রমজানে শবে কদরের সন্ধানে

একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতদের ইবাদত-বন্দেগির বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। একপর্যায়ে তিনি বললেন, বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তি হাজার বছর দিনে জিহাদে ও রাতে নফল ইবাদত করে কাটিয়েছেন। তখন সাহাবায়ে কিরাম পরস্পর আলোচনা করছিলেন যে আগেকার উম্মতদের কত সৌভাগ্য! তাঁরা হায়াতও বেশি পেয়েছেন, আমলও বেশি করেছেন, আর আমাদের হায়াতও কম আমলও কম। আমাদের আয়ু কম হওয়ায় আমরা আমলের দিক দিয়ে তাঁদের থেকে অনেক পেছনে পড়ে গেলাম। তখন আল্লাহ তাআলা সুরা কদর নাজিল করলেন। এ সুরায় আল্লাহ পাক উম্মতে মুহাম্মাদি (সা.)-কে সুসংবাদ দিলেন যে কোনো উম্মত যদি জীবনে শবে কদর শুধু একবার পেয়ে যায় এবং ওই রাতকে যথাযথ কদর করে ও ইবাদত করে, তাহলে সে যেন হাজার মাসের (তিরাশি বছর চার মাসের) চেয়ে অধিককাল ইবাদত করল।
শবে কদর কবে? এ নিয়ে গবেষকদের মাঝে মতভেদ রয়েছে, অধিকাংশ উলামায়ে কিরামের মতানুসারে, পবিত্র রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতসমূহে সে মহিমান্বিত রাত শবে কদর। রাসুলুল্লাহ (সা.) শবে কদর খুঁজতে রমজানের প্রথম ১০ দিন ইতিকাফ করলেন, তাতে তিনি লাইলাতুল কদর পাননি। অতঃপর দ্বিতীয় ১০ দিন ইতিকাফ করলেন, তাতেও তিনি পাননি। পরিশেষে শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করলেন এবং তিনি শবে কদর পেলেন।
একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) শবে কদরের তারিখ জানানোর উদ্দেশ্যে হুজরা থেকে বের হলেন। বের হয়ে দেখেন দুই ব্যক্তি ঝগড়া করছেন, এতে তিনি মনঃক্ষুণ্ন হলেন এবং তাঁর স্মৃতি থেকে লাইলাতুল কদরের সুনির্দিষ্ট তারিখটি উধাও হয়ে গেল। তিনি আর তারিখটি বলতে পারেননি। নিশ্চয় তাতেও মঙ্গল নিহিত রয়েছে। তারিখ নির্দিষ্ট হয়ে গেলে মানুষ হয়তো নির্দিষ্ট এক রাতেই ইবাদত করত। অতঃপর তিনি (সা.) বলেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতসমূহে শবে কদর খোঁজ কর। (বুখারি ও মুসলিম)।
রাসুলুল্লাহ (সা.) শেষ ১০ দিনে ইতিকাফরত থেকে নিজেও খুব বেশি ইবাদত-বন্দেগিতে নিমগ্ন থাকতেন এবং পরিবার-পরিজনদেরও রাত জেগে ইবাদত করার জন্য উৎসাহিত করতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শেষ ১০ দিনের আমল সব গৃহকর্তার জন্য এক আদর্শ নমুনা। সাধারণত দেখা যায়, পরিবারের প্রধান ইবাদতে মশগুল থাকেন, আর পরিবারের অন্য সদস্যরা কোথায় আছেন, কী করছেন, সে দিকে গৃহকর্তার কোনো খেয়াল থাকে না। এমনটি যেন না হয় সে দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। লাইলাতুল কদর বছরের সর্বোত্তম রাত, এ রাত অন্য সময়ের হাজার মাসের থেকেও উত্তম; খুবই ফজিলতপূর্ণ এ রাত; এ রাতের সন্ধান করা মুস্তাহাব।
হাদিসে আছে, নবীজি (সা.) বলেন, যদি তোমরা তোমাদের কবরকে আলোকময় পেতে চাও, তবে তোমরা শবে কদরে জাগ্রত থেকে ইবাদত করো। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)–কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! যদি আমি জানতে পারি কোন রাত লাইলাতুল কদর, তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী চাইব? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন; তুমি বলবে, ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’ (ইবনে মাজা, সহিহ-আলবানি)।
ভাড়া করা লোক দিয়ে ইতিকাফ
আজকাল কোনো কোনো মসজিদে দেখা যায় ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদিম তাঁরা ইতিকাফ করছেন না; মসজিদ কমিটির সভাপতি, সেক্রেটারি ও সদস্যরাও ইতিকাফ করছেন না; এমনকি স্থানীয় মুসল্লিদের কেউই ইতিকাফ করছেন না; বরং বাইরে থেকে ভাড়া করে কাউকে এনে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে ইতিকাফ করান। এতে ইতিকাফের লক্ষ্য অর্জন হয় না। এটি আত্মপ্রতারণা ও প্রবঞ্চনার শামিল।
ইতিকাফ অবস্থায় চিকিৎসা
কোনো ডাক্তার যদি ইতিকাফ করেন, এমতাবস্থায় মসজিদে অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখে বা রোগীর অবস্থার বিবরণ শুনে চিকিৎসা করতে পারবেন বা ব্যবস্থাপত্র লিখে দিতে পারবেন। সে রোগী ইতিকাফে অবস্থানকারী হোক বা না হোক। এটি ইতিকাফের পরিপন্থী নয়; বরং এতে বেশি নেকি লাভ হবে। কিন্তু এর জন্য কোনো ফি বা বিনিময় গ্রহণ করা যাবে না; তবে কেউ নিঃশর্ত হাদিয়া প্রদান করলে তা গ্রহণ করা জায়েজ। (ফাতাওয়া দারুল উলুম)।
ইতিকাফ অবস্থায় আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া ও হাজিরা দেওয়ার জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া।
কোনো ইতিকাফকারীর যদি রমজানের শেষ দশকে মামলার হাজিরা দেওয়ার বা সাক্ষ্য দেওয়ার তারিখ থাকে এবং উক্ত তারিখে তাঁর আদালতে উপস্থিতি জরুরি হয়, তাহলে ইতিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারবেন, এতে গুনাহ হবে না; তবে সুন্নত ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। এই ইতিকাফ পরে কাজা আদায় করতে হবে।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
[email protected]