ধর্ম সম্পর্কে রাশিয়ার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

মস্কোয় রাশিয়ার সর্ববৃহৎ​ মসজিদ l ছবি: রয়টার্স
মস্কোয় রাশিয়ার সর্ববৃহৎ​ মসজিদ l ছবি: রয়টার্স

ধর্ম সম্পর্কে রাশিয়ার যে গভীর নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এত দিন কমবেশি জানা বা অনুমান ছিল, তার সঙ্গে বাস্তবের বিরাট তফাত লক্ষ করে বিস্মিত হয়েছি। পুতিন ঘটা করে গির্জায় যাচ্ছেন। ইসলাম রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম, যদিও মুসলমানরা সংখ্যায় মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশের বেশি নয়। রাশিয়ায় সুন্নি, শিয়া, সুফি ও আহমদিয়া সম্প্রদায়ের পাঁচ হাজারের মতো নিবন্ধিত ধর্মীয় সংগঠন রয়েছে।
সিরিয়ায় রাশিয়া যেভাবে জড়িয়ে পড়েছে, তাতে ইসলামের প্রতি রাশিয়ার সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি কোথায় গিয়ে একটা মীমাংসায় পৌঁছায়, সেটা গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। রাশিয়ার মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে ইসলাম ও অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে দেশটির মনোভাব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে।
‘উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে মুসলিম দেশের সাংবাদিক’ শীর্ষক দুই দিনের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশসহ ১৮টি দেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের উদ্দেশে ইসলাম সম্পর্কে রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে গিয়ে রুশ বক্তাদের বক্তব্য শুনে তাজ্জব হয়ে গেছি। তাঁরা কথায় কথায় উদারনৈতিক ইসলামের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন। এমনকি একজন বক্তা বললেন, তাঁরা শিগগিরই ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা চর্চাকেন্দ্র হিসেবে স্কুল চালু করার কথা ভাবছেন। ইসলামি বিশ্বের সঙ্গে সংলাপকে রাশিয়া এখন সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে যে কৌশলগত রূপকল্প রাশিয়া প্রণয়ন করেছে, তা আকস্মিকভাবে ঘটেনি। ইসলাম নিয়ে যে সংলাপ শুরু করেছে, তা তারা নানা মাত্রায় অব্যাহত রাখবে। বাংলাদেশ থেকে এর আগে তারা ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে শিক্ষাবিদ ড. কে এম শমসের আলীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এ রকম আমন্ত্রণ তারা ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে অব্যাহত সংলাপ এখন পুতিনের বিদেশনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
লক্ষণীয় যে তারা এটা করছে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে চেচেন বিদ্রোহ–সংকট মোকাবিলা, সাম্প্রতিক সময়ে মস্কোতে অন্তত দুটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা সংঘটন, ক্রিমিয়া অধিগ্রহণ এবং সিরিয়ায় তাদের সামরিক অভিযানের পটভূমিতে।
ইসলাম নিয়ে সংলাপের বিষয়ে তাতারস্তানের প্রেসিডেন্ট রুস্তম মিন্নিখানোভ নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁকে করা হয়েছে এ–সংক্রান্ত স্ট্র্যাটেজিক ভিশন গ্রুপের চেয়ারম্যান। মস্কোয় আমাদের সম্মেলনে তিনি অাসতে না পারলেও একটি বিবৃতি পাঠিয়েছেন এবং সেটা যিনি পাঠ করলেন, তিনি বললেন, আগামী মাসেই তাতারস্তানে আরেকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হবে, সেখানেও বাংলাদেশি শিক্ষাবিদ আমন্ত্রিত হবেন।
ইসলাম রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। আর সেটা যে তাদের অহংকার, পুতিন সরকার তা বিশ্বের সামনে নানাভাবে চিত্রিত করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এই স্ট্র্যাটেজিক ভিশন গ্রুপের সমন্বয়ক হলেন প্রবীণ রাষ্ট্রদূত পাপভ, যিনি অনর্গল আরবি বলতে পারেন। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রদূত ছিলেন, একবার বাংলাদেশও সফর করেছেন তিনি। পাপভ বললেন, প্রাচীনকাল থেকে ইসলাম সোভিয়েত ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিকশিত হয়েছে। তাতারস্তান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর সেখানে প্রায় ৩০ শতাংশ আন্তধর্মীয় বিয়ে হচ্ছে। উল্লেখ্য, রুশ মুসলমানদের মধ্যে তাতাররা প্রাচীনকাল থেকে বেশি প্রভাব ফেলেছে। এ কারণে রাজধানী মস্কোতে তাতারদের নামে বহু রাস্তার নামকরণ করা আছে। তাতারস্তানসহ অনেক স্থানে এখন ইসলামি ফাউন্ডেশন হচ্ছে।
দোভাষীর মাধ্যমে ধর্ম নিয়ে বিস্তারিত কথা হলো স্বনামধন্য রুশ লেখক ও টিভি ব্যক্তিত্ব এ স্তোলিয়ারভের সঙ্গে, তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে থাকেন। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, কবে থেকে আপনারা ধর্ম সম্পর্কে লেনিনের দৃষ্টিভঙ্গিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিহার করেছেন? উত্তরে বললেন, এটা পুতিন এসেই শুরু করেছেন। মস্কোর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ বন্ধ ছিল। সেটা বিপুল অর্থব্যয়ে (তুরস্ক, কাজাখস্তানও অনুদান দিয়েছে) আধুনিকায়নের পরে তিনি চালু করেছেন। জানতে চাইলাম, কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বিরোধী দলের আসনে বসে কি ধর্ম সম্পর্কে পুতিনের মনোভাবের কোনো সমালোচনা করেন? উত্তরে তিনি বললেন, না। তা করেন না। বরং তাঁরাও ধর্ম সম্পর্কে তাঁদের পুরোনো মনোভাবে পরিবর্তন এনেছেন বলেই মনে হয়।
আমি এ নিয়ে কথা বলি ১৯৬৬ সালে রাশিয়ায় পড়তে আসা সত্তরোর্ধ্ব ড. রথীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জির সঙ্গে। তাঁর কথায়, ধর্ম নিয়ে আগে তো সব রুদ্ধ ছিল, সেটা খুলে গেছে। ধর্মের উদারনৈতিকতাকে সামনে আনা হয়েছে। তিনি অবশ্য বলেন, ধর্ম সম্পর্কে লেনিন ও স্তালিনদের মনোভাবকে একেবারে নাকচ করার কিছু নেই। এ প্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথ বলেন, ধর্ম সম্পর্কে স্তালিনের নজর যদি অতই নেতিবাচক থাকবে, তাহলে তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গির্জাগুলো খুলে দেওয়া হতো না। বললাম, তার মানে কী দাঁড়ায়? রেডিও মস্কোর বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত ব্রডকাস্টার ড. চ্যাটার্জি এর উত্তরে বললেন, কোনো দুর্যোগ ও বিপদের মধ্যে মানুষ মুখে যা-ই বলুক, তার ভেতরটা বেরিয়ে আসে। যুদ্ধ যখন বাঁধল, তখন রুশদের মঙ্গল কামনায় তাদের প্রিয়জনেরা যাতে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে পারে, সে জন্য স্তালিন গির্জাগুলো খুলে দিয়েছিলেন।
ড. চ্যাটার্জি ও স্তোলিয়ারভ উভয়ে নিশ্চিত করেন পুতিন কিন্তু এটা বজায় রাখছেন যে রাষ্ট্র ও ধর্ম আলাদাই থাকবে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় আছে। মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের উপস্থিতিতে মস্কোর গ্র্যান্ড মসজিদ উদ্বোধন করে পুতিন বলেছেন, আমি ইসলামি আধ্যাত্মিক নেতাদের সাহায্য চাই, ‘জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় উগ্রপন্থার’ বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাঁদের ভূমিকা বিরাট পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে। রাশিয়াজুড়ে মসজিদ ও মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উদারনৈতিক ইসলামের উত্থানকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে গিয়ে পুতিন সরকারের মুখপাত্ররা বলছেন, আমরা পুতিনকে নিয়ে গর্বিত। কারণ, তিনি আধুনিক রাশিয়ার ইতিহাসে প্রথম বিশ্বাসী প্রেসিডেন্ট। শুনলাম পুতিন তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছে এ কথা বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন যে তিনি যে ব্যক্তিজীবনে একজন ধর্মানুরাগী, তার বহিঃপ্রকাশ ছাত্রজীবনেই ঘটেছিল। তিনি নিজেও অবাক হন যে একজন ধর্মানুরাগী জেনেও তাঁকে কী করে কেজিবিতে চাকরি দেওয়া হয়েছিল।
রুশ নেতারা মুসলিম বিশ্বই শুধু নন, বহির্বিশ্বকে যে বার্তাটা জোরেশোরে দিতে চাইছেন সেটা হলো, তাঁরা সমাজ থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে বা দূরে সরিয়ে রাখতে চাইছেন না। বরং তাঁরা প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রের যে বৃহত্তর আধ্যাত্মিক মেলবন্ধ আছে, সেখানে তাঁরা ধর্মকে বাধা হিসেবে দেখছেন না। তাই অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামকেও বরণ করেছেন। দুই দিনের সম্মেলনে রুশ বক্তারা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে বলছেন, রাশিয়া একটি বহু জাতির, বহু সংস্কৃতির এবং বহুত্ববাদী সমাজ, সে কারণেই তাঁরা ধর্মকে আর দূরে সরিয়ে রাখবেন না। তবে যাঁরা ইসলামের নাম ব্যবহার করে উগ্রবাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন, যাঁরা ধর্মকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে চাইছেন, তাঁদের তাঁরা আলাদা রাখতে ও নিবৃত্ত করতে চান। সব ধর্মের বন্ধন ও সহিষ্ণুতা ছড়িয়ে দিতে পারলে তা মানবজাতির কল্যাণ বয়ে আনবে। ধর্ম নিয়ে জোর–জবরদস্তি না করার ইসলামি শিক্ষা রাশিয়া নিচ্ছে। ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার মাটিতে ‘নিউ ইসলামিক সোশ্যালাইজেশন’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে চান। এই ঘোষণা কতটা কৌশলগত আর কতটা বস্তুনিষ্ঠ, সেটা সময় বলে দেবে।
তবে ক্ষমতার সর্বোচ্চ ভরকেন্দ্র ক্রেমলিনের জাদুঘরে রাশিয়ার কোনো এক জারকে দেওয়া কতিপয় মূল্যবান দ্রষ্টব্যের মধ্যে আমাদের দেখানো হলো কারুকার্যময় কতিপয় তরবারি ও ধাতব শিরস্ত্রাণ। চোখ ধাঁধানো তার শিল্পসুষমা। দোভাষী বললেন, এই যে শিরস্ত্রাণ দেখছেন, এর ওপরে আরবি ভাষায় আল্লাহর ৯৯টি পবিত্র নাম খোদিত করা আছে। কোনো এক মধ্য এশীয় মুসলিম নৃপতি সপ্তদশ শতাব্দীর জারকে উপঢৌকন দিয়েছিলেন আর তা লেনিন, স্তালিনসহ বিপ্লব–পরবর্তী রাশিয়ার প্রতিটি শাসক কিন্তু সযত্নে রক্ষা করেছেন।
একটি তরবারির গায়ে আরবিতে শান্তি ও বন্ধুত্বের কথাই ব্যক্ত করা আছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
[email protected]