কন্যাশিশুর প্রতি ভালোবাসা

ধর্ম
ধর্ম

পুত্রসন্তানের মতো কন্যাশিশুরাও পৃথিবীতে নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকারের সমান দাবিদার। ইসলাম মানুষকে এই সুশিক্ষা দিয়েছে যে কন্যাশিশু লালন-পালন করা, তাদের উত্তম শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়া এবং ঘরসংসারের সব কাজকর্মে পারদর্শী করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা অনেক বড় নেকির কাজ। কন্যাশিশুর প্রতিপালন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা আমূল পরিবর্তন করে দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এই কন্যাশিশু জন্মের মাধ্যমে যে ব্যক্তিকে পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়, তারপর সে তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে, তারা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার কারণে পরিণত হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
নবজাত সন্তানকে চোখ জুড়ানো সম্পদ বিবেচনা করে পুত্র বা কন্যা হোক আচরণের ক্ষেত্রে দুয়ের মধ্যে কোনো রকম পার্থক্য করা ইসলাম সমর্থন করে না। কিন্তু বর্তমানে পারিবারিক জীবনে পুত্রসন্তানের প্রতি যে অধিক যত্ন নেওয়া হয়, কন্যাশিশুর প্রতি তা করা হয় না। দরিদ্র পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়লে কন্যার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে পুত্রের লেখাপড়া কষ্টে চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। অথচ কিশোরীকন্যাটিও যে পরিবারে পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে সাহায্য করে, তার হিসাব কেউ রাখে না। মেয়েরা মেধাবী ও সৃষ্টিশীল নয়, এমন অজুহাতে অনেক সময়ই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পরিবার কন্যাদের প্রাপ্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। কন্যাশিশুকে পুত্রসন্তানের মতো আদর-যত্ন ও ভালোবাসা দিয়ে লালন-পালনের প্রতি সব মা-বাবারই আরও সচেষ্ট ও সচেতন হতে হবে, তা না হলে এর প্রভাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর পড়বে। কন্যাশিশুর প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা, মানবাধিকার রক্ষা না করার সমান অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাই কন্যাশিশুর প্রতি কোনো রকম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বা শৈথিল্য প্রদর্শন, পুত্র ও কন্যার মধ্যে পার্থক্য বিধান এবং মেয়েদের ওপর ছেলেদের অহেতুক প্রাধান্য দিতে কঠোরভাবে নিষেধ করে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘যার তত্ত্বাবধানে কোনো কন্যাশিশু থাকে আর সে তাকে জীবিত দাফন না করে, মেয়েকে তুচ্ছ না করে এবং ছেলেকে অগ্রগণ্য না করে, আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন।’ (আবু দাউদ)
কন্যাশিশু ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য বেহেশতের শুভবার্তা বয়ে আনে এবং সংসার-জীবনকে স্নিগ্ধ মায়া-মমতায় ভরে রাখে। তাই কন্যাশিশুরা ঘরের প্রাণময় সৌন্দর্য; অথচ সমাজে অনেকে কন্যাশিশু জন্ম নিলে খুবই বিব্রতবোধ করেন। একাধিক কন্যাসন্তান হলে অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন। মানবসম্পদ টিকিয়ে রাখার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যে সন্তানসম্ভবা নারী করে থাকে, তার জীবনপ্রক্রিয়া হয়ে পড়ে কণ্টকাকীর্ণ। কেউ কেউ কন্যাশিশু জন্ম দেওয়ার অপরাধে স্ত্রীকে অমানুষিক নির্যাতন করে থাকে। এমনকি তালাক দেওয়ার মতো জঘন্য পাপের পথেও পা বাড়ায়। নানাভাবে কন্যাশিশু জন্মদাত্রীকে নিগৃহীত করা হয়। সমাজে যারা কন্যাশিশুর জন্মে বিব্রতবোধ করে অথবা স্ত্রীকে নির্যাতন ও নিগৃহীত করে, তারা কি প্রাক-ইসলামি যুগের উত্তরাধিকার বহন করছে না? আইয়্যামে জাহেলিয়াতের মানুষের হীন ও জঘন্য মনোবৃত্তির কথা আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়, তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়, তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় থেকে আত্মগোপন করে। সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে! সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত করে তা কতই না নিকৃষ্ট!’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৫৮-৫৯)
যখন কন্যাশিশু জন্ম নেওয়াকে অপমানজনক মনে করে মেয়েকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) কন্যাশিশুর প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন তথা নারী জাতির জীবন ও নিরাপত্তার অধিকার, মান-সম্মান ও মর্যাদার কথা বললেন। তিনি কন্যাশিশুকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ঘোষণা করলেন এবং তার সঙ্গে যাবতীয় বৈষম্যমূলক অশোভনীয় আচরণ থেকে বিরত থাকার জোরালো নির্দেশ দিয়ে সুসংবাদ প্রদান করলেন, ‘তোমাদের সন্তানদের মধ্যে কন্যাই উত্তম।’ (মুসলিম) জাহেলি যুগে আরবের সেই হৃদয়হীন সমাজে মহানবী (সা.) কন্যাশিশুর নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নারীদের প্রাপ্য মর্যাদার যে উচ্চাসনে সমাসীন করেছিলেন, তা জগতের ইতিহাসে দারুণ বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।
কন্যাশিশুর নিরাপত্তা ও সমাজব্যবস্থার মানসিকতা কন্যাদায়গ্রস্ত অভিভাবককে ভাবায়। পড়ালেখা শিখিয়ে কন্যাকে যৌতুকের বিনিময়ে কারও হাতে সম্প্রদান করতে হবে—এমন দুশ্চিন্তায়ও দরিদ্র লোকেরা নিমগ্ন থাকে। অথচ একটি কন্যাসন্তানকে যখন উচ্চশিক্ষায় সুশিক্ষিত করা যায় এবং উপার্জনক্ষম হয়ে ওঠে তখন তারা একটি ছেলের মতোই পিতামাতার বিপদে পাশে এসে দাঁড়াতে পারে। তাই কন্যাশিশুর প্রতি ভালোবাসা ও লালন-পালনের অতুলনীয় মর্যাদার কথা রাসুলুল্লাহ (সা.) মানুষকে উদাত্তকণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন। পিতার অন্তরে কন্যাশিশুর প্রতি গভীর মমত্ববোধ জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে নবী করিম (সা.) উপদেশবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুটি বা তিনটি কন্যাশিশুকে বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করবে, উপযুক্ত শিক্ষাদান করবে ও সৎপাত্রস্থ করবে; কিয়ামতের দিন আমি ও সে এই রকম কাছাকাছি থাকব বলে তিনি তাঁর আঙুলগুলো মিলিয়ে দেখালেন।’ (মুসলিম)
কন্যাশিশুকে প্রাপ্য অধিকার, সুযোগ-সুবিধা দেওয়া পরিবার ও সমাজের দায়িত্ব। লিঙ্গভেদে কোনো বৈষম্য বা বঞ্চনা কারও কাম্য নয়। অজ্ঞতা, সচেতনতার অভাব, কুসংস্কার, ভুল ধারণা, শিক্ষার অপ্রতুলতা, দারিদ্র্য, সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে কন্যাশিশুরা প্রতিনিয়ত বঞ্চনা, নিপীড়ন ও অসহায়ত্বের শিকার হচ্ছে। ফলে উল্লে­খযোগ্যসংখ্যক কিশোরীকন্যা অকাল মৃত্যুর শিকার হচ্ছে। তাই প্রতিটি কন্যাশিশুর খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধান, তার চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করা, শিক্ষার অধিকার রক্ষা করা, শারীরিক-মানসিক বিকাশে পূর্ণ সহায়তা দেওয়া রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। এ ছাড়া ছেলেমেয়ে-নির্বিশেষে সব শিশুর মৌলিক, মানবিক প্রয়োজন পূরণ সাংবিধানিক অঙ্গীকারও বটে। অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-দল-মতনির্বিশেষে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকে যার যার অবস্থান থেকে ইসলাম প্রদত্ত কন্যাশিশুর অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কার্যকর ভূমিকা রাখা দরকার।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]