জাকাত ও রমজান

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো জাকাত। রমজানের সঙ্গে জাকাতের সম্পর্ক সুনিবিড়। জাকাত মানে যেমন পবিত্রতা, তেমনি রমজান মানে হলো আগুনে পুড়ে সোনা খাদমুক্ত বা খাঁটি করা। আল কোরআনে নামাজের নির্দেশ যেমন ৮২ বার রয়েছে, অনুরূপ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাকাতের নির্দেশনাও ৮২ বার রয়েছে। ‘জাকাত’ শব্দ দ্বারা ৩০ বার, ‘ইনফাক’ শব্দ দ্বারা ৪৩ বার এবং ‘সদাকাত’ শব্দ দ্বারা ৯ বার এই নির্দেশনা রয়েছে। এর দ্বারা জাকাতের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।
আল কোরআনে জাকাত প্রসঙ্গ
জাকাত শব্দটি পবিত্র কোরআনে আছে ৩২ বার, নামাজের সঙ্গে কোরআন মজিদে আছে ২৬ বার; স্বতন্ত্রভাবে কোরআনে আছে চারবার; পবিত্রতা অর্থে দুবার। এ ছাড়া জাকাত কখনো সদাকাত, কখনো ইনফাক শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইনফাক শব্দটি ব্যাপক, সদাকাত শব্দটি সাধারণ ও জাকাত শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও হয়েছে, অর্থাৎ এ তিনটি শব্দ একে অন্যের স্থলে ব্যবহৃত হয়েছে।
কোরআন মজিদে ১৯টি সুরায় জাকাতের আলোচনা এসেছে। যথা: (১) সুরা বাকারা (চারবার)। (২) সুরা নিসা (দুবার)। (৩) সুরা মায়িদা (দুবার)। (৪) সুরা তওবা (চারবার)। (৫) সুরা আরাফ। (৬) সুরা কাহাফ। (৭) সুরা মারইয়াম (তিনবার)। (৮) সুরা মুমিনুন। (৯) সুরা রুম। (১০) সুরা ফুচ্ছিলাত/হা-মীম সিজদাহ। (১১) সুরা আম্বিয়া। (১২) সুরা হজ (দুবার)। (১৩) সুরা নূর (দুবার)। (১৪) সুরা নমল, (১৫) সুরা লোকমান, (১৬) সুরা আহজাব, (১৭) সুরা মুজাদালাহ, (১৮) সুরা মুজাম্মিল ও (১৯) সুরা বাইয়িনাহ।
জাকাত মানে প্রবৃদ্ধি আর রমজানে প্রতি ইবাদতের সওয়াব আল্লাহ তায়ালা ৭০ গুণ বৃদ্ধি করে দেন। জাকাত প্রদান করতে গিয়ে আত্মপ্রচারণা ঠিক নয়। ব্যানার ঝুলিয়ে, সাইনবোর্ড লাগিয়ে, মাইকিং করে জাকাত প্রদান করা মোটেই সুন্নতসম্মত নয়। স্বল্পমূল্যের শাড়ি ও লুঙ্গি দ্বারা জাকাত দেওয়া তাকওয়ার প্রকাশ নয়। এ প্রসঙ্গে কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা কখনো প্রকৃত কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তা ব্যয় করবে যা তোমরা ভালোবাস। তোমরা যেকোনো বস্তুই ব্যয় করো, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সে বিষয়ে অবগত।’ (আল কোরআন, পারা: ৪, সুরা-৩ আল ইমরান, আয়াত: ৯২)।
জাকাত প্রদান করা মুমিনের পরিচয়। ‘যারা (মুমিনগণ) এমন যে, যদি আমি তাদের পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা দান করি, তারা (ক) নামাজ কায়েম করে, (খ) জাকাত প্রদান করে, (গ) সৎকাজের আদেশ করে ও (ঘ) মন্দ কাজে বাধা প্রদান করে।’ (সুরা- হজ, আয়াত ৪১)।
জাকাত যাঁদের ওপর ফরজ
প্রয়োজনের অধিক ‘নিসাব’ পরিমাণ (বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ) অর্থ-সম্পদ (স্বর্ণ-রুপা, নগদ টাকা ও ব্যবসাপণ্য) কারও কাছে এক বছর থাকলে, তার নিম্নবর্ণিত খাতগুলোর সমুদয় অর্থ-সম্পদের ২ দশমিক ৫ শতাংশ (শতকরা আড়াই ভাগ) জাকাত প্রদান করা ফরজ। ঋণ থাকলে তা বাদ দিয়ে হিসাব করতে হবে। যদি তার প্রয়োজনের অধিক স্থাবর সম্পদ থাকে এবং ঋণের পরিমাণ ওই সম্পদের চেয়ে কম হয়, তবে তা বাদ যাবে না। আর যদি ঋণের পরিমাণ ওই সম্পদের চেয়ে বেশি হয়, তবে সে সম্পদের পরিমাণ ঋণ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট ঋণ জাকাতযোগ্য সম্পদ থেকে বাদ দিয়ে হিসাব করতে হবে। যে ঋণ পরিশোধের জন্য কিস্তি নির্ধারিত আছে, সে ঋণের বর্তমান কিস্তি (যদি পরিশোধ না করা হয়ে থাকে) বাদ দিতে হবে। অনুরূপ বর্তমান মাসের যাবতীয় খরচও বাদ রাখবে। প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক সবার ওপর উল্লিখিত শর্তে জাকাত প্রযোজ্য। জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সাবালক হওয়া শর্ত নয়। কারও ওপর জাকাত ফরজ অবস্থায় তার মৃত্যু হলে প্রথমে তার সম্পদ থেকে জাকাত আদায় করতে হবে। অবশিষ্ট সম্পদ যথারীতি ব্যবহৃত হবে। (জাকাত নির্দেশিকা, পৃষ্ঠা: ১২৮)।
নিসাবের পরিমাণ
‘নিসাব’ হলো সোনা সাড়ে সাত ভরি, রুপা সাড়ে ৫২ ভরি অথবা এর সমমূল্যের নগদ টাকা ও ব্যবসাপণ্য। সেকালে সাড়ে সাত ভরি সোনা ও সাড়ে ৫২ ভরি রুপার মূল্যমান সমান ছিল। বর্তমানে সোনা ৪০ হাজার টাকা ভরি হিসাবে সাড়ে সাত ভরির মূল্য হয় প্রায় তিন লাখ টাকা, আর রুপা এক হাজার টাকা ভরি হিসাবে সাড়ে ৫২ ভরির মূল্য হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা।
জাকাত ও সদকাতুল ফিতর ব্যয়ের খাত
এ প্রসঙ্গে কোরআনে ঘোষণা হয়েছে, ‘মূলত সদাকাত হলো—(১) ফকির, (২) মিসকিন, (৩) জাকাতকর্মী (৫) কৃতদাস, (৬) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, (৭) আল্লাহর পথে জিহাদ ও (৮) বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফিরের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও পরম কৌশলী।’ (সুরা তওবা, আয়াত ৬০)।
যারা অগ্রাধিকার পাবেন
এ প্রসঙ্গে কোরআনে ঘোষণা হয়েছে, ‘এমন অভাবী লোক, যারা আল্লাহর পথে নিজেদের নিয়োজিত রাখার কারণে (উপার্জনের জন্য) দুনিয়া চষে বেড়াতে পারে না। সম্ভ্রান্ততার কারণে অনভিজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবহীন মনে করে। আপনি তাদের চিহ্ন দেখে চিনতে পারবেন। তারা মানুষের কাছে নির্লজ্জভাবে ভিক্ষা করে না। আর তোমরা যেকোনো উত্তম জিনিস ব্যয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ
তায়ালা সে বিষয়ে অবগত আছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৩)। উপরিউক্ত আটটি খাতের মধ্যে যুগ-চাহিদা ও গুণাগুণ বিবেচনায় রেখে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে জাকাত আদায় হওয়ার পাশাপাশি নিয়ত অনুযায়ী ক্ষেত্রবিশেষ সওয়াবেরও তারতম্য হবে। যেমন দীনি ইলম অর্জন ইত্যাদি।
জাকাত ও দুর্ঘটনা
জাকাত প্রদান করতে গিয়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায়ভার জাকাতদাতা বা আয়োজককেই নিতে হবে। যথা: কেউ আহত হলে তাঁর চিকিত্সার ও পরিবারের ব্যয়ভার নিতে হবে। কেউ নিহত হলে; অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের জন্য তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হলো জনপ্রতি ১০০ উট। একেকটি উঠের দাম সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা; সুতরাং মাথাপিছু ক্ষতিপূরণ ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা হতে পারে। সরকারি নির্দেশনায় প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় আদালতের সিদ্ধান্তে স্থানীয় সরকার বা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তির পরিবার ও উত্তরাধিকারীদের প্রদান করা হবে।
মাসআলা: মিসকিন ও ফকির
ইসলামি পরিভাষায় যাঁরা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নন; তাঁদের ওপর জাকাত, ফিতরা ও কোরবানি ওয়াজিব হয় না; তাঁরা সদকা খেতে পারেন। যাঁরা জাকাত দেবেন না তাঁরা জাকাত-ফিতরা খেতে পারবেন; তাঁরাই ফকির-মিসকিন। (আল ফিকহ আলা মাজাহিবিল আরবাআ)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com