হজ পরিচিতি ও প্রকারভেদ

বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সেতুবন্ধনের উপায় হলো হজ পালন করা। যাঁদের আর্থিক ও শারীরিক সামর্থ্য রয়েছে, হজ তাঁদের জন্য ফরজ ইবাদত। এই ফরজ ইবাদত পালনের উদ্দেশ্যে হাজিদের প্রথম কাজ হলো ইহরাম বাঁধা। ইহরাম বাঁধার পরই তিনবার তালবিয়া পাঠ করতে হয়, ‘লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক; লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’ ‘আমি হাজির তব সন্নিধানে, হে আল্লাহ! আমি হাজির তব দ্বারে; আমি হাজির তোমার দরজায়, তোমার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির তোমার দরগায়। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা ও সব নিয়ামত তোমারই, আর তোমার রাজ্যে তোমার কোনো অংশীদার নেই।’ এই হলো ‘তালবিয়া’, অর্থাৎ কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে উপস্থিতির আকুতিপূর্ণ বিনীত ঘোষণা।

হজের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ
হজের আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা, সফর, ভ্রমণ করা। ইসলামি পরিভাষায় হজ হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে বিশেষ কিছু কর্ম সম্পাদন করা। হজের নির্দিষ্ট সময় হলো আশহুরে হুরুম বা হারাম মাসগুলো তথা শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ; বিশেষত ৮ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত ৫ দিন। হজের নির্ধারিত স্থান হলো: মক্কা শরিফে কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা ইত্যাদি এবং মদিনা শরিফে রাসুল (সা.)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা। হজের বিশেষ আমল বা কর্মকাণ্ড হলো: ইহরাম, তাওয়াফ ও সাই, অকুফে আরাফা, অকুফে মুজদালিফা, অকুফে মিনা, দম ও কোরবানি, হলক ও কছর এবং জিয়ারতে মদিনা-রওজাতুন রাসুল (সা.) ইত্যাদি। আফাকি তথা দূরবর্তী হাজিদের জন্য মদিনা মুনাওয়ারায় রাসুল (সা.)-এর রওজা শরিফ জিয়ারত করা ওয়াজিব। (আসান ফিকাহ, ইউসুফ ইসলাহি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৫১)।

হজের বিধান
হজ আল্লাহ তাআলার একটি বিশেষ বিধান, ইসলামের মৌলিক ৫ ভিত্তির অন্যতম। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সমর্থ নারী-পুরুষের ওপর হজ ফরজ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর তরফ থেকে সেই সব মানুষের জন্য হজ ফরজ, যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে।’ (সুরা: আলে ইমরান; আয়াত: ৯৭)।

হজের ফজিলত ও হজ না করার পরিণতি
রাসুলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘হজ মানুষকে নিষ্পাপ করে, যেভাবে লোহার ওপর থেকে মরিচা দূর করা হয়।’ (তিরমিজি)। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত হজের পুরস্কার বেহেশত ছাড়া অন্য কিছুই হতে পারে না। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে যারা হজ পালন করবে, আল্লাহ তাআলা তাদের হজ কবুল করবেন এবং তাদের জন্য রয়েছে অফুরন্ত রহমত ও বরকত।’ নবী করিম (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি যথাযথভাবে হজ পালন করে, সে আগের পাপ থেকে এমন নিষ্পাপ হয়ে যায় যেমন সে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন নিষ্পাপ ছিল।’ (বুখারি)। রাসুল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি হজের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ না করে মারা গেল, সে ইহুদি হয়ে মরুক অথবা খ্রিষ্টান হয়ে।’ (মুসলিম)।

হজের ফরজ ও ওয়াজিব
হজের ফরজ তিনটি। যথা: ১. ইহরামের নিয়ত বা ইচ্ছা করা, ২. অকুফে আরাফা করা, ৯ জিলহজ জোহর থেকে ১০ জিলহজ ফজরের পূর্ব পর্যন্ত যেকোনো সময় আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা, ৩. তাওয়াফে জিয়ারত করা, ১০ জিলহজ ভোর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যেকোনো সময় কাবাঘর তাওয়াফ বা সাতবার প্রদক্ষিণ করা।
হজের ওয়াজিব সাতটি। যথা: ১. আরাফাত থেকে মিনায় ফেরার পথে মুজদালিফা নামক স্থানে ১০ জিলহজ ভোর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কিছু সময় অবস্থান করা, ২. সাফা ও মারওয়া সাই করা বা দৌড়ানো, ৩. ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ জামরায় শয়তানকে পাথর মারা, ৪. তামাত্তু ও কিরান হজে কোরবানি করা, ৫. মাথার চুল কামিয়ে বা কেটে ইহরাম খোলা, ৬. বিদায়ী তাওয়াফ করা; ৭. মদিনা শরিফে রওজাতুন নবী (সা.) জিয়ারত করা। (আসান ফিকাহ, ইউসুফ ইসলাহি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ২৫১)।

হজের সুন্নত
হজের সুন্নত ১০টি। যথা: ১. তাওয়াফ করা (ইফরাদ ও কিরান হজকারীর জন্য)। ২. তাওয়াফের সময় প্রথম তিন চক্কর সৈনিকের মতো বীরদর্পে চলা। ৩. খলিফা অথবা তাঁর প্রতিনিধি তিন দিন তিন জায়গায় খুতবা প্রদান করা বা ভাষণ দেওয়া। ৭ জিলহজ কাবা শরিফের হারাম শরিফে, ৯ জিলহজ আরাফাতে মসজিদে নামিরাতে, ১১ জিলহজ মিনায়। ৪. ৮ জিলহজ মক্কা শরিফ থেকে মিনায় গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা এবং রাতে সেখানে অবস্থান করা। ৫. ৯ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে আরাফাতের দিকে রওনা হওয়া। ৬. অকুফে আরাফা বা আরাফাতে অবস্থানের জন্য সকালে গোসল করা। ৭. ৯ জিলহজ আরাফাতে অবস্থান করে সূর্যাস্তের পর মুজদালিফার দিকে রওনা করা। ৯. ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ মিনায় রাত্রি যাপন করা। ১০. মিনা থেকে মক্কা শরিফ প্রত্যাবর্তনের সময় ‘মুহাচ্ছার’ নামক জায়গায় কিছু সময় অবস্থান করা।

হজের প্রকারভেদ
হজ তিন প্রকার। যথা: ইফরাদ, কিরান ও তামাত্তু। শুধু হজের ইহরামের নিয়ত করে তা সম্পন্ন করলে একে ‘ইফরাদ হজ’ বা একক হজ বলা হয়। হজ ও ওমরাহর জন্য একত্রে ইহরামের নিয়ত করে একই ইহরামে তা সম্পন্ন করলে তাকে ‘কিরান হজ’ বা যৌথ হজ বলা হয়। একই সফরে প্রথমে ওমরাহর ইহরামের নিয়ত করে, তা সম্পন্নপূর্বক হজের জন্য নতুন করে ইহরামের নিয়ত করে তা সম্পাদন করাকে ‘তামাত্তু হজ’ বা সুবিধাজনক হজ বলা হয়।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
smusmangonee@gmail,com