
‘জন্মাষ্টমী’ হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উৎসব। সারা পৃথিবীর হিন্দুরা সাড়ম্বরে এ জন্মাষ্টমী উৎসব উদ্যাপন করে থাকে। আক্ষরিক অর্থে জন্মাষ্টমী বলতে বোঝায় জন্মের সঙ্গে জড়িত অষ্টমী তিথি। কার জন্ম? ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম। দ্বাপর যুগে এক ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে নিরাকার পরমব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। পরমব্রহ্মের অবতাররূপে আবির্ভূত হওয়ার কারণ হচ্ছে সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্টের বিনাশ এবং ধর্ম অর্থাৎ ন্যায় প্রতিষ্ঠা। এককথায় মানুষ ও জগতের কল্যাণ।
কখনো কখনো দেশ অনাচারে ভরে যায়। এমনকি রাজশক্তিও রাজধর্ম ভুলে গিয়ে হয়ে ওঠে প্রজাপীড়ক ও অত্যাচারী। তখন তাদের দমন করার জন্য দরকার প্রচণ্ড শক্তির বা শক্তিমানের। পরমব্রহ্ম সর্বশক্তিমান। তাই তাঁকেই দায়িত্ব নিতে হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর তো সর্বশক্তিমান। তিনি ভগবান—কৃপাময়। অসীম তাঁর শক্তি ও মাহাত্ম্য। তিনি তো তাঁর অবস্থানে থেকেই অবলীলায় দুষ্টের দমন করতে পারেন। নিশ্চয়ই পারেন। তবে পরমব্রহ্ম লোকশিক্ষকও বটেন। তিনি লোকশিক্ষা দিতে চান। তাই লোকশিক্ষা দিতে তিনি বারবার নানা রূপ ধরে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। আমাদের মতোই একজন হয়ে, জীব হয়ে জন্ম নেন। দেখাতে চান, মানুষেরও শক্তি আছে। মানুষও পারে প্রচণ্ড শক্তিতে অত্যাচারীকে দমন করতে, তাকে সমুচিত শাস্তি দিতে। ত্রেতা যুগে পরমব্রহ্ম রামরূপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তার পরেকার যুগ—দ্বাপর যুগে তিনি অবতীর্ণ হলেন শ্রীকৃষ্ণরূপে।
দ্বাপর যুগে তখনকার ভারতবর্ষে কয়েকজন রাজা খুব অত্যাচারী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মগধের রাজা জরাসন্ধ, চেদিরাজ শিশুপাল, মথুরার রাজা কংসসহ অনেকে। তাঁদের অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য পরমব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণরূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মথুরার রাজা কংসের কথাই ধরা যাক। কংস নিজের পিতা উগ্র সেনকে কারাগারে বন্দী করে অধিকার করেন মথুরার রাজসিংহাসন। প্রজাদের ওপরও চালান উৎপীড়ন। কংসের কাকা দেবক। তাঁর কন্যা দেবকী। সুতরাং দেবকী সম্পর্কে কংসের কাকাতো বোন। তবে কাকাতো বোন হলেও কংস তাঁকে সহোদরার মতোই স্নেহ করতেন। শূর বংশীয় বসুদেবের সঙ্গে দেবকীর বিয়ে হয়। বসুদেবের সঙ্গে দেবকী যখন প্রথম শ্বশুরবাড়ি যাবেন, তখন কংস নিজেই রথ চালিয়ে তাঁদের পৌঁছে দিতে যান। কিন্তু পথে দৈববাণী শুনতে পান কংস। সে দৈববাণীর মর্ম হলো, দেবকীর গর্ভজাত অষ্টম পুত্রসন্তান কংসকে হত্যা করবে। ভাগনের হাতে মৃত্যু! এ ভবিতব্য সংঘটিত হতে দেওয়া যায় না। তখন কংস তরবারি কোষমুক্ত করে দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হন। বসুদেব দেবকীকে রক্ষা করার জন্য কংসকে বলেন যে সন্তানের কারণেই তো ভয়! তাঁদের সন্তান হওয়ামাত্র তাঁরা সে সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দেবেন। যুক্তিটি কংসের কাছে মন্দ লাগে না। তিনি দেবকীকে হত্যা না করলেও প্রথমে গৃহবন্দী করে রাখেন, পরে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। দেবকীর অষ্টম গর্ভজাত পুত্রসন্তানরূপে পরমব্রহ্ম আবির্ভূত হন। তাঁর নাম রাখা হয় কৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণ কংসকে হত্যা করেন। মামা বলে ক্ষমা করেন না। এ থেকে আমরা একটা শিক্ষা পাই: পাপী পাপীই। আত্মীয় বলে তাকে ক্ষমা করা উচিত নয়। এ ক্ষেত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে ওঠার আদর্শ অনুসরণ করার শিক্ষা দিলেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসরাজকে হত্যা করে মথুরা অধিকার করেন। কিন্তু সে অধিকৃত রাজ্য তিনি উগ্রসেনকে দিয়ে দেন। এর মধ্য দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের নিষ্কাম কর্মের শিক্ষা দিলেন। দিলেন ক্ষমতার মোহ ত্যাগ করার শিক্ষা।
দ্বাপর যুগে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা কুরুক্ষেত্রে কাকাতো-জেঠতুতো ভাইদের মধ্যে যুদ্ধ। সে যুদ্ধ মহাযুদ্ধে রূপ নেয়। এক পক্ষে পাণ্ডুপুত্র পঞ্চপাণ্ডব—যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব। অপরপক্ষে ধৃতরাষ্ট্রের দুর্যোধন, দুঃশাসনসহ শত পুত্র। এ যুদ্ধে ভারতবর্ষের রাজন্যবর্গ কেউ পাণ্ডবদের পক্ষে, কেউ দুর্যোধনাদি কৌরবদের পক্ষে অংশ নেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজে অংশ নেন পাণ্ডবদের পক্ষে নিরস্ত্রভাবে অর্জুনের রথের সারথি হিসেবে। কারণ, তাঁরা ধর্মযুদ্ধ করছিলেন। দুর্যোধনেরা অন্যায়ভাবে রাজ্যের অধিকার নিজেদের করায়ত্ত রেখেছিলেন। যুদ্ধ শুরুর সময়ে পাণ্ডবপক্ষের অর্জুন যখন আত্মীয়দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাইছিলেন না—তা ছাড়া যুদ্ধে প্রচুর লোকক্ষয় ঘটবে—ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন কর্তব্যকর্ম সাধন করার উপদেশ দিলেন অর্জুনকে। দিলেন নিষ্কাম কর্মের শিক্ষা। মহাভারতে সে উপদেশবাণী উজ্জ্বল হয়ে আছে। আর এ অংশটি ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ নামে পৃথক গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। এ উপদেশবাণী মানুষের চলার পথে, কর্তব্য-অকর্তব্য নির্ধারণে, অবিচল ভক্তিতে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে সহায়ক।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের পিসতুতো ভাই চেদিরাজ শিশুপালকেও হত্যা করেন। তিনিও দুর্বৃত্ত হয়ে উঠেছিলেন। মগধরাজ জরাসন্ধকেও তিনি দমন করেছিলেন। এগুলো সব দুষ্টের দমনের দৃষ্টান্ত। আবার তাঁর মধ্যে ছিল দরিদ্রের প্রতি মমত্ববোধ এবং সবার প্রতি সমদর্শিতা। তাঁর দরিদ্র জ্ঞানী সহপাঠী সুদামা দারিদ্র্যের কারণে তাঁর কাছে কিছু চাইতে গিয়েছিলেন, যাতে দারিদ্র্য দূর হয়ে যায়। কিন্তু সুদামা লজ্জায় কিছু চাইতেই পারলেন না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সরাসরি কিছু না দিয়ে বন্ধুকে খালি হাতেই বিদায় জানিয়েছিলেন। এদিকে সুদামা ফিরে এসে দেখেন তাঁর পর্ণকুটির নেই, সেখানে এক প্রাসাদ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে দিয়ে সেই বাড়ি নির্মাণ করিয়েছিলেন। সুদামাকে দিয়েছিলেন অঢেল ধনসম্পদ—যাতে তিনি নিশ্চিন্তে জ্ঞানের সাধনা চালিয়ে যেতে পারেন। এখানেও একটি লোকশিক্ষার পরিচয় পাওয়া যায়। তা হলো: সামনাসামনি দান করে দানের গর্ব প্রকাশ না করা। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, দাতাকে উদ্ধত অহংকারী নয়, তাঁকে বিনয়ী হতে হয়।
এক রূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চক্রধারী কঠোর, আরেক রূপে তিনি কুসুম কোমল, দীনবন্ধু—করুণা সিন্ধু। শুভ জন্মাষ্টমীতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপা সবার ওপর বর্ষিত হোক।
অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অনারারি প্রফেসর।