নফসের বিরুদ্ধে রোজাদারের জিহাদ

ধর্ম
ধর্ম

রোজা মানুষের নফস বা আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষে উন্নত ও আলোকিত করে দেয়। সিয়ামের দ্বারা রোজাদার নিজের ব্যক্তিসত্তা বা নফসকে ঘষে-মেজে ঝকঝকে বিধৌত করে তুলতে পারে। ‘নফস’ শব্দের অর্থ এককথায় প্রকাশ করা যায় না। প্রধানত মানুষের নিজস্বতা, ব্যক্তির সত্তা, আমিত্ব, প্রবৃত্তি প্রভৃতি অর্থেও নফস শব্দ ব্যবহৃত হয়। আত্মশুদ্ধির রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে ‘তাজিকায়ায়ে নফস’ সাধিত হয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই সাফল্য লাভ করবে, যে পবিত্রতা অর্জন করে এবং তার প্রতিপালকের নাম স্মরণ করে ও সালাত আদায় করে।’ (সূরা আল-আ’লা, আয়াত: ১৪-১৫)
ইলমে তাসাওউফে নফসকে অবস্থাভেদে ‘নফসে আম্মারা’, ‘নফসে লাওওয়ামা’, ‘নফসে মুতমাইন্না’, ‘নফসে মুলহিমা’ মোটামুটি এই চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ১. ‘নফসে আম্মারা’ হচ্ছে প্ররোচক ও প্রলুব্ধকারী প্রবৃত্তি, এককথায় বলা যায় কুপ্রবৃত্তি। এই নফস ব্যক্তিকে এমনভাবে বশীভূত করে যে ব্যক্তির নিজের ওপর কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তার প্রবৃত্তি যা আদেশ করে সে তা-ই সম্পাদন করে, এর ওপর শয়তানের প্রবল প্রভাব বিরাজমান থাকে। ফলে এ নফস ব্যক্তিসত্তাকে সব ধরনের অন্যায়, অপকর্ম ও মন্দ পথের দিকে ধাবিত করে। সোজা কথায় নফসে আম্মারায় আবেষ্টিত ব্যক্তিসত্তার মধ্যে এমন একটা মনোভাব থাকে যে পাপ আবার কী? নফসে আম্মারাধারী ব্যক্তি মৃত্যুর পর যে পুনরুত্থিত হয়ে শেষ বিচারের মুখোমুখি হতে হবে, তা যেন সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে থাকে।
২. ‘নফসে লাওওয়ামা’ হচ্ছে সেই নফস, যার গুনাহের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার প্রবণতা থাকলেও ভুল-ত্রুটি বা পাপকাজ করার পর আতঙ্কজনক জাগ্রত করে এবং মন্দকে ভর্ৎৎসনা করে। গুনাহ করে আত্মগ্লানির কারণে সে ব্যক্তি তওবা করে; কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না; ফলে আবার গুনাহ করে, আবার তওবা করে। এই নফস কিঞ্চিৎ পবিত্র। এর ভালো-মন্দ বোধশক্তি থাকে। ৩. ‘নফসে মুতমাইন্না’ হচ্ছে সেই নফস, যার মধ্যে পবিত্রতার সুরভি আছে এবং নুরানি তেজ আছে। এটাই হচ্ছে আলোকিত নফস। এ নফস সব সময় নেককাজ ও কল্যাণের দিকে মানুষকে ধাবিত করে। মন্দ ও অকল্যাণ এ নফসের কাছঘেঁষা হতে পারে না। এটাই হচ্ছে প্রশান্ত এবং জাগতিক চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে এক অনন্য শান্ত প্রবৃত্তি। হাক্কানি পীর-আওলিয়ারা সাধারণত এই নফসে উন্নীত হন। ৪. নফসে মুতমাইন্নায় উন্নীত নফস যখন পুণ্যে প্রেরণাদায়ক ও উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী হয় তখন আল্লাহ তাআলার গোপন ভেদ ও আদেশ তার ওপর প্রতিফলিত হয়, সে ইলহাম বা প্রত্যাদেশ লাভে ধন্য হয়। এই নফসকেই বলা হয় ‘নফসে মুলহিমা’।
মাহে রমজানে মাসব্যাপী যাবতীয় কামাচার, পানাহার, পাপাচার থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে সিয়াম সাধনা। রমজানের এক মাস সম্পূর্ণ দিবাভাগে এ বিরত থাকার নির্দেশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে নফসকে পরিচ্ছন্ন করার সুবর্ণ সুযোগ আসে। নফসের কামনা-বাসনা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখে সিয়াম সাধনার দ্বারা কুপ্রবৃত্তি দমনের মাধ্যমে রোজাদার তার জন্য চিরস্থায়ী ঠিকানা হিসেবে জান্নাত লাভের পথ উন্মুক্ত করে নেয়। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যে ব্যক্তি স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে; জান্নাতই হবে তার আবাস।’ (সূরা আন-নাজিয়াত, আয়াত: ৪০-৪১)

>মাহে রমজানে ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে সিয়াম পালন করার মাধ্যমে মানুষ পাপমুক্ত জীবন গড়ার প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করে

একবার সশস্ত্র যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনকালে নবী করিম (সা.) সাহাবায়ে কিরামকে বললেন: দেখো, আমরা ছোট যুদ্ধ থেকে বড় যুদ্ধের দিকে প্রত্যাবর্তন করছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছোট যুদ্ধ বলতে বুঝিয়েছেন তলোয়ার, বল্লম, তির ইত্যাদি অর্থাৎ সশস্ত্রযুদ্ধকে, যে যুদ্ধে মারামারি ও খুনোখুনি হয় আর বড় যুদ্ধ বা ‘জিহাদুল আকবর’ বলতে নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে বুঝিয়েছেন। তাই নফসের সঙ্গে যুদ্ধকে ‘জিহাদুল আকবর’ বা বড় যুদ্ধ বলা হয়। মাহে রমজানে সিয়াম পালন করাটাই সেই ‘জিহাদুল আকবর’। নফসকে যে ব্যক্তি কাবু রাখতে পারে প্রকৃতপক্ষে সে-ই প্রকৃত বীরের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে।
মানুষের প্রকাশ্য দুশমন শয়তান নফসের ওপর প্রভাব বিস্তার করে মানবজাতিকে বিপথে পরিচালিত করার কাজে সদা সক্রিয় থাকে। কিন্তু মাহে রমজান এলে শয়তান বিপাকে পড়ে যায়। সে প্রকৃত রোজাদারকে কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনার ফাঁদে আটকাতে ব্যর্থ হয়। রোজাদার এমন দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে সব ধরনের পানাহার, কামাচার ও পাপাচার থেকে নিজেকে বিরত রাখেন যে শয়তান রোজাদারের দৃঢ়প্রত্যয়ের দেয়াল ভেদ করে তার নফসের ওপর কোনোভাবেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।
শয়তান তখন বন্দিদশা লাভ করে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মাহে রমজান এলে আকাশের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শয়তানদের শিকলে আবদ্ধ করে দেওয়া হয়।’ অন্য এক বর্ণনায় আছে, ‘যখন রমজান আসে তখন জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়।’ (বুখারি)
সিয়াম সাধনায় মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ষড়্রিপু অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য দমিত করে। ফলে প্রকৃত রোজাদারের দ্বারা কোনো ধরনের অনৈতিক, অশোভন ও অপকর্ম সাধিত হতে পারে না। সিয়াম সাধনা রোজাদারকে পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতার সৌরভে সুরভিত করে দেয়। মাহে রমজানে ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে সিয়াম পালন করার মাধ্যমে মানুষ পাপমুক্ত জীবন গড়ার প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করেন। রোজা পালন করার মধ্য দিয়ে আল্লাহর নির্দেশ পালন করার প্রকৃত প্রশিক্ষণ লাভ হয় এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হালাল-হারাম বেছে চলার বাস্তব শিক্ষা অর্জিত হয়।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]