দূরের বাদ্যি

শারদীয় পূজাবার্ষিকীই ছিল আমার দুর্গাপূজার সবচেয়ে উজ্জ্বল স্মৃতি, আমার জন্য আনন্দমেলা, আব্বার জন্য দেশ। প্রচ্ছদে গর্জন তেলে প্রসাধিত চকচকে দেবীপ্রতিমার মুখ থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে রং। মকবুল ফিদা হুসেন নয় চিত্রভানুর আঁকা দশমহাবিদ্যা। পেছনে লেখা ‘যাও গিরিরাজ’। ভেতরে শ্রীপান্থর লেখায় জন কোম্পানির সাহেবেরা যোগ দিচ্ছেন সেকালের দুর্গাপূজায় অর্থ-যশ-কবিগান-তর্জা-খেমটা-বাইনাচের অন্তহীন প্রদর্শনীতে, শোভাবাজার রাজবাড়িতে পলাশীর যুদ্ধের পর দুর্গোৎসবে মহারাজা নবকৃষ্ণ দেববাহাদুরের অতিথি হয়ে দেখা দিচ্ছেন লর্ড ক্লাইভ। ভেতরে তারাপদ রায় লিখছেন লৌহজঙের ‘আইতান-কাইতান’ ঝড়বৃষ্টির সুখস্মৃতি। আমার ঝুড়ি উপচে উঠছে হরেক রকম বাজি ও বারুদে, তাদের নাম ‘আঁধার রাতের অতিথি’, ‘মিশর রহস্য’, ‘ঋভুর শ্রাবণ’ কিংবা ‘পাগলা সাহেবের কবর’। তখনকার বিজ্ঞাপনের পাতায় বিজলি গ্রিলের লোভনীয় হাতছানি, চাউমিন আর এগরোলের আহ্বান, পূজার শাড়ি পরে সুচিত্রা মিত্রের বলা ‘সকলি শোভন সকলি নবীন সকলি বিমল’; এর পাশাপাশি ছিল দেবীদহের এক শ আটটা নীলপদ্ম দিয়ে দেবীর পূজার ছবি, রাম-রাবণের যুদ্ধের আগে অকালবোধন, রামচন্দ্র পূজার পদ্ম একখানা কম পড়াতে নিজের পদ্মপলাশলোচন (‘যুগল নয়ন মোর ফুল্ল নীলোৎপল...’) উৎপাটন করে দেবীর পূজা দিতে উদ্যত হচ্ছেন আর দেবী শারদনিদ্রা ভেঙে মর্ত্যে নেমে এসে তাঁর হাত চেপে ধরে নিষেধ করছেন। দেশ-এর পূজাসংখ্যা যদিও ধরা নিষেধ, আমি চুরিয়ে পড়ছি, ‘দুর্গার স্তনসন্ধিতে একখানি কমলসূত্র অব্দি ঠাঁই পায় না...’ (এখন ভাবি, ধন্যি ঋষিদের কল্পনা, সে কোন যুগে সিলিকনের স্বপ্ন দেখে গেছেন।)
আমার আরেকটা ধুনোয় অন্ধকার সন্ধ্যাবেলার কথাও মনে পড়ে: ঘরের বাতাস নারকেল-ভেজা চাল-দুধ-কলা-ধূপের ঘ্রাণে গুমোট, ঘরের মেয়েদের গায়ে কেশতৈল-চন্দন-কর্পূর-ঘাম-নতুন তাঁতের শাড়ির সম্মিলিত গন্ধ, বাইরের বাতাসে গোত্তা খাচ্ছে খবরের কাগজরঙা ডানাওয়ালা মথ, বাইরে নিদ্রাভিভূত শুক্লরাত্রি, রাতের আকাশে তুলোট মেঘমায়া আর দোল খাওয়া নস্যরং রেশমি কাশফুল। বাইরে ‘শিউলীসুরভী রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে/ মৃদু মর্মর গানে তব মর্মের বাণী বোলো।’
—‘উমার মায় কী কী দিয়া গ্যাছে, খাবিনি হাসু?’
কান খাড়া হয়ে ওঠে আমার, হাসু আমার মায়ের নাম, আহ্বান আমার মায়ের খালার।
ক্ষীরের তক্তি, তিলপাটালি, সরের নাড়ু, দুধের সন্দেশ—পালপাড়ার সেই বাড়িতে প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে আসত দারুণ সব মিষ্টান্ন। হিন্দুর পূজার প্রসাদ মুসলমানের খেতে হয় কি না এই নিয়ে মায়েদের কিছু সংলাপবিনিময়ের পর আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়তাম মিষ্টিগুলোর ওপর, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ জয়ী হওয়ার অনেক আগেই ‘রসনা’ জয়ী হতো। পালপাড়ার মামারা সেসব সন্ধ্যায় প্রতিবেশী মামাদের ঢঙেই জরিদার ধুতি পরত, খালারা দিত কুঙ্কুমের টিপ-সিঁদুর, সব ‘মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’ অনায়াসে দিতেন উলুধ্বনি। সন্ধিপূজার ঢাকের বাদ্যি মিশে যেত গভীর রাতে ভিসিআরে জেগে দেখা অমিতাভ বচ্চনের নতুন ছায়াছবির হুংকারে, জমায়েতরা কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান আর সব্বাই রসাস্বাদনে ওস্তাদ। রাবণের দশটি মাথা কিনা কামবাসনা-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য্য-স্বার্থ-অন্যায়-অমানবিকতা-অহংকারের প্রতীক, তো সেসবের কিছুই আদতে বধ্য নয় বলে অম্লানবদনে সমবেত দর্শক কলির রাবণ অমরেশপুরী-বধে মন দিত।
দুর্গাপূজার আগে-পরে ঝড়বৃষ্টি হতো প্রায়ই, অকালবর্ষণের রাত শেষে যে ভোর আসত, তা নিয়ে আসত আসন্ন শীতের নিশানা, ফাইনাল পরীক্ষার তোড়জোড়। পূজার ছুটির পর স্কুলে ফিরে গিয়ে দেখতাম মাঠের ঘাসগুলো কত বড় হয়ে গেছে, তাতে হাঁটু মুড়ে বসলে আর আমাদের দেখা যায় না, বাতাসের গন্ধ রাতভর শীতগন্ধি প্রস্বেদনের কারণে বদলে গেছে, দেবদারুগাছের পাতা ঝরা শুরু হয়েছে, স্কুলশিক্ষিকারা একরঙা পাড় দেওয়া হালকা উলের শাল বের করে ফেলেছেন, অমিতি হালদার পূজার ছুটিতে ভারত গিয়ে আর ফিরে আসেনি, তপতী মণ্ডল-শিলারানী সরকার ফিরেছে হাতে লালহলুদ সুতোগাছি নিয়ে, আমার স্কুলের বন্ধু শাওন ঘোষ পুষ্পক রথ থেকে সীতার কেয়ূর ছুড়ে দেওয়ার পর মাধ্যাকর্ষণের কারণে কত বেগে তা ভূতলস্পর্শ করে এসব নিয়ে জেরবার হচ্ছে যথারীতি, দুর্গোৎসবের মহিমা তাকে বিচলিত করেনি। আমরা পড়ছি, ‘বুটিদার জরিপাড় শ্যামশাড়ি অঙ্গে/ এলোকেশে এলো হেসে শরৎ এ বঙ্গে’, গানের স্কুলের মাস্টারমশাই শিখিয়ে শেষ করেছেন নতুন নজরুলগীতি, ‘এসো ভাদরের ভরা নদীতে ভাসায়ে কেতকীপাতার তরনী/এসো বলাকার ঝরা পালক উড়ায়ে বাহি ছায়াপথ সরনী...এসো শারদপ্রাতের পথিক’। ধুনকারেরা নেমে এসেছে অলিগলিতে, দূরের ছাদে রোদে শুকাচ্ছে মার্কিন কাপড়ের ওয়াড় খোলা লালসালুর লেপ, বাজারে উঠছে নতুন কালচে শিম আর ঠাসবুনোটের ফুলকপি।
এমনিতে বারান্দার টবে ফোটা খুচরো বেলি আর চিনির মঠ, পালপাড়ার সেই উমার মায়ের ঠাকুরের প্রসাদ ছিল নিত্যি। প্রবাসের মানুষ কেমন করে ডাকে যে যার ঈশ্বরকে? কেউ সক্কালবেলা পূজাপাঠ সেরে চন্দনের আস্তর লেপে চলে আসে পোস্ট অফিসে কাজ করবে বলে, কেউ ঠাকুরকে ব্যালকনির মরসুমি ফুলের সামান্য মঞ্জরি-পাতা আর সুগারকিউব দিয়ে তুষ্ট করে গানের স্কুলের ট্রেন ধরে—
পরবাস বোধ করি অপরের ঈশ্বরকেও আপন করে তোলে কিংবা হৃদয়ে চিরজাগরূক রাখে উৎসবের তৃষ্ণা, যা কিছু পেছনে ফেলে এসেছে তাই আবার সাদরে উদ্যাপনের স্পৃহা। সৌর দিবসে ১৮ ঘণ্টার রোজা রাখা ছেলেটি আর অ্যাগনস্টিক মেয়েটি দিব্যি ট্রেন ধরে চলে যায় দুর্গাপূজা দেখতে, খিচুড়ি-লাবড়া-পরমান্নর ভোগ খেতে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট-কোর্টেও কয়েক বছর আগে আয়োজিত হয়েছে দুর্গোৎসব, ক্লাইভ-হেস্টিংসের পদধূলি পড়া শোভাবাজারের রাজবাটি থেকে শুরু করে নিখিল-ভারতের সুখদাং বরদাং জননীমূর্তি হয়ে ওঠা দুর্গাকে কম সইতে হয়নি ব্রিটিশরাজের আমলে।
আর প্রবাসের জেলখানায়? যেখানে প্রতি শুক্রবার জুমা প্রেয়ারের পর একটা ছোটখাটো রায়ট লেগে যায়, রায়ট থামাতে পুলিশ ছুটে আসে, পুলিশ জুতো পায়ে নামাজের জায়গা মাড়িয়েছে বলে রায়ট আরও ফুলেফেঁপে ওঠে...জাতপাত গায়ের রং এসব পাতি বিষয় নিয়ে যেখানে অক্লান্ত মারধর করে যায় কয়েদিরা, সেখানে দশেরা উপলক্ষে ‘হট ফুড’ চাই। দেশে যতই সাধ করে কোল্ড মিটের স্যান্ডউইচ খাই না কেন, এসব দেশে আমাদের দক্ষিণ এশীয়দের আকুলতার আরেক নাম হট ফুড, গরমাগরম ভাত-তরকারি বা চাপাতি-তরকারি। আমার দেখা কারাগারের ভেতরেও তার ব্যতিক্রম ছিল না, ডেরা ইস্মাইল খাঁর আবদুর রহমান, পাঞ্জাবের ছত্রপতি সিং, রোহিঙ্গা রুস্তম, অসমিয়া সাঁইকিয়া, নেপালি ঝাঁ, সুনামগঞ্জের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাচামিয়া—সব্বাই একসুরে চাইত উৎসব উপলক্ষে তাদের এক বেলা গরম খাবার দেওয়া হোক, কুড়ি বছর আগে পালিয়ে আসার পর যারা প্রিয়জনদের আর দেখতে পায়নি তারা সমারোহ করে একটি বেলা হটফুড খাবে, ভুলেও জানতে চাইবে না এ কার উৎসব—হিন্দুর না মুসলমানের।
সাগুফতা শারমীন তানিয়া: কথাসাহিত্যিক।