শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন

.
.

দ্বাপরের যুগ সন্ধিক্ষণে রোহিণী নক্ষত্রের অষ্টমী তিথিতে জন্ম নেওয়া সনাতন ধর্মের মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের আজ শুভ জন্মতিথি। আর শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত লীলাকে কেন্দ্র করেই জন্মাষ্টমী উৎসব পালিত হয়।
দ্বাপর যুগে অসুররূপী রাজশক্তির দাপটে পৃথিবী ম্রিয়মাণ হয়ে ওঠে, ধর্ম ও ধার্মিকেরা অসহায় হয়ে পড়েন। বসুমতী পরিত্রাণের জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা সবাই মিলে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের যুগসন্ধিক্ষণে তারা সবাই মিলে বিষ্ণুর বন্দনা করেন। স্বয়ং ব্রহ্মা মগ্ন হন কঠোর তপস্যায়। ধরণির দুঃখ-দুর্দশায় ব্যথিত হয়ে দেবতাদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি দেবতাদের অভয়বাণী শোনান এই বলে যে তিনি অচিরেই মানবরূপে ধরাধামে অবতীর্ণ হবেন দেবকীর অষ্টম সন্তানরূপে শঙ্খ চক্র, গদাপদ্মধারী শ্রীকৃষ্ণরূপে। ভগবান বিষ্ণু দেবতাদের নির্দেশ দেন ধরাধামে তাঁর লীলার সহচর হওয়ার জন্য। বিষ্ণুর নির্দেশমতো দেবতারা তাঁদের স্ব স্ব পত্নীসহ ভগবানের কাঙ্ক্ষিত কর্মে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে যদুকুলে বিভিন্ন পরিবারে জন্ম নেন। এভাবে ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য দেবতাদের মর্ত্যলোকে অবতরণ। শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব।
পাশবিক শক্তি যখন সত্য, সুন্দর ও পবিত্রতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অসুন্দরকে দমন করে মানবজাতিকে রক্ষা এবং শুভ শক্তিকে প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রীকৃষ্ণের জন্ম। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উদ্গাতা শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগের সন্ধিক্ষণে বিশৃঙ্খল ও অবক্ষয়িত মূল্যবোধের পৃথিবীতে মানবপ্রেমের অমিত বাণী প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যদাযদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত/অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্/পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্/ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে -জ্ঞানযোগ ৭/৮। ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের বৃদ্ধির তাৎপর্য হলো— ভগবদ্ প্রেমী, ধর্মাত্মা, সদাচারী, নিরপরাধ এবং মানুষের ওপর নাস্তিক, পাপী, দুরাচার, বলবান ব্যক্তিদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাওয়া এবং মানুষের মধ্যে সদ্গুণ সদাচার অত্যন্ত কমে গিয়ে দুগুর্ণ—দুরাচারের অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন—হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি জানেন, তিনি দেহত্যাগ করে আর জন্মগ্রহণ করেন না—তিনি আমাকেই পেয়ে থাকেন। তিনি আরও বলেছেন, আমি জন্মহীন, অব্যয় আত্মা, ভূতগণের ঈশ্বর হয়েও নিজ প্রকৃতিকে আশ্রয় করে আত্মমায়ায় জন্মগ্রহণ করি।

>ভক্তরা তাঁকে যে নামে ডাকেন, তিনি সে নামে সাড়া দেন। যেভাবে তাঁকে পেতে চান, সেভাবেই তিনি ধরা দেন। তাই তো তিনি দেবকী ও বসুদেবের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে কংসের কারাকক্ষে তাঁদের সম্মুখে আবির্ভূত হন পুত্ররূপে, কৃষ্ণ নামে

পুরাণাদিতে অবতারের অসুর বিনাশের যে লীলা বর্ণনা আছে, ধর্ম-সংস্থাপন বলতে কেবল তাই-ই বোঝায় না। ধর্মের দুটি দিক আছে—বাহ্য বা ব্যবহারিক ও অভ্যন্তরীণ বা আধ্যাত্মিক। শ্রীকৃষ্ণ-অবতারেরও দুটি উদ্দেশে্যর দুটি দিক হলো—অন্তর্জগতে মানবাত্মার উন্নতি সাধন ও বাহ্যজগতে মানবসমাজের রাষ্ট্রীয় বা নৈতিক পরিবর্তন সাধন। পুরাণে একে ধরাভারহরণ, অসুর নিধনাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু শুধু এটাই শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্য নয়। বুদ্ধ, খ্রিষ্ট, শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণসহ অনেককেই অবতার বলা হয়, এসব অবতারের অসুর বিনাশ নেই, এসব অবতারের একমাত্র উদ্দেশ্য মানবাত্মাকে দিব্য প্রেম-পবিত্রতা-জ্ঞান-ভক্তির অনুপ্রেরণা দেওয়া। পক্ষান্তরে পৌরাণিক নৃসিংহাদি অবতারের অসুর বিনাশ ব্যতীত আর কিছু দেখা যায় না। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ অবতারের দুটিই উদ্দেশ্যই বিদ্যমান।
বেদে বলা আছে, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়, নিরাকার, জ্যোতির্ময়, সর্বত্র বিরাজমান এবং সর্বশক্তিমান। বেদজ্ঞ জ্ঞানী ঋষিরা নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করে থাকেন। সাধারণ মানুষের পক্ষে নিরাকার ঈশ্বরের উপলব্ধি খুবই কঠিন কাজ।
মহাকাল ও মহাজগৎ ব্যাপ্ত হয়ে যিনি অনন্ত সর্বশক্তিমান সত্তায় শাশ্বত সত্যরূপে বিরাজিত, আমরা তাঁকেই ভগবান বা ঈশ্বর নামে ডেকে থাকি। কেবল সনাতনীকল্প মণীষাতেই তিনি অষ্টোত্তর শত নামে সম্ভাষিত হয়েছেন। ভক্তরা তাঁকে যে নামে ডাকেন, তিনি সে নামে সাড়া দেন। যেভাবে তাঁকে পেতে চান, সেভাবেই তিনি ধরা দেন। তাই তো তিনি দেবকী ও বসুদেবের আকুল প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে কংসের কারাকক্ষে তাঁদের সম্মুখে আবির্ভূত হন পুত্ররূপে, কৃষ্ণ নামে।
তারাপদ আচার্য্য: সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ।