ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত নিরসনে ইসলামের শিক্ষা

.
.

সমগ্র সৃষ্টিজগতের শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান ইসলামের লক্ষ্য। কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই
ভাই; সুতরাং তোমরা ভ্রাতৃগণের মধ্যে শান্তি স্থাপন করো আর আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও।’ (সূরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১০)।
হাদিস শরিফে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: মুসলমান মুসলমানের ভাই। তাই তোমরা পরস্পরকে হিংসা কোরো না, ঈর্ষান্বিত হয়ো না, কারও পেছনে লাগবে না; এবং তোমরা এক আল্লাহর দাস হয়ে যাও এবং হয়ে যাও একে অপরের ভাই।’ (বুখারি: ৫৬৩৮)।
দ্বীন বা ধর্ম কী? দ্বীন বা ধর্মের উদ্দেশ্য কী? হাদিস শরিফে আছে: ‘কল্যাণ কামনাই দ্বীন।’ (বুখারি ও মুসলিম)। কারও কল্যাণ চাইলে
তার সংশোধনের জন্য যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, তাতে থাকতে হবে মহব্বত (প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা), আযমত (সম্মান করা), হিকমত (কৌশল অবলম্বন করা), খিদমাত (সেবা প্রদান করা)।
নবী করিম (সা.) মুসলিম উম্মাহকে একটি মানবদেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এটা সেই তুলনার সঙ্গেও সাদৃশ্যমান, যেখানে উম্মাহকে একটি প্রাসাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে তোলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন: ‘প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই, কেউ কারও ক্ষতি করে না বা অন্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।’ (বুখারি)।
মানবভ্রাতৃত্বের পাশাপাশি ইসলাম বিশ্বাসের ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তির সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আল-কোরআনে এক মুসলমানকে অন্য মুসলমানের বন্ধুরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে এই বলে যে ‘মুমিন নর ও মুমিনা নারী একে অপরের বন্ধু, তারা সৎকাজে আদেশ করে, মন্দকাজে নিষেধ করে এবং নামাজ কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে। সর্বোপরি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য করে; অচিরেই আল্লাহ তাদের প্রতি রহম করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা পরাক্রমশালী, মহা কৌশলী।’ (সূরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৭১)।
অহিংসা, মৈত্রী ও শান্তি হলো মহানবী (সা.)-এর মহতী দর্শন। ধৈর্য, সহনশীলতা, সমবেদনা, সহমর্মিতা, সহানুভূতি এবং ক্ষমা, দয়া, স্নেহ, মায়া, মমতা, প্রেম, প্রীতি ইত্যাদি ছিল তাঁর মহান আদর্শ। পরোপকার, কল্যাণকামিতা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল তাঁর কর্মালংকার। আর এটাই হলো ইসলাম। হাদিস শরিফে আরও আছে: ‘রাসুল (সা.) বলেন, যে সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আমাদের কিবলাকে অনুসরণ করে, আমাদের মতো নামাজ (স্বীকার) করে ও আমাদের (মুসলমানদের) জবাই করা প্রাণী আহার করে (হালাল মনে করে); তবে সে মুসলিম, তার জন্য তা-ই, যা মুসলমানের জন্য এবং তার বিরুদ্ধেও তা-ই, যা মুসলমানের বিরুদ্ধে।’ (বুখারি শরিফ)।
মতবিরোধের ক্ষতি ও শান্তি–শৃঙ্খলার অবনতির পরিণাম কুফর-শিরকের চেয়েও ক্ষতিকর; এটা বোঝা যায় আল্লাহ তাআলার নবী ও রাসুল হজরত হারুন (আ.)-এর অবস্থান থেকে। হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর নির্দেশে ৩০ দিনের জন্য তুর পাহাড়ে যান তাওরাত কিতাব আনার জন্য। সেখানে তিনি আল্লাহর আদেশে ৪০ দিন অবস্থান করেন। এ সময় তাঁর ভাই হজরত হারুন (আ.)-কে কওমের কাছে রেখে যান। পূর্বনির্ধারিত ৩০ দিনের বেশি আরও ১০ দিন বিলম্ব হওয়ার সুবাদে ছামেরি নামের এক জাদুকর সোনা দিয়ে গো-বাছুর তৈরি করে। বনি ইসরাইল এই গো–বাছুরের পূজা শুরু করে দেয়। নবী হারুন (আ.) এই মারাত্মক বিকৃতি সম্বন্ধে বারণ করলেও কঠোরতা অবলম্বন করেননি। হজরত মুসা (আ.) ফিরে এসে তাঁর সম্প্রদায়ের ওই গোমরাহির কথা জেনে তাঁর ভাইকে বললেন: ‘হে হারুন! তুমি যখন দেখলে তারা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে, তখন তোমাকে কিসে নিবৃত্ত করল আমার পদাঙ্ক অনুসরণ করা থেকে? তবে কি আমার আদেশ অমান্য করলে?’ (সূরা-২০ তহা, আয়াত: ৯২-৯৩)। উত্তরে হারুন (আ.) বললেন: ‘হে আমার সহোদর! আমার দাড়ি ও চুল টেনো না। আমি আশঙ্কা করেছিলাম যে তুমি বলবে, তুমি বনি ইসরাইলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ এবং তুমি আমার কথা পালনে যত্নবান হওনি।’ (সূরা-২০ তহা, আয়াত: ৯৪)। এখানে লক্ষ করা যায় যে হারুন (আ.) প্রধান নেতা ফিরে না আসা পর্যন্ত দলের
ঐক্য ধরে রাখার নিমিত্তে কওমের গোমরাহির মতো কাজেও কঠোরভাবে বাধা না দিয়ে ঐক্য বজায় রেখেছেন, যাতে কেউ বলতে না পারে যে তিনি দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করেছেন।
দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধের শান্তিপূর্ণ উপায় এবং প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সুন্নতি পদ্ধতি উত্তম কর্ম দ্বারা প্রতিবিধান করা। আল্লাহপাক নবী-রাসুলদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচার করিয়েছেন। তাঁরা যদি শৌর্য-বীর্যে বলীয়ান হতেন অথবা রাজশক্তিতে শক্তিমান হতেন, তাহলে বলা যেতে পারত ইসলাম শক্তির বলে প্রচার-প্রসার লাভ করেছে। কিন্তু আল্লাহ ধনসম্পদহীন নবীদের দ্বারা দুনিয়ার বুকে ইসলাম জিন্দা রেখেছেন। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ভালো ও মন্দ সমান হবে না (হতে পারেও না); তুমি প্রতিরোধ করো (মন্দকে) যেভাবে উত্তম; তবে তোমার সঙ্গে যার শত্রুতা রয়েছে; সে–ও যেন পরম বন্ধু হবে।’ (আল-কোরআন, পারা: ২৪, পৃষ্ঠা: ৪৮১ / ১৯ হা. , সূরা-৪১ হা মীম সাজদাহ/ফুচ্ছিলাত, আয়াত: ৩৪)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরও বলেন, ‘তোমরা মন্দকে প্রতিরোধ করো যা উত্তম তার মাধ্যমে; আমি নিশ্চিত জানি যা তারা সংজ্ঞায়িত করে।’ (সূরা-২৩, মুমিনুন, আয়াত: ৯৬)।
ইসলাম চায় পৃথিবীতে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত হোক। এ জন্য যুদ্ধের বিকল্প অনুসন্ধান করে। যেখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা যায়, তা দূর করতে যুদ্ধের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ উপায় খোঁজে; যুদ্ধরত পক্ষগুলোর মধ্যে মীমাংসা করতে চায়। এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে ইসলাম শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের পরিপন্থী কোনো কাজ পছন্দ করে না এবং সেগুলো দূর করতেও চরমপন্থা গ্রহণ করে না। এ থেকে আরও একটি কথা প্রমাণিত হয়, ইসলামি শরিয়ার সব বিধিবিধানই বিশ্ববাসীর জন্য শান্তিপূর্ণ ও কল্যাণকর।
প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ না করে সন্ধিতে আবদ্ধ হওয়া মহানবী (সা.)-এর শান্তিকামিতার আরও একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তিনি শান্তি স্থাপনের জন্য হুদাইবিয়ার সন্ধি করেছেন; এ ছাড়া আরও বহু সন্ধিতে আবদ্ধ হয়েছেন। বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) সারা জীবন এই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন।
ইসলাম শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। ইসলাম কখনোই অনর্থক দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে সমর্থন করে না। তাই শান্তির দূত রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান, পৌত্তলিকসহ নানা ধর্মের ও নানা বর্ণের লোকদের নিয়ে একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করলেন, যা জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মানবিক ও ধর্মীয় অধিকার নিশ্চিত করে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করেছিল। মদিনায় বসবাসরত সব গোত্রের মধ্যে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি সনদ বা সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে মদিনা সনদ নামে পরিচিত; এটি একটি ঐতিহাসিক চুক্তি। এ চুক্তির নানামুখী উদ্দেশ্যের একটি ছিল যুদ্ধের পরিবর্তে পরস্পরের শান্তিপূর্ণ অবস্থান। এ চুক্তির আরও উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচারিত-নিপীড়িতকে সাহায্য করা এবং চুক্তিভুক্ত সব পক্ষের মান, মর্যাদা ও ধর্মবিশ্বাসের অধিকার সংরক্ষণ করা। ইসলাম যে শান্তি চায়, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো এই মদিনা সনদ। ‘মদিনা সনদ’ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন সাধন করে। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নৈরাজ্য, সংঘাত, যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করে যুদ্ধবাজ গোত্রগুলোর মধ্যে সংঘাতের পরিবর্তে গড়ে তোলে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন।
সংঘাত এড়ানো ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হলো কারও অনুভূতিতে আঘাত না করা। সে যে ধর্মের বা যে মতেরই অনুসারী হোক না কেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদিগকে তারা ডাকে, তাদিগকে তোমরা গালি দিয়ো না।’ (সূরা-৬ আনআম, আয়াত: ১০৮)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন; মুসলমানকে গালি দেওয়া ফাসিকি এবং হত্যা করা কুফরি। (বুখারি, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৮৯৩)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক: আহছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
[email protected]