রমজান ও তারাবির নামাজ

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো সালাত বা নামাজ এবং আরেকটি হলো সওম বা রোজা। তাই রোজার সঙ্গে নামাজের সম্পর্ক সুগভীর। প্রিয় নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন: ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করেছে, আর আমি তোমাদের জন্য তারাবির নামাজকে সুন্নত করেছি; অতএব যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের আশায় রমজানে দিনে রোজা পালন করবে ও রাতে তারাবির নামাজ আদায় করবে, সে গুনাহ থেকে এমন পবিত্র হবে যেমন নবজাতক মাতৃগর্ভ থেকে (নিষ্পাপ অবস্থায়) ভূমিষ্ঠ হয়। (নাসায়ি শরিফ, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২৩৯)।

তারাবির নামাজের ফজিলত

রমজান মাসের সওগাত লাভের জন্য বিশেষ ইবাদত হলো তারাবির নামাজ। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের উদ্দেশ্যে রমজান মাসে রাত জেগে তারাবির নামাজ আদায় করবে, তার অতীতের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩০, হাদিস: ৩৬; ই. ফা.)।

তারাবি শব্দের অর্থ

তারাবি শব্দটি বহুবচন, এর একবচন হলো তারবিহাহ; যার আভিধানিক অর্থ হলো বিশ্রাম ও প্রশান্তি। ‘রমজান মাসে এশার নামাজের পর যে সুন্নত নামাজ কায়েম করা হয়, তা হলো তারাবির নামাজ।’ (কামুসুল ফিকাহ)। যেহেতু প্রতি চার রাকাত পরপর বিরতির মাধ্যমে বিশ্রাম নেওয়া হয়, তাই এ নামাজের এ নামকরণ করা হয়েছে।

তারাবির নামাজের বিধান

তারাবির নামাজ ২০ রাকাত সুন্নতে মুআক্কাদাহ। পুরুষদের জামাতে আদায় করা সুন্নত। তারাবির নামাজে কোরআন শরিফ খতম করা সুন্নত। নারীদের জন্যও ২০ রাকাত সুন্নত। এশার নামাজের পর থেকে ফজরের নামাজের পূর্ব পর্যন্ত।

তারাবির নামাজ সম্পর্কিত কতিপয় হাদিস

ইবনে রুমান (রা.) বলেন, হজরত উমর (রা.)-এর খিলাফতের সময় মানুষ ২৩ রাকাত (বিতিরসহ তারাবির নামাজ) পড়ত। (মুআত্তা মালিক, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১১০, হাদিস: ২৮১; আবু দাউদ, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৬৯৯, হাদিস: ৪২৮৯)। হাসান (রা.) বলেন, ‘হজরত উমর (রা.) মানুষকে একত্র করলেন হজরত উবাই ইবনে কাআব (রা.)-এর পেছনে; তখন তিনি তাদের ইমামতি করে ২০ রাকাত নামাজ পড়তেন।’ (আবু দাউদ, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৬৫, হাদিস: ১৪২৯)।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, মহানবী (সা.) ২০ রাকাত তারাবির নামাজ পড়তেন এবং বিতির। (মাকতাবাতু ইবনে তাইমিয়া, খণ্ড: ১১, পৃষ্ঠা: ৩৯৩, হাদিস: ১৬১০৬)। আবুজার গিফারি (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমামের সঙ্গে তারাবির নামাজ পড়ল ইমাম প্রস্থান করা পর্যন্ত; তার কিয়ামে লাইল (রাত জাগার সওয়াব পূর্ণরূপে) লিখিত হবে। (তিরমিজি, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ১৬১-১৬৯, হাদিস: ৮০৬)।

মোল্লা আলী কারি (রা.) বলেন, তারাবির নামাজ ২০ রাকাত, এ বিষয়ে সব সাহাবি ইজমা (ঐকমত্য) হয়েছেন। (মিরকাত শারহে মিশকাত, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ১৯৪)। শাঈখ উসাইমিন (রা.) বলেছেন: ‘সুন্নত হলো যে, ইমামের অনুসরণ করবে; কারণ যখন ইমাম (তারাবির নামাজ) সম্পূর্ণ করার পূর্বে (মুক্তাদি)) চলে যায়, তখন সে কিয়ামে লাইল (রাত জাগরণ)-এর সওয়াব থেকে বঞ্চিত হয়।’ তিনি আরও বলেন: ‘আমরা দেখছি কিছু লোক ইমামের (২০ রাকাত শেষ হওয়ার) আগেই চলে যায়; শরিয়তের বিধান মতে ইমামের অনুকরণই বড় ওয়াজিব, এর বিপরীত করা মন্দ কাজ। (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড: ১৪, পৃষ্ঠা: ২০০-২০১)।

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (র.) বলেন: ‘তবে তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে নিশ্চয় উবাই ইবনে কাআব (রা.) রমজানে রাত জেগে ২০ রাকাতে (তারাবির নামাজে) মানুষের ইমামতি করতেন এবং তিন রাকাত বিতির নামাজ পড়তেন। তাই বহু উলামায়ে কিরাম মনে করেন, এটাই সুন্নত; কেননা তা আনসার ও মুহাজির সব সাহাবির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত, আর কেউ তা অস্বীকার করেননি।

অন্য ইমামেরা ৩৯ রাকাত (বিতিরসহ) তারাবির নামাজ পড়া পছন্দ করেন; কারণ তা হলো মদিনার আমল। তিনি আরও বলেন: সুতরাং ২০ রাকাত তারাবির নামাজ পড়াই উত্তম, আর এটাই অধিকাংশ মুসলমানের আমল; আর নিশ্চয় এটি ১০ (সর্বনিম্ন) ও ৪০ (সর্বোচ্চ)-এর মাঝামাঝি। তবে যদি কেউ ৪০ রাকাত বা অন্য কোনো সংখ্যা আদায় করেন, তবে তাও জায়েজ হবে; এ বিষয়ে অন্য ইমামরাও আলোকপাত করেছেন। (মজমুআহ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২২, পৃষ্ঠা: ২৭২; খণ্ড: ২৩, পৃষ্ঠা: ১১২)।


মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
smusmangonee@gmail.com