জীবনব্যাপী পরকালের প্রস্তুতি

আল্লাহ তাআলা সব মানবাত্মা সৃষ্টি করে রুহের জগতে রেখেছিলেন। পর্যায়ক্রমে দুনিয়াতে পাঠাচ্ছেন। মাতৃগর্ভে অবস্থান ও ভূমিষ্ঠ হয়ে দুনিয়াতে আগমন এবং তারপর মৃত্যুবরণ। এই সময়টুকু দুনিয়ার জীবন। দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি হলো মৃত্যু। এর মাধ্যমে আমরা দুনিয়ার জীবনের নির্ধারিত আয়ু শেষ করে বারজাখ জীবনে প্রবেশ করি, যা সবার জন্যই অবধারিত। জীবনমাত্রই মরণশীল। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেছেন, ‘কুল্লু নাফসিন জায়িকাতুল মাউত’। অর্থাৎ প্রত্যেক সত্তাই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে। (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৮৫)।

কবর মানে সমাধি। ইসলামি বিধানমতে, মৃত ব্যক্তির দেহ দাফন বা সমাধিস্থ করা হয়। মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত তথা হাশর নশর ও বিচার ফয়সালার পূর্ব পর্যন্ত সময়কে বারজাখ বা অন্তর্বর্তী সময় বলা হয়। বারজাখ জীবনকে সাধারণভাবে কবর জীবন বলা হয়ে থাকে। কারণ, স্বাভাবিক অবস্থায় মৃতদেহ বা লাশ কবর দেওয়া হয়ে থাকে। যাদের বিশেষ কোনো কারণে কবর বা দাফন করা হবে না, তাদেরও বারজাখ জীবন একই রকম হবে। যদিও কবর বারজাখের সমার্থক নয়, তবু বারজাখ জীবন বোঝাতে কবর শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

বারজাখ জীবন বা কবরে প্রত্যেক মানুষকে তিনটি প্রশ্ন করা হবে। এই প্রশ্ন করার জন্য যে ফেরেশতারা আসবেন, তাঁদের উপাধি বা পরিচয় হলো ‘মুনকার-নাকির’। মুনকার-নাকির অর্থ হলো অপছন্দনীয় বা অবাঞ্ছিত এবং অযাচিত। যেহেতু বারজাখবাসী ব্যক্তি প্রশ্নকারী ফেরেশতাদের বিষয়ে অনাগ্রহী থাকবেন, তাই তঁাদের এরূপ পরিচিতিমূলক পদবি ব্যবহার করা হয়েছে। আরবিতে প্রশ্ন তিনটি হবে এভাবে, ‘মান রাব্বুকা? ওয়া মা দ্বীনুকা? ওয়া মান নাবিয়্যুকা?’ অর্থাৎ তোমার রব কে? তোমার দ্বীন-ধর্ম কী? তোমার নবী কে?

প্রশ্নের শেষাংশটি বিভিন্ন বর্ণনায় বিভিন্নভাবে রয়েছে। যেমন ‘ওয়া মান হাজার রাজুল?’ প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হবে, ‘এই ব্যক্তি কে?’ যঁাকে তোমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল।

মুমিন বান্দা উত্তর দেবেন, ‘আমার রব আল্লাহ, আমার ধর্ম ইসলাম, আমার নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)।’ অথবা ‘ইনি হলেন প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)।’ আর যারা গুনাহগার, বদকার, খাতাকার ও ছিয়াহকার এবং অবিশ্বাসী তারা বলবে, ‘হা! লা আদরি’। ‘হায়! আমি কিছুই জানি না।’

নেককার তথা পুণ্যবান মুমিনদের সঠিক উত্তর শোনার পর বলা হবে, ‘তাকে জান্নাতি লেবাস-পোশাক পরিয়ে জান্নাতি বিছানা সাজিয়ে দাও এবং জান্নাতের সাথে সংযোগ দিয়ে দাও।’ তাদের উদ্দেশে আরও বলা হবে, ‘নবদম্পতির মতো সুখে–শান্তিতে আরামে ঘুমাও।’ আর পাপী–তাপী অবিশ্বাসী যারা উত্তর দিতে ব্যর্থ হবে, তাদের জাহান্নামের শাস্তি বা আজাব শুরু হয়ে যাবে।

দুনিয়ার জীবন আখিরাতের কর্মক্ষেত্র। তাই সব চিন্তাচেতনায় ও কর্মসাধনায় আখিরাত বা পরকাল এবং বারজাখ বা কবর জীবনকে স্মরণ করে চললেই লক্ষ্যচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে। অন্যায় অপরাধ ও পাপ–তাপ থেকে বেঁচে থাকা সহজতর হবে।

কবরের তিনটি মৌলিক বিষয়ে প্রশ্ন, যথা রব, দ্বীন ও নবী। আল্লাহ তাআলা মানুষকে আলমে আরওয়াহ বা রুহের জগতে প্রথম রবুবিয়াত বিষয়ে স্বীকৃতি নেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আ লাছতু বিরব্বিকুম’ আমি কি তোমাদের রব নই?, ‘কালু- বালা’ সবাই বলেছিল—জি, হ্যাঁ। (সুরা-৭ আরাফ, আয়াত: ১৭২)।

‘রব’ মানে প্রভু। যিনি সৃষ্টিকর্তা, প্রতিপালক বা লালন–পালনকারী, রক্ষাকর্তা বা ত্রাতা এবং ধ্বংস করার ক্ষমতার অধিকারী। সুরা ফাতিহার শুরুতেই আমরা বলি, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’। সব প্রশংসা জগতের রব আল্লাহর জন্যই। যিনি পরম করুণাময় অসীম দয়ালু, যিনি বিচারদিনের মালিক। (সুরা-১ ফাতিহা, আয়াত: ১-৩)।

‘দ্বীন’ বা ধর্ম মানে হলো জীবনবিধান, চলার পথ ও পদ্ধতি। ইসলাম হলো পরিপূর্ণ জীবনবিধান এবং আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন। কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ইন্নাদ-দ্বীনা ইন্দাল্লাহিল ইসলাম’। অর্থাৎ ইসলামই আল্লাহর একমাত্র মনোনীত জীবনবিধান। (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ১৯)।

হজরত আদম (আ.) থেকে আখেরি নবী পর্যন্ত সব নবী ও রাসুলের ধর্ম ছিল ইসলাম। স্থান–কাল–পাত্রভেদে এবং ভাষা ও পরিভাষার তারতম্যের কারণে কখনো নামের ভিন্নতা এসেছে। বিধিবিধানেও পরিবর্তন এসেছে। তবে তাওহিদ, রিসালাত ও আখিরাত এই মৌলিক বিষয়ে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

কিয়ামত পর্যন্ত সব মানুষের দুনিয়ার শান্তি ও পরকালের মুক্তির একমাত্র পথ কোরআন কারিমের দর্শন ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর আদর্শ অনুসরণ। এতেই কবরের তিন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ হবে, বারজাখ জীবন নিরাপদ হবে এবং আখিরাতে নাজাত হবে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com