সিয়াম সাধনা মুহাসাবা ও আত্মপর্যালোচনা

সিয়াম শব্দটি সওমের বহুবচন, এর অর্থ বিরত থাকা বা নিয়ন্ত্রণ করা। রমজান তাকওয়ার জন্য, তাকওয়ার মূল কথা নিয়ন্ত্রিত সুশৃঙ্খল জীবন। রমজানের শেষ প্রান্তে এসে আমাদের দেখা দরকার আমরা রমজানের লক্ষ্য কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি। আমাদের সিয়াম সাধনা কতটা সার্থক হয়েছে?
পবিত্র রমজানের ফজিলতসংক্রান্ত তিনটি হাদিসে এর সুফলপ্রাপ্তির জন্য ‘ইমান’ ও ‘ইহতিসাব’-এর শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যথা হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘যে ব্যক্তি ইমান ও ইহতিসাবের (আত্মজিজ্ঞাসা) সঙ্গে রমজান মাসে রোজা রাখবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি শরিফ, ইমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ২৮)। ‘যে ব্যক্তি ইমান ও ইহতিসাবের (আত্মপর্যালোচনা) সঙ্গে রমজান মাসে রাত জাগবে (তারাবির নামাজ পড়বে, ইবাদত করবে), তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি শরিফ, ইমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ২৭) ‘যে ব্যক্তি ইমান ও ইহতিসাবের (আত্মমূল্যায়ন) সঙ্গে কদরের রাত জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।’ (বুখারি শরিফ, ইমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ২৫)
মুহাসাবা শব্দটি আরবি হিসাব শব্দ থেকে এসেছে। হিসাব শব্দটি এসেছে ‘হাসব’ শব্দ থেকে, যার আভিধানিক অর্থ হলো যথেষ্ট, পর্যাপ্ত, যথাযথ ইত্যাদি। ‘মুহাসাবা’ অর্থ হিসাব করা, মূল্যায়ন করা, পর্যালোচনা করা, তুলনামূলক মূল্যায়ন ইত্যাদি। মুহাসাবা শব্দটি ‘ইহতিসাব’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইহতিসাব মানে অনুসন্ধান, সমালোচনা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাই, মূল্যায়ন, ফলাফল প্রত্যাশা, পুণ্য বা সওয়াবের আশা ও আত্মজিজ্ঞাসা।
হাদিস শরিফে আছে, ‘তোমার হিসাব নেওয়ার আগে নিজের হিসাব নিজে করে রাখো।’ (বুখারি ও মুসলিম)। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘মানুষের হিসাব নিকটে এসে গেছে, তবু তারা উদাসীনতায় মুখ ফিরিয়ে আছে।’ (আল কোরআন, সুরা-২১ [৭৩] আল আম্বিয়া)। কিয়ামতের দিনে আল্লাহ তাআলা বলবেন: ‘তোমার হিসাব-কিতাব পাঠ করো; আজ তোমার হিসাবের জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট।’ (আল কোরআন, সুরা-১৭ [৫০] আল ইসরা-বনি ইসরাঈল।
রমজান মাসের প্রথম দশক যেহেতু রহমতের বা দয়ার; সুতরাং এই দশকে আমাদের করণীয় হবে আল্লাহ পাকের দয়া-সংক্রান্ত নামসমূহের জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করে এর ভাব ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করার চেষ্টা করা এবং আজীবন বিতরণ করা, তথা আল্লাহর গুণাবলি নিজের মাধ্যমে তাঁর সৃষ্টির কাছে পৌঁছে দেওয়া। আমি দয়া বা রহমত লাভ করেছি বা দয়ার অধিকারী হয়েছি, তা বোঝা যাবে আমার আচরণে যদি সর্বদা দয়া ও করুণা প্রকাশ পায়। রমজান মাসের দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের। মাগফিরাতের মূল শিক্ষা হলো, আমি সবাইকে ক্ষমা করে দেব, যেন আল্লাহর ক্ষমা পাই। হাদিস শরিফে আছে: ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ গোপন রাখবেন। (তিরমিজি শরিফ)। রমজান মাসের শেষ দশক হলো নাজাত। নাজাত মানে মুক্তি। রমজানের শেষ দশকের নাজাতের অর্থ হলো: এই দশকে মানুষ পাপ থেকে মুক্ত হবে, জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবে; পাপের আকর্ষণ থেকে মুক্ত হবে। যেভাবে একজন নেশায় আসক্ত বা নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে নেশা থেকে মুক্তি লাভ করে থাকে।
মানবসত্তা বা ‘নফস’, অর্থাৎ কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ, মাৎসর্য—এই ষড়্রিপু সমন্বয়ে গঠিত ব্যক্তিসত্তার তিন অবস্থা। যথা নাফসে আম্মারা, নাফসে লাউওয়ামা; নাফসে মুতমাইন্না। নাফসে আম্মারা হলো পাপের প্রতি আকৃষ্ট নাফস বা অবাধ্য সত্তা। নাফসে লাউওয়ামা হলো অনুতপ্ত সত্তা, যে পাপ করে নাফসের তাড়নায়; শয়তানের ধোঁকায় বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের শিকার হয়ে এবং লজ্জিত, অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে। নাফসে মুতমাইন্না মানে হলো প্রশান্ত নাফস, যার পাপের প্রতি অনুরাগ থাকে না এবং নেকির প্রতি আকর্ষণ থাকে।
নাফসে আম্মারা বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন: (হজরত ইউসুফ আ. বলেছেন) ‘আর আমি আমার নাফসকে নির্দোষ বলি না, নিশ্চয় নাফস অবশ্যই মন্দ কাজের প্রতি নির্দেশ করে, আমার রব যাকে রহম করেন, তাকে ছাড়া; নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল ও দয়ালু। (আল কোরআন, সুরা-১২ [৫৩] ইউসুফ)। নাফসে লাউওয়ামা সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘শপথ কিয়ামত দিবসের আর শপথ নাফসে লাউওয়ামার।’ (আল কোরআন, সুরা-৭৫ [৩১] আল কিয়ামা)। নাফসে মুতমাইন্না সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা: ‘হে প্রশান্ত আত্মা! সন্তুষ্ট চিত্তে তোমার রবের নিকট আসো এবং আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।’ (আল কোরআন, সুরা-৮৯ [১০] আল ফাজর)। নাফসে মুতমাইন্না হলো নাফসের নির্মোহ অবস্থা; এটাই হলো প্রকৃত মুক্তি বা নাজাত। মুমিনে কামিল বা পরিপূর্ণ বিশ্বাসী হতে হলে রিপুগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ইস্তিগফার একটি স্বতন্ত্র ইবাদত; এর জন্য গুনাহ বা পাপ করা জরুরি নয়। যেমন অজু, নামাজ, রোজা, হজ ইত্যাদি ইবাদত দ্বারা গুনাহ মাফ হয়; কিন্তু এসব ইবাদত করার জন্য গুনাহ করা শর্ত নয়। তাওবা ও ইস্তিগফার আল্লাহ তাআলার অতি পছন্দের একটি ইবাদত। তাই প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মাসুম নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও প্রতিদিন সত্তর থেকে এক শ বার তওবা ও ইস্তিগফার করতেন। অনুরূপ ইমানের পর নামাজ সর্বপ্রধান ও সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হওয়া সত্ত্বেও এই নামাজ আদায়ের পর তিনবার ইস্তিগফার পড়া সুন্নত। অর্থাৎ ইস্তিগফার শুধু পাপের পরে নয়, ইবাদতের পরেও করা হয়। যেমন হজের পর ইস্তিগফার করা বিষয়ে কোরআনে উল্লেখ আছে: ‘(হজ শেষে) তারপর তোমরা বেরিয়ে পড়ো যেভাবে মানুষ চলে যাচ্ছে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ (আল কোরআন, সুরা-২ [৮৭] আল বাকারা)।
রমজানে আমরা এক মাস রোজা পালন করলাম, বাকি এগারো মাস রোজার আদর্শ মেনে চলতে পারব কি না? রমজানে আমরা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজসহ তারাবি, তাহাজ্জুদ, ইশরাক, চাশত, যাওয়াল, আউওয়াবিন ও অন্যান্য নফল নামাজ পড়ি; বাকি জীবন নামাজের আদলে পরিচালিত করতে পারব কি না? রমজানে আমরা খতম তারাবিসহ বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন করি; কোরআনের নির্দেশ আমার ব্যক্তিজীবন, পরিবার ও সমাজে বাস্তবায়ন করতে পারছি কি না? সত্যতা, সততা ও পবিত্রতা কতটুকু অর্জন করেছি?
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
[email protected]