ওহুদের যুদ্ধের শিক্ষা

নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বছর ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে রবিউল আউওয়াল মাসে আল্লাহর নির্দেশে মহানবী হিজরত করে প্রিয় জন্মভূমি মক্কা শরিফ ছেড়ে মদিনা শরিফে চলে যান। মদিনার নিরীহ শান্তিকামী মানুষ এতে খুশি হন। খাজরাজ বংশের পৌত্তলিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুলের জন্য নবনির্মিত স্বর্ণের মুকুট নবীজির পদপ্রান্তে উৎসর্গ করেন তাঁরা। মানবতার দরদি গরিবের বন্ধু নবীজি (সা.) সেই মুকুট মস্তকে ধারণ না করে, তা বিক্রি করে দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দেন। মুকুট হারানোর বেদনায় প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে মুনাফিক নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই। বছর যেতে না-যেতেই তারই প্ররোচনায় মুনাফিক চক্রের ষড়যন্ত্রে এবং মদিনার মৈত্রী চুক্তি ভঙ্গকারী ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের গোপন আঁতাতে মক্কার কুরাইশ পৌত্তলিকেরা হিজরতের দ্বিতীয় বছর ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘আশহুরে হুররুম’ বা যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাস চতুষ্ঠয়ের অন্যতম রমজানেই মদিনা আক্রমণ করে বসে।

ইসলাম শান্তি, সম্প্রীতি, মৈত্রী, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য; ইসলাম মানবতার জন্য। ইসলাম সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পক্ষে। মহানবী মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আগমনের পর মদিনায় স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিতীয় হিজরিতে কুরাইশরা মদিনা আক্রমণ করলে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে তারা চরমভাবে পরাজিত হলেও যুদ্ধবাজ রক্তপিপাসু কুরাইশরা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে এসে পুনরায় মদিনা আক্রমণ করে।

ওহুদ মদিনা থেকে তিন মাইল উত্তরে একটি পাহাড়ের নাম। ওহুদ উপত্যকা প্রান্তর একটি স্থান। ওহুদ একটি অবিস্মরণীয় ইতিহাস। পঞ্চম হিজরি সন তথা হিজরতের পঞ্চম বছরের শাওয়াল মাসের ১৫ তারিখ শনিবার পূর্বাহ্নে ঐতিহাসিক ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দ্বিতীয় হিজরি সনে বদরের বিজয়ের ১৩ দিন পর ১ শাওয়াল প্রথম ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপন করা হয়। এ বছরই মদিনার সুদখোর মহাজন ইহুদি বনু কাইনুকা সম্প্রদায়কে পরাস্ত করার পর ১০ জিলহজ ঈদুল আজহা পালন করা হয়। পঞ্চম হিজরির রমজান মাস শেষে মক্কার কুরাইশরা পুনরায় প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে এসে মদিনা আক্রমণে অভিযান শুরু করে। তাদের ছিল ৩ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী, ৭০০ বর্মধারী, ২০০ অশ্বারোহী, অবশিষ্ট উষ্ট্রারোহী ও রসদবাহী সেনাদল। সঙ্গে তায়েফের আরও ১০০ যোদ্ধা এবং ৫০ হাজার স্বর্ণমুদ্রার অস্ত্রশস্ত্র ও রণসম্ভার। ঈদুল ফিতরের ১৩ দিন পর তারা মদিনার উপকণ্ঠে ওহুদ পাহাড়ের অপর প্রান্তে অবস্থান নেয়। এই সংবাদ শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’

১৪ শাওয়াল শুক্রবার জুমার নামাজের পর প্রিয় নবী (সা.) সাহাবাগণের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নগরের বাইরে এসে আক্রমণ প্রতিহত করে নগর রক্ষার সিদ্ধান্ত নেন। আসরের নামাজের পর মুসলিমগণ মসজিদ প্রাঙ্গণে সমবেত হন। সাহাবির সংখ্যা মাত্র ১ হাজার। তার মধ্যে মাত্র দুজন অশ্বারোহী, ৭০ জন বর্মধারী, ৪০ জন তিরন্দাজ, বাকি সবাই পদাতিক। তঁাদের কারও হাতে বর্শা, কারও হাতে ঢাল-
তলোয়ার। পথিমধ্যে মুনাফিকপ্রধান বনু খাজরাজ গোত্রীয় আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নগর অভ্যন্তরে থেকে প্রতিরক্ষার নামে ৩০০ সৈন্য নিয়ে কেটে পড়ে। অবশিষ্ট রইলেন মাত্র ৭০০ মুসলিম মুজাহিদ।

পথে কিছু উত্সাহী তরুণ এই দলে যুক্ত হতে চাইলে নবীজি অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। তাদের নিবৃত্ত করার জন্য উচ্চতা মাপার নির্দেশ দেন। তখন ‘রাফে’ নামক এক তরুণ পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর উচ্চতা বেশি দেখালে এবং সাহাবাগণ তাঁর ভালো তিরন্দাজির কথা বলে সুপারিশ করলে নবীজি তাঁকে নিতে সম্মত হন। তখন ‘সামারা’ নামক এক তরুণ যুদ্ধে যাওয়ার জন্য রাফেকে কুস্তিতে হারানোর চ্যালেঞ্জ করলে তাতে নবীজি সায় দেন। রাফে ইচ্ছাকৃতভাবে হারলেন, সামারা দলের অন্তর্ভুক্ত হলেন। পথে শাঈখাঈন নামক স্থানে রাত যাপন করলেন। ফজরে হজরত বেলালের আজানে সবাই একত্রে নামাজ আদায় করলেন।

১৫ শাওয়াল শনিবার প্রাতঃকালে মুসলিম কাফেলা মদিনা থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে এসে উপনীত হয়। রাসুলে আকরাম (সা.) স্বয়ং এই প্রতিরক্ষা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম শিবিরের বাঁ পাশে পাহাড়ে একটি সুড়ঙ্গপথ ছিল। নবীজি (সা.) ৫০ জনের একদল তিরন্দাজকে এই গিরিপথের পাহারায় নিযুক্ত করেন এবং বলেন, আমাদের জয়-পরাজয় যা-ই হোক, তোমরা এই স্থান পরিত্যাগ করবে না। এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর তিনটি পতাকা ছিল। প্রধান পতাকাবাহী ছিলেন হজরত মুসআব ইবনে উমায়ের এবং অপর দুটি আউস ও খাজরাজ বংশের দুই দলপতির হাতে।

মল্লযুদ্ধের শুরুতে কুরাইশদের তলহা আক্রমণে এলে হজরত আলী তাকে বধ করলেন। তলহার ভাই ওসমান আক্রমণ করলে হজরত হামজা তাকে সংহার করলেন। কুরাইশরা তাদের বীরদের পরাজয়ে বিচলিত হয়ে সংঘবদ্ধ আক্রমণ করল। হামজা, আলী, আবু দুজানা, জিয়াদ, জুবায়ের প্রমুখ সাহাবি বীর বিক্রমে যুদ্ধ করলেন। কুরাইশ অশ্বারোহী বাহিনী দুই-দুবার গিরিপথে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। ওহুদে যেন বদরের পুনরাবৃত্তি ঘটল। কুরাইশরা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে লাগল। এ সময় মুসলিমগণ গনিমত সংগ্রহে প্রবৃত্ত হলো। গিরিরক্ষী তিরন্দাজদের ১২ জন বাদে বাকি ৩৮ জন যুদ্ধ শেষ মনে করে স্থান ত্যাগ করে সম্পদ সঞ্চয়ে মত্ত হলো। এই সুবাদে কুরাইশ বাহিনী গিরি অতিক্রম করে মুসলমানদের পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দিল। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতিতে মুসলমানগণ দিগ্বিদিক ছুটতে লাগল। মুসআব ইবনে উমায়ের ও নবীজির চাচা হামজা শহীদ হলেন। নবীজির নির্দেশ উপেক্ষাকারীদের ভুলের মাশুল দিতে হলো।

বর্বর কুরাইশ যোদ্ধারা নবীজির ওপর সর্বাত্মক আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নির্মম নির্দয় হামলায় তাঁর জীবন বিপন্নপ্রায়। সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের জীবন বাজি রেখে, নিজেদের বুককে ঢাল বানিয়ে নবীজিকে রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকলেন। হামজার হত্যাকারী ইবনে কামিয়া নবীজিকে তরবারি দ্বারা কঠিন আঘাত করল। তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ হাত দিয়ে ঠেকালে তাঁর আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে গেল, নবীজির শিরস্ত্রাণ বিদীর্ণ হয়ে দুটি লৌহ কড়া তাঁর কপালে বিঁধে গেল, নবীজি অচেতন হয়ে পড়ে গেলেন। কুরাইশরা ‘মুহাম্মাদ নিহত!’ বলে উল্লাস করতে লাগল। শহীদ মুসআবের চেহারার সঙ্গে নবীজির মিল থাকায় এই গুজব ডাল-পালা মেলল। জ্ঞান ফিরে এলে নবীজি বললেন, ‘হে আমার প্রভু! আমার জাতিকে ক্ষমা করো; তারা অজ্ঞ, তারা বোঝে না।’

যুদ্ধ বিপর্যয়ের দুঃসংবাদে মদিনার রমণীগণও আহত ব্যক্তিদের সেবা-শুশ্রূষায় যোগ দেন। তাঁদের মধ্যে উম্মে আইমান, নবীনন্দিনী ফাতেমা ও বনু দিনার গোত্রের বিশিষ্ট নারীগণ এবং অন্য নারীরাও ছিলেন। এই  আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবি শাহাদাতবরণ করেন। তাঁদের সমাধি বদর প্রান্তরেই অবস্থিত। কুরাইশদের নিহত হলো ৩৫০ জনেরও অধিক। শুধু আবু সুফিয়ান, জুবায়ের ইবনে মুতএম ও হাকেম ইবনে হিজাম ছাড়া কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় প্রায় সবাই নিহত হলো। তাঁরা তিনজনই পরে মুসলমান হয়েছিলেন।

মুসলমানগণ কৌশলগত কারণে পাহাড়ে আশ্রয় নিলেন। কুরাইশ নেতারা আবার বদরে দেখা হবে বলে ফিরে গেল। সন্ধ্যার আগেই নবীজি সবাইকে নিয়ে মদিনায় পৌঁছালেন। ইতিমধ্যে তিনি সাআদকে কুরাইশদের গতিবিধি লক্ষ করার জন্য পাঠালেন। কুরাইশরা ‘আল আকিক’ উপত্যকায় পৌঁছার পর পুনরায় মদিনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সংবাদে নবীজি রাতে বিশিষ্ট সাহাবাগণের সঙ্গে পরামর্শ করে পরদিন ১৬ শাওয়াল রোববার ফজরের নামাজান্তে ঘোষণা করলেন: ‘কুরাইশদের পুনরাক্রমণ প্রতিহত করতে শুধু ওহুদে অংশগ্রহণকারী সাহাবিরা প্রস্তুত হও।’ তাঁরা নতুন অভিযানে চললেন। এদিকে কুরাইশরা ‘মাবাদ’ নামক এক মদিনাবাসী মারফত মুসলমানদের পাল্টা অভিযাত্রার খবর জানতে পেরে পিছু হটে মক্কা অভিমুখে পালিয়ে গেল। সাহাবাদের কাফেলা নিয়ে নবীজি মদিনা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ‘হামরাউল আসাদ’ নামক স্থানে এসে উপস্থিত হলেন। কয়েক দিন সেখানে অবস্থান করে মদিনায় ফিরে এলেন। (বিশ্বনবী, গোলাম মুস্তফা, পৃষ্ঠা: ১৬৯-১৮৯; সিরাতে ইবনে হিসাব ও ইবনে ইসহাক; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসির)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্‌ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।