
‘দয়াময় আল্লাহ, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে (বয়ান)।’ (সুরা-৫৫ আর রহমান, আয়াত: ১-৪, পারা: ২৭)। ভাব প্রকাশের মাধ্যম হলো ভাষা। ভাষার অলংকৃত রূপ হলো সাহিত্য। সাহিত্যের বিশেষায়িত পর্ব হলো কবিতা বা ‘শেয়ের’। যিনি কাব্য করেন, তিনি হলেন ‘শায়ের’। ‘শেয়ের’ বা কবিতা শব্দটি কোরআনে রয়েছে একবার (৩৬: ৬৯), ‘শায়ের’ বা কবি শব্দটি রয়েছে চারবার (২১: ৫, ২৭: ৩৬, ৫২: ৩০, ৬৯: ৪১); এবং ‘শুআরা’ বা কবিমণ্ডলী শব্দটি আছে একবার (২৬: ২২৪)।
কাব্য বা কবিতাকে আরবিতে বলা হয় ‘শেয়ের’, এর বহুবচন হলো ‘আশআর’; আমরা সাধারণত বলি, ‘শেয়ের আশআর’ মানে ‘কবিতাটবিতা’। ‘শায়েরি’ মানে কবিগিরি; ‘শায়েরানা’ মানে কবিয়ানা। ‘বয়াত’ বা বয়েত শব্দটি মূল ‘বায়ত’ বা ‘বাইত’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো দ্বিপদী কবিতা বা ছন্দ; এর বহুবচন হলো ‘আবয়াত’। যিনি ‘বয়াত’ রচনা করেন বা পাঠ ও উপস্থাপন করেন, তাঁকে ‘বয়াতি’ বলা হয়। ‘নজম’ অর্থ পদ্য, ‘মানজুম’ হলো এর কর্মরূপ, মানে হলো পদ্যকৃত; এর বিপরীত হলো ‘নছর’, মানে হলো গদ্য, যার কর্মরূপ হলো ‘মানসুর’, এর অর্থ হলো গদ্যকৃত। ‘নসরে মুসাজ্জা’ হলো ছন্দোবদ্ধ গদ্য। ‘কিতআ’ হলো কবিতাংশ। ‘মিসরা’ অর্থ কবিতার পদ বা চরণ ও পঙ্ক্তি বা লাইন। ‘ক্বাসিদা’ ও ‘গজল’ কবিতারই বিশেষ রূপ। ‘দিওয়ান’ হলো কাব্যগ্রন্থ। যেমন: দিওয়ানে মুঈনুদ্দীন, দিওয়ানে মুতানাব্বি, দিওয়ানে আলি, দিওয়ানে হামাসা, দিওয়ানে হাফিজ ইত্যাদি।
>কোরআন মহান আল্লাহ তাআলার কালাম বা বাণী। এতে কাব্য ভাব ও সাহিত্যমান রয়েছে অতুলনীয়ভাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি কসম করছি তার, যা তোমরা দেখতে পাও এবং যা তোমরা দেখতে পাও না। নিশ্চয়ই এই কোরআন এক সম্মানিত রাসুলের বাহিত বার্তা
কোরআন মহান আল্লাহ তাআলার কালাম বা বাণী। এতে কাব্য ভাব ও সাহিত্যমান রয়েছে অতুলনীয়ভাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি কসম করছি তার, যা তোমরা দেখতে পাও এবং যা তোমরা দেখতে পাও না। নিশ্চয়ই এই কোরআন এক সম্মানিত রাসুলের বাহিত বার্তা। ইহা কোনো কবির রচনা নয়; তোমরা অল্পই বিশ্বাস করো, ইহা কোনো গণকের কথাও নয়, তোমরা অল্পই অনুধাবন করো। ইহা জগতের প্রতিপালকের কাছ থেকে অবতীর্ণ। সে যদি আমার নামে কোনো কথা রচনা করে চালাতে চেষ্টা করত, আমি অবশ্যই তার দক্ষিণহস্ত ধরে ফেলতাম এবং কেটে দিতাম তার জীবনধমনি, অতঃপর তোমাদের মধ্যে এমন কেহই নাই, যে তাকে রক্ষা করতে পারে। এই কোরআন মুত্তাকিদের জন্য অবশ্যই উপদেশ।’ (সুরা-৬৯ হাক্কাহ, আয়াত: ৩৮-৪৮, পারা: ২৯)।
তারা এটাও বলে, ‘এই সমস্ত অলীক কল্পনা, হয় সে উহা উদ্ভাবন করেছে, না হয় সে একজন কবি।’ (সুরা-২১ আম্বিয়া, আয়াত: ৫, পারা: ১৭)। ‘তাদের আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই বলা হলে তারা অহংকার করত এবং বলত, “আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের ইলাহগণকে বর্জন করব?”’ (সুরা-৩৭ সফফাত, আয়াত: ৩৫-৩৬, পারা: ২৩)। ‘অতএব আপনি উপদেশ দান করতে থাকুন, আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহে আপনি গণকও নন, উন্মাদও নন। তারা কি বলতে চায় “তিনি একজন কবি?” তারা কি বলে, “এই কোরআন তাঁর নিজের রচনা?” বরং তারা অবিশ্বাসী। উহারা যদি সত্যবাদী হয়, তবে ইহার সদৃশ কোনো রচনা (বাণী) উপস্থিত করুক না।”’ (সুরা-৫২ তুর, আয়াত: ২৯-৩৪, পারা: ২৭)।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কবি ছিলেন না। আল্লাহ তাআলা কোরআন করিমে বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কাব্য রচনা করতে শেখাইনি এবং এটি তাঁর পক্ষে শোভনীয় নয়; এ তো এক উপদেশ এবং সুস্পষ্ট কোরআন। (সুরা-৩৬ ইয়াসিন, আয়াত: ৬৯, পারা: ২৩)। সেকালে সাধারণ অশোভন কাব্য রচনা করা হতো এবং উদ্ভ্রান্ত কবিরা তাদের কবিতায় কল্পনাপ্রসূত ভাব, অরুচিকর ভাষা, মিথ্যা তথ্য, হেঁয়ালি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করত। তাই আল্লাহপাক কোরআন শরিফে এ বিষয়ে একটি সুরাও নাজিল করেন, যে সুরার নাম হলো ‘শুআরা’, অর্থাৎ কবিরা। এখানে কবিরা বলতে বিপথগামী কবিদের বোঝানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের কি আমি জানাব কার কাছে শয়তান অবতীর্ণ হয়? তারা তো অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী ও পাপীর কাছে। তারা কান পেতে থাকে এবং তাদের অধিকাংশই মিথ্যাবাদী। এবং এ কবিদের অনুসরণ করে বিভ্রান্তরাই। আপনি কি দেখেন না তারা বিভ্রান্ত হয়ে প্রতিটি উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়। এবং তারা তো বলে যা তারা করে না। কিন্তু তারা ব্যতীত যারা বিশ্বাস করে ও সৎ কাজ করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে ও (কাব্য দ্বারা) অত্যাচারিত হওয়ার পর (কবিতার মাধ্যমে প্রত্যুত্তর দ্বারা) প্রতিশোধ গ্রহণ করে। অত্যাচারকারীরা শিগগিরই জানবে কোন স্থানে তারা প্রত্যাবর্তন করবে।’ (সুরা-২৬ শুআরা, আয়াত: ২২১-২২৭, পারা: ১৯)।
হজরত হাসসান বিন সাবিত (রা.) তৎকালীন অর্বাচীন প্রতিহিংসাপরায়ণ কবিদের বিদ্বেষমূলক ও অরুচিকর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সমুচিত কাব্যিক জবাব দিতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত হাসসান (রা.)-এর জন্য মসজিদে আলাদা মিম্বার তৈরি করান। পুরস্কার হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন প্রিয় নবীর উত্তরীয় বা গায়ের চাদর এবং ‘শায়েরুর রাসুল’, অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর সভাকবি উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। (আরবি কবিতায় ইসলামি ভাবধারা, ড. আবদুল জলিল)।
মুসলিম পণ্ডিতদের প্রায় সবাই কাব্যচর্চা করেছেন। এর মধ্যে কিছু কালজয়ী বিখ্যাত কাব্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। যেমন: সাহাবি হজরত কাআব ইবনে যুহায়ের (রা.) রচিত কাব্য ‘কাসিদায়ে বানাত সুআদ’; বিশিষ্ট তাবেয়ী নুমান ইবনে সাবিত হজরত ইমাম আযম আবু হানিফা (রা.) কর্তৃক রচিত কাব্য ‘কাসিদায়ে নুমান’; শেখ মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানি (রা.) রচিত কাব্য ‘কাসিদায়ে গাউসিয়া’; শাহ নিয়মতুল্লাহ কাশ্মীরি (রা.) রচিত কাব্য ‘ক্বাসিদায়ে শাহ নিয়ামতুল্লাহ’। (ক্বাসিদা সওগাত, রূহুল আমিন খান)।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বহু ইসলামি কবিতা লিখেছেন। তিনি কোরআন শরিফের ৩০তম পারা কাব্যে অনুবাদ করেছেন; যা কাব্যে আম পারা নামে প্রকাশিত হয়েছে। এটি বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত আবদুল মুকিত চৌধুরী সম্পাদিত নজরুল ইসলাম ইসলামি কবিতা গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এ গ্রন্থে নবী–জীবনী কাব্য ‘মরু ভাস্করও সন্নিবেশিত আছে। (নজরুল ইসলাম ইসলামি গান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
[email protected]