ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়

তেজগাঁওয়ে পবিত্র জপমালা রানীর িগজ৴ায় গতকাল িবকেলে বড়দিনের প্রস্তুতিছবি: তানভীর আহাম্মেদ

বড়দিন প্রসঙ্গকথা

ধর্মকে আশ্রয় করে উৎসব ও পর্ব বা পর্বদিন অনুষ্ঠিত হয়। খ্রিষ্টধর্মের প্রধান পর্ব বড়দিন ও পুনরুত্থান পর্ব। তবে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ও আনন্দের উৎসব হলো বড়দিন। ঈশ্বরপুত্র যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন হলো বড়দিন।

বর্তমানে বড়দিনের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ একদিকে আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় উৎসব, অন্যদিকে বার্ষিক অনুষ্ঠানাদি, সাজসজ্জা, কীর্তন-কনসার্ট, কেক-পিঠা, পানাহার-পার্টি, গান-কবিতাসহ নানাবিধ উৎসবের আয়োজন।

বড়দিন উদ্্যাপনে ঘাটতি নেই কোথাও। তবে বড়দিনের আধ্যাত্মিক চেতনাটি বিশ্বাসী-ভক্তদের বড় করেই দেখতে হবে। বিশ্বাস-ভালোবাসা, ক্ষমা চাওয়া–করার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার আহ্বানে পূর্ণ হয় বড়দিন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির সঙ্গে মিলিত হওয়াই হবে অর্থপূর্ণ বড়দিন, সার্থক ও সুন্দর বড়দিন।

পুরোনো নিয়মের মুক্তিদাতার ইঙ্গিতবার্তা

প্রবক্তা ইসাইয়া তাঁর প্রাবক্তিক বাণীতে বলেন, ‘ওই দেখো, তোমার পরিত্রাতা আসছেন’ (ইসাইয়া ৬১: ১১)। সেই পরিত্রাতা সততা, ন্যায্যতা ও ভালোবাসার পথ দেখাবেন। তিনি হয়ে উঠবেন মুক্তিদাতা, শান্তিরাজ, ধর্মরাজ ও অন্ধকার বিনাশী আলোকবর্তিকা।

প্রবক্তা ইসাইয়ার ভাষায়, ‘অন্ধকারে পথ চলছিল যারা, সেই জাতির মানুষেরা দেখেছে এক মহান আলো; ছায়াচ্ছন্ন দেশে যারা বাস করছিল, তাদের ওপর ফুটে উঠেছে একটি আলো।’ (ইসাইয়া ৯: ১) মুক্তিদাতা খ্রিষ্ট হয়ে উঠবেন চলার পথের সাথি। প্রবক্তা ইসাইয়া আরও বলেন, ‘কেননা, আমাদের জন্য একটি শিশু জন্ম নিয়েছেন, একটি পুত্রকে আমাদের হাতে তুলেই দেওয়া হয়েছে। তাঁর কাঁধের ওপর রাখা হয়েছে সবকিছুর আধিপত্য ভার। তাঁকে ডাকা হবে অনন্য পরিকল্পক, পরাক্রমী ঈশ্বর, শাশ্বত পিতা শান্তিরাজ—এমনি সব নামে।’ (ইসাইয়া ৯: ৫)

প্রবক্তা ইসাইয়া যিশুখ্রিষ্টের আগমন উপলক্ষে বলেন, ‘তখন নেকড়ে বাঘ মেষশাবকের সঙ্গে বাস করবে, চিতাবাঘ শুয়ে থাকবে ছাগল ছানার পাশে।....একটি ছোট্ট ছেলে তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।...দুধের শিশু তখন কেউটে সাপের পথের ওপর খেলা করবে’। (ইসাইয়া ১৬: ৬-৮)

নতুন নিয়মে মুক্তিদাতা

সমগ্র মঙ্গল সমাচারে দেখানো হয়েছে আব্রাহাম, ইসাহাক ও যাকোবের ঈশ্বর, মোশির ঈশ্বর ও এলিয়ের ঈশ্বর হলেন স্বয়ং যিশুখ্রিষ্টেরই পিতা।

পবিত্র নতুন নিয়মে মারিয়ার নিকট স্বর্গদূত গ্যাব্রিয়েলের অভয়বাণীতে উচ্চারিত হয়—‘ভয় পেয়ো না, মারিয়া! তুমি পরমেশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেছ। শোনো, গর্ভধারণ করে একটি পুত্রের জন্ম দেবে, তাঁর নাম রাখবে যিশু। তিনি মহান হয়ে উঠবেন, পরার্থপরের পুত্র বলে পরিচিত হবেন।’ (লুক ১: ৩০-৩২)

যিশুর আগমনের মধ্য দিয়ে সব মানুষই তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা জানিয়েছিল। তাদের মধ্যে প্রথমত স্বর্গদূত, দ্বিতীয়ত, রাখাল ও তৃতীয়ত, তিন পণ্ডিত।

চারটি মঙ্গল সমাচারের মধ্যেই যিশুর জন্মকাহিনির বিবরণ পাওয়া যায় (মথি ১: ১৮; ২: ১-১২; মার্ক ১: ১-১১; লুক ২: ২৬-৪৫,২: ১-২০)। যোহন লিখিত মঙ্গল সমাচারে বাণীর দেহধারণের বিষয়টি বর্ণনা করা হয় (দ্রষ্টব্য যোহন ১: ১-১৮)। তবে সাধু লুকের লেখা মঙ্গল সমাচারে যিশুর জন্মকাহিনি বিশদ আঙ্গিকে লেখা হয়।

যিশুর জন্মোৎসবে নবচিন্তায় আসিসির সাধু ফ্রান্সিস

ইতালির আসিসি নগরের সাধু ফ্রান্সিস (১১৮১-১২২৬) ছিলেন একজন ধনী কাপড় ব্যবসায়ীর সন্তান। তিনি জগতের জাগতিকতা, ভোগবিলাস, বিত্তবৈভব ও আরাম–আয়েশের জীবন পরিত্যাগ করেন। তাঁর চিন্তাচেতনা, ধ্যানধারণা ও উপলব্ধিতে খ্রিষ্টের নিঃস্বতা ও দারিদ্র্য সবচেয়ে বেশি স্থান পায়। তিনি বলেন, তিনি যিশুর দারিদ্র্য রূপ দেখেছেন, যাবপাত্র থেকে ক্রুশে বিদ্ধ পর্যন্ত এবং খ্রিষ্টের নিঃস্বতাকে ‘ধন্য’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

ঈশ্বরপুত্র যিশুর ধ্যানে আপ্লুত হয়ে তিনি যিশুখ্রিষ্টের জন্মবিবরণ দৃশ্যায়িত করেন আসিসির ‘গোচ্ছা’ নামের একটি ধর্মপল্লিতে। তিনি বড়দিন–পূর্ব সন্ধ্যায় গির্জার মধ্যে একটি গোশালায় মা মারিয়া, সাধু যোসেফ, মেষ, ভেড়া ও গর্দভের মূর্তি সাজিয়ে রাখেন এবং মধ্যরাত্রের খ্রিষ্টযোগে পুরোহিতের সহকারী রূপে যোগদান করেন। মঙ্গল সমাচারের পর তিনি নতজানু হয়ে গোশালার সামনে খ্রিষ্টের ‘দেহধারণ রহস্য’ ধ্যান করেন এবং মহিমা স্তোত্রের সময় সেই গোশালার শিশু যিশুকে ভক্তিভরে প্রণাম করেন। এ সময় চারদিকে ভক্ত–বিশ্বাসীরা সাধু ফ্রান্সিসের কোলে অতি উজ্জ্বল আলোকমণ্ডিত শিশু যিশুকে দেখতে পান।

সাধু ফ্রান্সিস তাঁর এই ধ্যানলব্ধ চিন্তা নিয়ে পোপ তৃতীয় হনোরিয়াসের (১২১৬-১২২৭) সঙ্গে দেখা করেন এবং গোশালা সাজানোর বিষয়টি অবগত করেন। এ ছাড়া তিনি বড়দিনের উপাসনায় গোশালা সাজানোর অনুমতি প্রার্থনা করেন। পোপ তৃতীয় হনোরিয়াস তাঁর অভিনব ও ধ্যানলব্ধ চিন্তাকে সাধুবাদ জানিয়ে গোশালা তৈরির অনুমতি দেন। পরবর্তীকালে আসিসি নগরী থেকে গোটা ইউরোপ ও বিশ্বে গোশালা তৈরির প্রচলন শুরু হয় এবং তা যিশুর ‘আত্মপ্রকাশ পর্ব’ (৬ জানুয়ারি) পর্যন্ত গির্জায় সাজিয়ে রাখা হয়। গোশালা সাজানোর প্রচলনটি গোটা বিশ্বে অতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন কৃষ্টি অনুসারে গোশালা সাজানো হয়। উল্লেখ্য, রোমের কলসিউমের কাছে সাধু কসমস ও ডামিয়েনের গির্জায় ঐতিহ্যের নিদর্শনস্বরূপ গোশালা সাজিয়ে রাখা হয়। যিশুর জন্মস্থান বেথলেহেমের গোশালার স্থানে একটি গীর্জা নির্মিত হয়, যা ‘চার্চ অব ন্যাটিভিটি’ নামে পরিচিত। বর্তমানে বড়দিনের একটি অন্যতম আকর্ষণ ও ভক্তি প্রকাশের চিহ্ন হলো গোশালা।

উপসংহার

দেশজ মনন, আধ্যাত্মিকতা ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বড়দিনের আনন্দময় চেতনা জাগরিত হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। এ দেশের মাটির সন্তান হিসেবে উৎসবময়তা যেন মাটির গন্ধ, হৃদয়ের ছোঁয়া, আশীর্বাদের দেওয়া-নেওয়া, সৌন্দর্যমণ্ডিত মানবিক মূল্যবোধ ধরা পড়ে, যেন ঘরে ঘরে, জনে জনে এটাই আমাদের কাম্য।

কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) ছিলেন একজন অখ্রিষ্টান ব্যক্তি। তিনি যিশুখ্রিষ্টের জন্মরহস্য ধ্যান ও চিন্তা করে তাঁর জন্মদিনকে ‘বড়দিন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সময়ের সীমারেখায় ‘বড়দিন’ বড় নয়, বরং মহামানব খ্রিষ্ট যিশুর আগমনের মধ্য দিয়ে দিনটি তাৎপর্যমণ্ডিত ও মহান হয়ে উঠেছে। তাই এ উৎসবকে বড়দিন উৎসব বলা খুবই অর্থপূর্ণ।

  • ফাদার দিলীপ এস. কস্তা
    ক্যাথলিক ধর্মযাজক ও লেখক