
যাবুর কিতাব কোন ধর্মের
রমজান মাসের ১২ তারিখে আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.)-এর কাছে আসমানি কিতাব ‘যাবুর’ নাজিল করা হয়। তাঁর গোত্রের মাতৃভাষা ছিল ইউনানি, তাই ‘যাবুর’ ইউনানি বা আরামাইক ভাষায় অবতীর্ণ হয়। নবী-রাসুলদের কাছে মাতৃভাষায় ওহি নাজিল না করা হলে এগুলো অবতরণের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতো।
কেননা, এসব আসমানি কিতাব অবতরণের মূল উদ্দেশ্য মানুষের হেদায়াতপ্রাপ্তি ও পুণ্য অর্জনের জন্য এর সঠিক মর্ম অনুধাবন করা এবং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ঐশীগ্রন্থের আলোকে জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি তোমার কাছে ওহি প্রেরণ করেছি, যেমন নূহ ও তার পরবর্তী নবীদের কাছে প্রেরণ করেছিলাম; ইব্রাহিম, ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাঁর বংশধরগণ; ঈসা, আইউব, ইউনুস, হারুন ও সোলায়মানের কাছে ওহি প্রেরণ করেছিলাম এবং দাউদকে যাবুর দিয়েছিলাম।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৬৩) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি তো নবীদের কতককে কতকের ওপর মর্যাদা দিয়েছি এবং দাউদকে যাবুর দিয়েছি।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত: ৫৫)
হজরত দাউদ (আ.)-এর ঊর্ধ্বতন একাদশ পুরুষ হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর দুজন স্ত্রী ছিলেন। বিবি হাজেরার গর্ভজাত সন্তান হজরত ইসমাইল (আ.)-এর বংশধারায় পৃথিবীতে শুভাগমন করেন বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) [৫৭০-৬৩২ খ্রি.]; আর বিবি সারার গর্ভের সন্তান হজরত ইসহাক (আ.)-এর বংশধারায় হজরত দাউদ (আ.) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জালুত নামক অত্যাচারী রাজাকে ভীষণ যুদ্ধে পরাজিত ও হত্যা করে এক বিশাল রাজত্ব লাভ করেন, যাঁর রাজধানী ছিল জেরুজালেম।
এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে, ‘দাউদ জালুতকে সংহার করল, আল্লাহ তাকে কর্তৃত্ব এবং হিকমত দান করলেন এবং যা তিনি ইচ্ছা করলেন তা তাকে শিক্ষা দিলেন।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫১) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘স্মরণ করো, আমার শক্তিশালী বান্দা দাউদের কথা, সে ছিল অতিশয় আল্লাহ অভিমুখী।’ (সূরা সোয়াদ, আয়াত: ১৭)
হজরত দাউদ (আ.) নানাবিধ মানবিক গুণে ভূষিত ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সুমধুর কণ্ঠস্বর দান করেছিলেন যে সুললিত ভাষায় তিনি ‘যাবুর’ তিলাওয়াত করতেন। তাঁর পাঠ শুনে বনের পক্ষিকুল নেমে আসত এবং মনোযোগসহকারে তা শুনত। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন, ‘আমি তার রাজ্যকে সুদৃঢ় করেছিলাম এবং তাকে দিয়েছিলাম প্রজ্ঞা ও ফয়সালাকারী বাগ্মিতা।’ (সূরা সোয়াদ, আয়াত: ২০) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আমি অবশ্যই দাউদ ও সোলায়মানকে জ্ঞান দান করেছিলাম। তারা বলেছিল, ‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের তাঁর বহু মুমিন বান্দাদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন।’ (সূরা আন-নামল, আয়াত: ১৫)
আল্লাহ তাআলা হজরত দাউদ (আ.)-কে অনেক মুজিজা বা অলৌকিক ক্ষমতা দান করেছিলেন। তিনি লোহা দিয়ে সুন্দর সুন্দর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বানাতেন। হজরত দাউদ (আ.)-এর পুত্র হজরত সোলায়মান (আ.) পিতার রাজত্ব আরও সুবিস্তৃত ও সমৃদ্ধশীল করে তুলেছিলেন। হজরত দাউদ (আ.) বায়তুল মোকাদ্দাসে তাঁর আমলের রাজধানী স্থাপন করেন এবং একটি বিশাল ইবাদতখানা নির্মাণে হাত দেন, যা হজরত সোলায়মান (আ.) কর্তৃক জিনদের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। এভাবে বায়তুল মোকাদ্দাসের পবিত্রতার মর্যাদা বাস্তবরূপ লাভ করে।
এরপর হজরত ঈসা (আ.)-এর সময় থেকে তাঁর অনুসারীদের স্বাক্ষর এবং মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাস পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হতে থাকে। কোরআন মজিদে বায়তুল মোকাদ্দাসকে পবিত্র ভূমি বলে উল্লেখ করা বলা হয়েছে, ‘হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহ তোমাদের জন্য যে পবিত্র ভূমি নির্দিষ্ট করেছেন, তাতে তোমরা প্রবেশ করো এবং পশ্চাদপসরণ কোরো না, তাহলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ২১)
হজরত দাউদ (আ.) ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ। তিনি ছিলেন সুশাসক ও সুবিচারক। জনগণ সব সময় তাঁর কাছ থেকে ন্যায়বিচার পেত। তাঁর বিচারব্যবস্থা ছিল নিখুঁত ও নিরপেক্ষ। তিনি রাজকোষ থেকে কোনো অর্থসম্পদ গ্রহণ করতেন না। তিনি যেমন ছিলেন ন্যায়পরায়ণ ও মানবদরদি, তেমনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন এবং নিজের হাতে লৌহবর্ম তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি আল্লাহর কুদরতে লোহাকে নরম করে এর দ্বারা ইস্পাতের জেরা বা বর্ম তৈরি ও তা বাজারে বিক্রি করে যা আয় করতেন, তা দিয়ে সংসার চালাতেন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আমি নিশ্চয়ই দাউদের প্রতি অনুগ্রহ করেছিলাম এবং আদেশ করেছিলাম, ‘হে পর্বতমালা! তোমরা দাউদের সঙ্গে আমার পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং বিহঙ্গকুলকেও, তার জন্য নমনীয় করে দিয়েছিলাম লৌহ; যাতে তুমি পূর্ণ মাপের বর্ম তৈরি করতে পারো এবং বুননে পরিমাণ রক্ষা করতে পারো।’ (সূরা সাবা, আয়াত: ১০-১১)
নবী করিম (সা.) শ্রমের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে হজরত দাউদ (আ.)-এর স্বহস্তে উপার্জনের বিষয়টি উল্লেখ করে মানুষকে উৎসাহিত করেছেন, ‘নিজের হাতের কাজ ও শ্রম দ্বারা উপার্জিত খাদ্য খাওয়া অপেক্ষা উত্তম খাদ্য কেউ খেতে পারে না।
হজরত দাউদ (আ.) নিজের হাতের শ্রমের উপার্জিত খাবার খেতেন।’ (বুখারি) হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে যে ‘হজরত দাউদ (আ.) বর্ম তৈরি করতেন, হজরত আদম (আ.) কৃষিকাজ করতেন, হজরত নূহ (আ.) কাঠমিস্ত্রির কাজ করতেন, হজরত ইদ্রিস (আ.) সেলাইয়ের কাজ করতেন এবং হজরত মূসা (আ.) রাখালের কাজ করতেন।’ (মুসতাদরাকে হাকিম)
আসমানি কিতাব ‘যাবুর’প্রাপ্ত আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.)-এর যুগেও রোজার প্রচলন ছিল।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হজরত দাউদ (আ.)-এর রোজা। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন এবং এক দিন বিনা রোজায় থাকতেন।’ (বুখারি ও মুসলিম) অর্থাৎ হজরত দাউদ (আ.) অর্ধেক বছর রোজা রাখতেন এবং অর্ধেক বছর বিনা রোজা থাকতেন, তিনি এক দিন অন্তর অন্তর সিয়াম পালন করতেন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]