয়াজিব। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘যখন আমি কাবাগৃহকে মানুষের জন্য সম্মিলনস্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর তোমরা ইব্রাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে মুছল্লা (নামাজের জায়গা) বানাও এবং আমি ইব্রাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো। যখন ইব্রাহিম বললেন, পরওয়ারদিগার! এ স্থানকে আপনি শান্তিধাম করুন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও কিয়ামতে বিশ্বাস করে, তাদের ফলের দ্বারা রিজিক দান করুন। বললেন, যারা অবিশ্বাস করে, আমি তাদেরও কিছুদিন ফায়দা ভোগ করার সুযোগ দেব, অতঃপর তাদেরকে দোজখের আজাবে ঠেলে দেব; সেটা নিকৃষ্ট বাসস্থান। স্মরণ করো, যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল কাবাগৃহের ভিত্তি স্থাপন করছিল। তারা দোয়া করেছিল, পরওয়ারদিগার! আমাদের থেকে (এই নির্মাণকর্ম) কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি শ্রবণকারী, সর্বজ্ঞ। পরওয়ারদিগার! আমাদের উভয়কে আপনার আজ্ঞাবহ করুন এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করুন, আমাদের হজের রীতিনীতি দেখিয়ে (শিখিয়ে) দিন এবং আমাদের ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি তওবা কবুলকারী, দয়ালু। হে পরওয়ারদিগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের কাছে একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদের কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেবেন। এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনিই পরাক্রমশালী হেকমতওয়ালা। ইব্রাহিমের ধর্ম থেকে কে মুখ ফেরায়? কিন্তু সে ব্যক্তি (ছাড়া), যে নিজেকে বোকা প্রতিপন্ন করে। নিশ্চয়ই আমি তাকে পৃথিবীতে মনোনীত করেছি এবং সে পরকালে সত্কর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত। স্মরণ করো, যখন তাঁকে তাঁর পালনকর্তা বললেন, অনুগত হও। তিনি বললেন, আমি বিশ্বপালকের অনুগত হলাম। এরই ওছিয়ত করেছেন ইব্রাহিম তাঁর সন্তানদের এবং ইয়াকুবও, হে আমার সন্তানগণ, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এ ধর্মকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলমান না হয়ে কখনো মৃত্যুবরণ কোরো না। তোমরা কি উপস্থিত ছিলে, যখন ইয়াকুবের মৃত্যু নিকটবর্তী হয়? যখন তিনি সন্তানদের বললেন, আমার পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা বলল, আমরা আপনার পিতৃপুরুষ ইব্রাহিম, ইসমাইল ও ইসহাকের মাবুদের ইবাদত করব। তিনি একক উপাস্য। আমরা সবাই তাঁর আজ্ঞাবহ। তারা ছিল এক সম্প্রদায়, যারা গত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদেরই জন্য। তারা কী করত, সে সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে না। (আল কোরআন, সুরা-২ [৮৭] আল বাকারা (মাদানি)
কাবা শরিফের উত্তর পাশের অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা স্থানকে ‘হাতিম’ বলা হয়। এই স্থানটুকু আগে কাবাঘরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে নামাজ পড়া মানে কাবাঘরের ভেতরে নামাজ পড়া। হাজরে আসওয়াদ মানে কালো পাথর, এটি একটি বেহেশতি পাথর। হজরত আদম (আ.)-এর সময় এটি আনা হয়। এই পবিত্র পাথরের দৈর্ঘ্য ৮ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৭ ইঞ্চি। এই পবিত্র প্রস্তরখণ্ডকে নবী করিম (সা.) অত্যন্ত বিনয় ও মহব্বতের সঙ্গে চুম্বন করতেন। হাজরে আসওয়াদ ও কাবাঘরের দরজার মধ্যবর্তী স্থানটুকু মুলতাজিম নামে পরিচিত।
কাবা শরিফ তাওয়াফ করতে অজু বা পবিত্রতা পূর্বশর্ত, যেমন নামাজ আদায় করতে ও কোরআন শরিফ স্পর্শ করতে পবিত্রতা পূর্বশর্ত। কাবা শরিফ দেখলেও সওয়াব হয়, যেমন মাতা-পিতার চেহারা দর্শনে ও কোরআন শরিফ দর্শনে সওয়াব হয়।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।