নফল রোজার ফজিলত ও বিধান

.
.

রমজান মাসে রোজা পালন করা ফরজ। কোনো কারণ ছাড়া রমজানের ফরজ রোজা ভেঙে ফেললে তার কাজা ও কাফফারা রোজা পালন করা ফরজ। রমজানে ফরজ রোজা না রাখলে বা কোনো কারণবশত ছেড়ে দিলে তার কাজা আদায় করা ফরজ। এ ছাড়া মানত রোজা পালন করা এবং নফল রোজা রেখে ছেড়ে দিলে বা ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় নফল রোজা ভেঙে ফেললে তা পুনরায় আদায় করা ওয়াজিব। ফরজ ও ওয়াজিব রোজা ছাড়া অন্যান্য রোজাকে নফল রোজা বলা হয়; নফল মানে অতিরিক্ত, ফরজ বা ওয়াজিব নয়। মূলত এই নফল রোজা দুই প্রকার। প্রথম প্রকার হলো নির্ধারিত বা রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক পালনকৃত, এই প্রকার রোজা সুন্নত। দ্বিতীয় প্রকার হলো অনির্ধারিত, এগুলো মুস্তাহাব। এই উভয় প্রকার রোজাকে সাধারণভাবে নফল রোজা বলা হয়ে থাকে।

নফল রোজার ফজিলত
রোজার ফজিলত সম্পর্কে হাদিস শরিফে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক বস্তুর জাকাত আছে, শরীরের জাকাত রোজা।’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘রোজা ঢালস্বরূপ এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার সুদৃঢ় দুর্গ।’ (নাসায়ি)।
হজরত ইবনে খুজাইমা ও হাকিম আবু ইমাম বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আপনি আমাদের কিছু আমল করার উপদেশ দান করুন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রোজা অবলম্বন করো, এর সমকক্ষ কোনো আমল নেই।’ তাঁরা পুনরায় বললেন, আমাদের কোনো আমল বলে দিন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রোজা অবলম্বন করো, এর সমতুল্য কোনো আমল নেই।’ তাঁরা পুনরায় একই প্রার্থনা করলেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) পুনরায় একই আদেশ করলেন। (সুনানু নাসায়ি)।

হজরত মুআজ ইবনে আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন ‘যে ব্যক্তি রমজান মাস ছাড়া অন্য সময় আল্লাহ তাআলার জন্য একটি রোজা রাখবে; দ্রুতগামী ঘোড়া ১০০ বছরে যত দূর রাস্তা অতিক্রম করতে পারে, দোজখ তার কাছ থেকে তত দূরে অবস্থান করবে।’ (তিরমিজি ও নাসায়ি)।
হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার জন্য একটি রোজা রাখবে, আল্লাহ তাআলা তার মুখমণ্ডল দোজখের আগুন থেকে ৭০০ বছরের রাস্তা দূরে রাখবেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
হজরত আবু দারদা (রা.) ও হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলার জন্য পালনকৃত একটি রোজার ফলে জাহান্নাম (ওই রোজাদার ব্যক্তি থেকে) আসমান-জমিনের দূরত্বে অবস্থান করবে।’ (তিরমিজি ও তাবরানি)।
হজরত ওমর (রা.) ও হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দোজখ রোজাদার ব্যক্তি থেকে ১০০ বছরের দূরত্বে থাকবে।’ (তাবরানি)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যে ব্যক্তি একটি রোজা পালন করবে, একটি কাকের সারা জীবন উড়ে যত দূর পথ অতিক্রম করা সম্ভব, জাহান্নাম তার কাছ থেকে তত দূরে থাকবে।’ (তরিকুল ইসলাম)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যদি কেউ এক দিন নফল রোজা রাখে, তবে তার যে সওয়াব হবে, তা পৃথিবীর সমান স্বর্ণ দান করলেও তার সমান হবে না।’ (তাবরানি ও আবু ইয়ালি)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রোজাদার ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়। (বায়হাকি)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, হাদিসে কুদসিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে ‘আল্লাহ তাআলা বলেন, রোজা আমারই জন্য, আমি নিজেই তার প্রতিদান দেব; রোজা আমারই জন্য আমি নিজেই তার প্রতিদান।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

রমজান মাসের রোজা ও অন্যান্য রোজার নিয়তের তারতম্য
রমজান মাসের রোজা ও অন্যান্য রোজার নিয়তের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। রমজান মাসের ফরজ রোজার নিয়ত মধ্য দিবসের পূর্ব পর্যন্ত তথা দুপুর ১২টার আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে করা যায়। রমজান মাসের ফরজ রোজা ভিন্ন অন্যান্য রোজার নিয়ত ‘সুবহে সাদিক’-এর আগে তথা সেহ্রির সময়ের মধ্যে বা তার আগেই করতে হয়। কারণ, রমজান মাসের ফরজ রোজার সময় নির্ধারিত এবং তা বাধ্যতামূলক; আর অন্যান্য রোজার কোনো নির্ধারিত সময় নেই এবং এগুলো রমজান মাসের ফরজ রোজার মতো বাধ্যতামূলক অপরিহার্য ফরজ কর্তব্য নয়।

রোজার আদব
রোজার সাতটি আদব রয়েছে, যা রোজা কবুলে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। এক. চোখের হেফাজত; দুই. জবানের হেফাজত; তিন. কানের হেফাজত; চার. অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হেফাজত; পাঁচ. অল্প সেহ্রি; ছয়. স্বল্প ইফতার; সাত. আল্লাহর প্রতি অনুরাগ।

মেহমান ও মেজবানের সম্মানে নফল রোজা ছেড়ে দেওয়া

>নফল রোজা দুই প্রকার; প্রথম প্রকার হলো নির্ধারিত বা নবী করিম (সা.) কর্তৃক পালনকৃত, এই প্রকার রোজা সুন্নত; দ্বিতীয় প্রকার হলো অনির্ধারিত, এগুলো মুস্তাহাব। এই উভয় প্রকার রোজাকে সাধারণভাবে নফল রোজা বলা হয়ে থাকে

নফল রোজা পালন অবস্থায় যদি অতিথি আপ্যায়ন করাতে হয় বা আপ্যায়ন গ্রহণ করতে হয়, তাহলে নফল রোজা ছেড়ে দেওয়া জায়েজ হবে এবং পরবর্তী সময়ে এই রোজা কাজা আদায় করা ওয়াজিব হবে। এতে তিন গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে। প্রথমত, নফল রোজা রাখার সওয়াব; দ্বিতীয়ত, মেহমান (গেস্ট) বা মেজবান (হোস্ট)-এর সম্মান রক্ষার সওয়াব; তৃতীয়ত, নফল রোজা ভাঙার পরিবর্তে ওয়াজিব কাজা রোজা আদায় করার সওয়াব।
হজরত উম্মে হানি (রা.) বর্ণনা করেন, মক্কা বিজয়ের দিন ফাতিমা (রা.) এলেন, তিনি নবীজি (সা.)-এর বাঁ পাশে বসলেন এবং উম্মে হানি (রা.) নবীজি (সা.)-এর ডান পাশে বসলেন। এমতাবস্থায় ওয়ালিদাহ একটি পানপাত্র নিয়ে এল। নবীজি (সা.) তা থেকে পান করলেন, তারপর উম্মে হানি (রা.) পান করলেন। এরপর উম্মে হানি (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমি রোজা ছিলাম এখন ইফতার (ভঙ্গ) করলাম। নবীজি (সা.) বললেন, তুমি কি কাজা রোজা করছিলে? উম্মে হানি (রা.) বললেন, না। তিনি বললেন, যদি তুমি নফল রোজা রাখো তবে তা ভাঙায় কোনো দোষ নেই। (আবু দাউদ, তিরমিজি ও দারমি)।
হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি ও হাফসা রোজা ছিলাম; আমাদের সামনে খাবার পেশ করা হলো, আমাদেরও খেতে ইচ্ছে হলো; আমরা আহার করলাম। হাফসা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমরা রোজা ছিলাম, আমাদের সামনে খানা পেশ করা হলো, আমাদেরও খাওয়ার আগ্রহ ছিল; তাই আমরা খেলাম। নবীজি (সা.) বললেন, তোমরা এই রোজা অন্য দিন কাজা করে নেবে। (তিরমিজি)

রোজা রাখার নিষিদ্ধ দিবসসমূহ
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরবানির ঈদের দিন ও রোজার ঈদের দিন রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম)। হজরত নুবায়শা হুজালি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আইয়ামে তাশরিক (জিলহজ মাসের ৯ থেকে ১৩ তারিখ) হলো খাওয়া, পান করা ও আল্লাহর স্মরণ করার জন্য।’ (মুসলিম)। জিলহজ মাসের ৯ তারিখে আরাফাতে অবস্থানকারীরা রোজা রাখবেন না; অন্যরা রোজা রাখতে পারবেন।
বছরে পাঁচ দিন রোজা রাখা নিষেধ তথা নাজায়েজ ও হারাম। যথা: রোজার ঈদের দিন, কোরবানির ঈদের দিন ও তৎপরবর্তী তিন দিন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমরা এ দিবসগুলোতে রোজা রাখবে না। কারণ, এই দিনগুলো শুধুই পান, আহার ও খেল-তামাশার (আনন্দ-ফুর্তি উপভোগের) জন্য।

সতর্কতা
নফল রোজা রেখে ইফতার যেন মাগরিবের নামাজের জামাত ছুটে যাওয়ার কারণ না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। রমজান মাসে সবাই ফরজ রোজা পালন করেন বিধায়, সবার জামাতে অংশগ্রহণের সুবিধার্থে মাগরিবের নামাজের জামাত কিছুটা বিলম্বে আরম্ভ করা হয়। কিন্তু রমজান ছাড়া অন্য সময় যেহেতু মাগরিবের নামাজের জামাত বিলম্বিত হবে না; তাই মসজিদে পানি দিয়ে ইফতার করে জামাতে শামিল হওয়া বাঞ্ছনীয়।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
[email protected]