জুমাতুল বিদা ও আল কুদস দিবস

রমজানের প্রতিটি দিন তার আগের দিন অপেক্ষা শ্রেয়তর এবং অধিক ফজিলতপূর্ণ। তাই রমজনের শেষ জুমা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমণ্ডিত। বিদায় বা প্রস্থানের আরবি হলো ‘আল বিদা’; তাই রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘জুমাতুল বিদা’ বলা হয়ে থাকে। জুমাতুল বিদার মাহাত্ম্য অনেক বেশি। রমজান মাসের সর্বোত্তম দিবস হলো জুমাতুল বিদা।

রমজানের প্রথম পক্ষ অপেক্ষা দ্বিতীয় পক্ষ শ্রেষ্ঠ। প্রথম দশক থেকে দ্বিতীয় দশক উত্তম; দ্বিতীয় দশক থেকে তৃতীয় দশক উত্তম। শবে কদর রয়েছে রমজানের শেষ অংশে শেষ দশকে। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) শবে কদরের সন্ধানে প্রথমে রমজানের প্রথম দশক ইতিকাফ করেছেন, পরে রমজানের মাঝের দশক ইতিকাফ করেছেন, শেষে রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করেছেন এবং এতেই শবে কদর পেয়েছেন।

১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদর বিজয় দিবস। ১৯ রমজান ইসলামের সর্বকালের সেরা জয় মক্কা বিজয় দিবস। রমজানের শেষ শুক্রবার বিশ্ব স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রতীক ‘আল কুদস’ দিবস। প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ শুক্রবার সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বাইতুল মুকাদ্দাসে ইহুদিদের অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ ও প্রতিবাদ করেন এবং অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের কবল থেকে পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে মুক্ত করার জন্য নতুন শপথ গ্রহণ করে থাকেন। তাই মাহে রমজানের ‘জুমাতুল বিদা’ তথা শেষ শুক্রবারকে ‘আল কুদস দিবস’ বলা হয়। জুমাতুল বিদায় মসজিদে বিশেষ মোনাজাতে রোজাদার মুসল্লিরা দেশ ও জাতির উন্নয়ন, আল কুদসের মুক্তি এবং মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি, শান্তি ও কল্যাণের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেন।

বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের প্রতীক হলো কিবলা। মুসলিম জাতির কিবলা হলো ‘কাবা’। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘যারা নামাজ আদায় করবে, কাবাকে কিবলারূপে গ্রহণ করবে এবং আমাদের জবাই করা প্রাণী আহার করবে; তারা আমাদেরই অন্তর্ভুক্ত, তারা মুসলিম, তাদের অধিকার তেমন, যেমন আমাদের অধিকার।’ (বুখারি শরিফ)। ফকিহগণ বলেন: আহলে কিবলা তথা কাবাকে কিবলা হিসেবে স্বীকার করলেই সে মুসলিম। (আল ফিকহুস সুন্নাহ)।

শুরুতে ‘কাবা’ কিবলা থাকলেও মাঝে মসজিদুল আকসা বা ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ কিবলা হিসেবে স্বীকৃত হয়। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ওহি লাভ ও নবুওয়াত প্রকাশের সময় ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ই কিবলা ছিল। মদিনায় হিজরতের প্রায় দেড় বছর পর এই কিবলা পরিবর্তিত হয়ে পুনরায় ‘কাবা’ কিবলা হিসেবে নির্ধারিত হয়।

মদিনা থেকে মক্কা দক্ষিণ দিকে এবং বাইতুল মুকাদ্দাস উত্তর দিকে। নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কিরামসহ জামাতে জোহরের নামাজ আদায়রত অবস্থায় কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ হয়। তখন নামাজ অবস্থায় নবীজি (সা.) ও সাহাবাগণ উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে ঘুরে গিয়ে কাবামুখী হয়ে কিবলা পরিবর্তন করে নামাজ সম্পন্ন করলেন। ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে ‘তাহবিলে কিবলা’ বা কিবলা পরিবর্তন বলা হয়। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৪২-১৫১)। মদিনার এই মসজিদ আজও ‘মসজিদে কিবলাতাইন’ বা দুই কিবলার মসজিদ নামে পরিচিত। এখানে দুটি কিবলার চিহ্নও সংরক্ষিত আছে। এই সূত্রে ইসলামের দ্বিতীয় কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের প্রথম কিবলা হিসেবে পরিচিত হয়।

মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের কাছে সব সময় সম্মানিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) মিরাজ রজনীতে কাবা শরিফ থেকে মসজিদুল আকসা তথা বাইতুল মুকাদ্দাস প্রথম সফর করেন, যা ইসরা নামে পরিচিত। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ১)

‘আল কুদস’ বা ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ তথা ‘মসজিদুল আকসা’; যা ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নামক পবিত্র ভূমিতে অবস্থিত। হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর, তাঁর পুত্র হজরত ইসহাক আলাইহিস সালামের সন্তান হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম জেরুজালেমে ‘আল আকসা’ মসজিদটি নির্মাণ করেন। এরপর তাঁর পুত্র হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের বংশধর হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের সন্তান হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম তা পুনর্নির্মাণ করেন। মক্কার মসজিদুল হারাম ও মদিনার মসজিদে নববীর পর তৃতীয় পবিত্রতম স্থান হচ্ছে ‘বাইতুল মুকাদ্দাস’ বা ‘মসজিদুল আকসা’।

৬৩৮ সালে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর খিলাফতকালে বাইতুল মুকাদ্দাস, জেরুজালেমসহ পুরো ফিলিস্তিন সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের অধিকারে আসে। ১০৯৯ সালে খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন জবরদখল করে নেয়। ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর সিপাহসালার সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) পুনরায় জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন।

এরপর থেকে পরাজিত খ্রিষ্টান ও ইহুদি চক্র ফিলিস্তিন থেকে শুরু করে মদিনা শরিফ পর্যন্ত সারা মুসলিম এলাকা নিয়ে বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এ অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য ইহুদিরা তৎকালীন তুরস্কের শাসক সুলতান আবদুল হামিদের কাছে ফিলিস্তিনে বসতির অনুমতি চায়; দূরদর্শী সুলতান তাদের এ দুরভিসন্ধিমূলক প্রস্তাবে রাজি হননি। তা সত্ত্বেও ইহুদিরা গোপনে ফিলিস্তিনে ভূমি আয়ত্ত করতে থাকে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফিলিস্তিন ছিল ব্রিটেনবিরোধী জোটে৷ তখন যুদ্ধজয়ে ফিলিস্তিনিদের সহযোগিতা পাওয়ার আশায় ১৯১৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর যুদ্ধে জয়ী হলে এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন৷ এটা ইতিহাসে বেলফোর ঘোষণা হিসেবে পরিচিত৷ যেহেতু আরবরা ছিল ইহুদিদের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি, সেহেতু ঘোষণাটি তাদের অনুকূল বলেই তারা ধরে নেয়৷ কিন্তু এর মাঝে যে মহা ধোঁকাটি লুকিয়ে ছিল, তা তারা বুঝতে পারেনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেনের প্রয়োজনে দুর্লভ বোমা তৈরির উপকরণ কৃত্রিম ফসফরাস তৈরি করতে সক্ষম হন ইহুদি বিজ্ঞানী ড. হেইস বাইজম্যান৷ তাঁর কাছে ব্রিটেন জানতে চেয়েছিল কী ধরনের পুরস্কার তিনি চান৷ বাইজম্যানের উত্তর ছিল, আমার স্বজাতির জন্য এক টুকরো ভূমি আর তা হবে ফিলিস্তিন৷ ফলে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি ইহুদিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেয় ব্রিটেন৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জয়ের পর ব্রিটেন স্বাধীনতা দেওয়ার অঙ্গীকারে ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে৷ মূলত এই সময়টিই ফিলিস্তিনকে আরবশূন্য করার জন্য ভালোভাবে কাজে লাগায় ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি৷ এ সময়ের মধ্যে বহুসংখ্যক ইহুদি ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। এ সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ অন্যায়ভাবে মুসলমানদের ফিলিস্তিন ভূমিকে মুসলমান ও ইহুদিদের মাঝে ভাগ করে দেয়। এরই ফলে ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইহুদিদের জুলুম-নির্যাতন ও অত্যাচারে মুসলমানরা জীবন বাঁচাতে দলে দলে হিজরত করে দেশত্যাগে বাধ্য হয়। তখনো বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের অধিকারে ছিল।

১৯৬৭ সালে ইসরায়েল আক্রমণ চালিয়ে ‘মসজিদুল আকসা’ জবরদখল করে নেয়। এরপর মুসলিম জনগণ স্বাধীনতাযুদ্ধের সূচনা করে। কিন্তু ইসরায়েল নতুন নতুন মুসলিম এলাকা জবরদখল করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে। ইহুদিদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা সচেতন মুসলমানদের সংগ্রামী প্রতিরোধ আন্দোলনের মুখে পরিপূর্ণভাবে সফল হতে পারেনি। ১৯৭৯ সাল থেকে ‘আল আকসা’ মসজিদকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সমগ্র মুসলিম উম্মাহ প্রতিবছর রমজান মাসের শেষ শুক্রবার ‘আল কুদস’ দিবস পালন করে থাকে।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম