ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে বড়দিনের পূর্ণতা

১৬৩২ সালে ডাচ শিল্পী ম্যাথিয়াস স্টমারের আঁকা ছবি ‘অ্যাডোরেশন অব দ্য শেপার্ডস’ছবি: সংগৃহীত

কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) যিশুর জন্মোৎসবকে ‘বড়দিন’ নামে প্রথম আখ্যায়িত করেন। যিশুখ্রিষ্টের মর্ত্যধামে আগমনের মাহাত্ম্যকে বিবেচনা করে ‘বড়দিন’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যিশুর জীবনাদর্শে ও মাহাত্ম্যে বেড়ে ওঠা ও বড় হওয়ার আহ্বান হলো ‘বড়দিন’। বড়দিন ঘিরে ধর্মীয়, সামাজিক রীতিনীতি ও আচার-আচরণে বহু কৃষ্টিগত বিষয় স্থান পেয়েছে।

পবিত্র বাইবেলে বড়দিনের বার্তা

প্রবক্তা ইসাইয়া ৭৬২ খ্রিষ্টপূর্বে তাঁর বাণীতে বলেন, ‘ওই দেখো, তোমার পরিত্রাতা আসেন’ (ইসাইয়া ৬১: ১১)। সেই পরিত্রাতা সততা, ন্যায্যতা ও ভালোবাসার পথ দেখাবেন। তিনি হয়ে উঠবেন আলোর দিশারি। প্রবক্তা ইসাইয়ার ভাষায়, ‘অন্ধকারে পথ চলছিল যারা, সেই জাতির মানুষেরা দেখেছে এক মহান আলো; ছায়াচ্ছন্ন দেশে যারা বাস করছিল, তাদের ওপর ফুটে উঠেছে একটি আলো’ (ইসাইয়া ৯: ১)। মুক্তিদাতা খ্রিষ্ট হয়ে উঠবেন চলার পথের সাথি। তাই খ্রিষ্টকে ইম্মানুয়েল নামে ডাকা হয়। ইম্মানুয়েল শব্দের অর্থ ‘ঈশ্বর আমাদের সাথে আছেন’।

নতুন নিয়মে মারিয়ার কাছে স্বর্গদূতের অভয়বাণীতে উচ্চারিত হয়, ‘ভয় পেয়ো না, মারিয়া! তুমি পরমেশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেছ। শোনো, গর্ভধারণ করে একটি পুত্রের জন্ম দেবে, তাঁর নাম রাখবে যিশু। তিনি মহান হয়ে উঠবেন, পরাৎপরের পুত্র বলে পরিচিত হবেন’ (লুক ১: ৩০-৩২)। যিশুর আগমনের মধ্য দিয়ে সব মানুষই তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রথমত, স্বর্গদূত, দ্বিতীয়ত, রাখাল ও তৃতীয়ত, তিন পণ্ডিত। চারটি মঙ্গল সমাচারের মধ্যেই যিশুর জন্মকাহিনির বিবরণ পাওয়া যায় (মথি ১: ১৮; ২: ১-১২; মার্ক ১: ১-১১; লুক ২: ২৬-৪৫, ২: ১-২০)। জোহন লিখিত মঙ্গল সমাচারে বাণীর দেহধারণের বিষয়টি বর্ণনা করা হয় (দ্রষ্টব্য, জোহন ১: ১-১৮)।

ন্যায্যতার দাবি পূরণের জন্য দীক্ষাগুরু জোহন তাঁর জীবন উৎসর্গ করেন। অন্যদিকে যিশুর আগমনের প্রস্তুতিতে বলেন, ‘যার দুটি জামা আছে সে বরং যার কোনো জামা নেই, তাকে একটা দিক! তেমনি যার খাবার আছে, সে–ও তা অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিক।’ (লুক ৩: ১১)। তাই খ্রিষ্ট-বিশ্বাসী হওয়ার মধ্য দিয়ে ভক্ত বিশ্বাসী সহভাগিতার জীবন গড়ে তোলার আহ্বান পায়।

নির্যাতনের যুগে বড়দিন উদ্‌যাপন

নির্যাতনের যুগে (৬৪-৩১২) আনুষ্ঠানিকভাবে বড়দিন উদ্‌যাপনের কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সে সময় পুনরুত্থান উৎসবই ছিল প্রধান উৎসব। মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় বড়দিন উদ্‌যাপনের তথ্য পাওয়া যায়। তবে সম্রাট কনস্টানটাইন (২৮০-৩৩৭) ধর্মীয় স্বাধীনতা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপাসনাগুলোকে জাঁকজমকভাবে উদ্‌যাপনের অনুমতি দান করেন।

খ্রিষ্টের নিঃস্বতা ও দারিদ্র্যের বিশেষ দিক নিয়ে চিন্তা করেন আসিসির সাধু ফ্রান্সিস। তিনি বিশ্ববাসীর জন্য যিশুর জন্মোৎসবকে নতুন চিন্তা-চেতনার খোরাক দেন। ১২২৩ খ্রিষ্টাব্দে আসিসি নগরীতে বড়দিনে তিনি প্রথম গোশালা তৈরি করেন এবং মহিমা স্তোত্রের সময় সেই গোশালায় শিশু যিশুকে ভক্তিভরে প্রণাম করেন। পরবর্তী সময়ে আসিসি নগরী থেকে গোটা ইউরোপ এবং বিশ্বে গোশালা তৈরির প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে বড়দিনের একটি অন্যতম আকর্ষণ ও ভক্তি প্রকাশের চিহ্ন হলো গোশালা। ক্রিসমাস ট্রি ব্যবহারের প্রচলন আসে জার্মানিতে। লোকশ্রুতি থেকে জানা যায়, থরগাছ নামের একধরনের চিরহরিৎ বৃক্ষের ডাল দিয়ে বাড়িঘর সাজানো হতো, যা যিশুর চিরন্তন সৌন্দর্যকে প্রকাশ করত।

১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে মার্টিন লুথার ক্রিসমাস ট্রিতে আলোকসজ্জা করার মাধ্যমে ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর প্রচলনটি জনপ্রিয় করে তোলেন। ভিক্টোরিয়ান যুগে বড়দিন বিষয়টি গান-কবিতা ও কীর্তনের মধ্যে প্রাধান্য পায়।

১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানানোর জন্য ইংল্যান্ডে জে সি হসলি প্রথম বড়দিনের কার্ড দিয়ে তাঁর বন্ধু স্যার হেনরিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। এই কার্ডের শুভেচ্ছাবাণীতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আ মেরি ক্রিসমাস অ্যান্ড হ্যাপি নিউ ইয়ার টু ইউ’। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ১ হাজার কপি কার্ড ছাপানো হয়েছিল এবং রং লাগিয়ে তা আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছিল। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের পর বড়দিনের কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময়ের প্রচলনটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ইম্পিরিয়াল পেনি পোস্টেজের উদ্বোধন উপলক্ষে একটি কানাডিয়ান ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছিল। এই ডাকটিকিটে বিশ্বের মানচিত্রের তলায় ‘XMAS 1898’ কথাটি খোদিত ছিল। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিসমাস গ্রিটিংস স্ট্যাম্প প্রকাশ করা হয় এবং ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের পর আরও অনেক দেশে বড়দিনের ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয় এবং জনপ্রিয় প্রথা হয়ে ওঠে।

পারস্যের বিশপ সাধু নিকোলাস ছিলেন দয়ালু স্বভাবের মানুষ। কথিত আছে, তিনি রাতের বেলায় বিভিন্ন মহল্লায় ঘুরে ঘুরে দ্বীন-দরিদ্র মানুষের খোঁজখবর নিতেন এবং অসহায় মানুষকে গোপনভাবে আর্থিক সহযোগিতাসহ উপহার দান করতেন। শিশুদের কাছে তিনি দয়ালু সাধু হিসেবে আবির্ভূত হন। পরবর্তী সময়ে উচ্চারণ–বিভ্রাটের কারণে সাধু নিকোলাস সান্তা ক্লজে পরিবর্তিত হয়।

পূর্বদেশীয় তিন পণ্ডিত (বালথাজার, মালখেয়র ও কাসপার) প্রথম শিশু যিশুকে ভক্তি-শ্রদ্ধা জানিয়ে উপহার (সোনা, ধূপধুনো ও গন্ধ নির্যাস) প্রদান করেন। সেই ধারাবাহিকতায় বড়দিনে উপহার প্রদান একটি অন্যতম প্রথা হিসেবে সব বয়সী মানুষের কাছে গ্রহণীয় ও বরণীয় হয়ে ওঠে।

বড়দিনের প্রস্তুতি ও সাজগোজ

গোটা বিশ্বেই বড়দিনের প্রস্তুতি অন্যতম বাস্তবতা। বড়দিনের উৎসব ঘিরেই বিভিন্ন ধরনের আয়োজন করা হয়ে থাকে। বিশেষভাবে সাজপোশাক, দোকানপাট, শপিং মল, রাস্তাঘাটসহ যাবতীয় স্থানেই বড়দিনের সাজ ও আয়োজন লক্ষ করা যায়।

বড়দিন উৎসবকে আনন্দময় ও ঘনঘটা পরিবেশে উদ্‌যাপনের জন্য উপাসনা, কীর্তন, নাচ-গান, প্রকাশনা, পার্টি, বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে সিনেমা মুক্তিসহ আরও অনেক কিছুরই আয়োজন করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বড়দিন একটি সুন্দর সময়ে উদ্‌যাপন করা হয়। যে সময় গ্রামবাংলায় কৃষকের ঘরে নতুন ফসল ওঠে ও নবান্ন উৎসব করা হয়। মোগল দরবারে সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৬) সময়ে বড়দিন উদ্‌যাপন করা হতো। সম্রাট আকবর গোশালা সাজানোর অনুমতি দিতেন এবং নিজেও গোশালা পরিভ্রমণ করার মাধ্যমে যিশুর জন্মরহস্য নিয়ে ধ্যান ও চিন্তা করতেন।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) চিন্তা-চেতনায় যিশুর জন্মরহস্য ও তাঁর জীবনাদর্শ বিভিন্ন লেখা ও কবিতার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। বোলপুরে প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনে প্রতিবছর বড়দিন উদ্‌যাপন করা হতো। ‘শিশুতীর্থ’ কবিতায় শিশু যিশুর বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘মা বসে আছেন তৃণশয্যায়, কোলে তাঁর শিশু,/ উষার কোলে যেন শুকতারা।/ ...উচ্চস্বরে ঘোষণা করলে—জয় হোক মানুষের,/ ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের’।

রবীন্দ্রনাথ খ্রিষ্ট নামক গ্রন্থে প্রকাশিত ‘বড়োদিন’ প্রবন্ধে আত্মজিজ্ঞাসামূলক প্রশ্ন রেখেছেন, যা বর্তমান বাস্তবতায় প্রযোজ্য: ‘আজ তাঁর জন্মদিন এ কথা বলব কি পঞ্জিকার তিথি মিলিয়ে? অন্তরে যে দিন ধরা পড়ে না সে দিনের উপলব্ধি কি কাল গণনায়? যেদিন সত্যের নামে ত্যাগ করেছি, যেদিন অকৃত্রিম প্রেমে মানুষকে ভাই বলতে পেরেছি, সেই দিনই পিতার পুত্র আমাদের জীবনে জন্মগ্রহণ করেছেন, সেই দিনই বড়দিন—যে তারিখেই আসুক’।


ফাদার দিলীপ এস কস্তা ক্যাথলিক ধর্মযাজক, সাধ্বী রীতার ধর্মপল্লি, মথুরাপুর, চাটমোহর, পাবনা